বিশ্বে এখন করোনা কাল স্বমহিমায় বিরাজমান। গত বছর ফেব্রুয়ারী থেকে কোভিড-১৯ ভাইরাসের দখলে আমাদের প্রিয় ধরিত্রী।পৃথিবীজুরে লক্ষ লক্ষ মৃত্যুর খবরে প্রথমদিকে সবাই আতঙ্কগ্রস্থ হলেও আজ আমাদের সংবেদনে দরকচা পড়ে গেছে। জায়মান ভাইরাসের দৌলতে মৃত্যুসংবাদ আজ আমাদের আর আন্দোলিত করেনা। ভারতবর্ষে দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পর সংক্রমণ ও মৃত্যু আমাদের বহু মানুষের ঘরে ঢুকে মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের নতুন বোধে উন্নীত করেছে ইতমধ্যে। আমাদের আবেগতন্ত্রীগুলো কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গেছে বিগত দেড় বছরেরও বেশী সময়কাল ধরে। আমরা দেখলাম উন্নত দেশগুলোর ধন-দৌলত, প্রযুক্তি, চিকিৎসা ব্যবস্থা লড়াই করতে ব্যর্থ হোল এই ভাইরাসের বিরূদ্ধে। বিশ্বজুরেই রাজনীতি, অর্থনীতি, উৎপাদন ব্যবস্থা আজ ধ্বস্ত। করোনা ভাইরাস তৃতীয়-চতুর্থ ঢেউ-এ চেপে তান্ডব চালাচ্ছে আজও। কবে এই অবস্থা থেকে মুক্তি—জানা নেই কারোই।
এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বের সংস্কৃতি ক্ষেত্রর চেহারাটাও রক্তশূন্যতায় ভুগছে। সিনেমা হলগুলো বন্ধ, নাট্যশালা বন্ধ, নাচ-গানের আসর বন্ধ, টিভি-সিনেমার শ্যুটিং বন্ধ। অর্থাৎ বিনোদন শিল্পের সব দরজাগুলোই দীর্ঘকাল ধরে বন্ধ। সব দেশের সরকারই মাঝে মধ্যে আংশিক খোলার ব্যবস্থা করে। কিন্ত খোলার পরপরই দেখা যায় আবার সংক্রমণ বাড়ছে। ফলে আবার সব বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টিশীল মানুষেরা পাগল-পাগল মাথা নিয়ে নিজের মাথার চুল ছিঁড়ছে। আর কতদিন স্থবিরতাপাশে আটকে থাকতে হবে তাঁদের, এই চিন্তায় দিশেহারা তাঁরা।
পাশাপাশি, যাঁরা বিনোদন পেশার সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত তাঁদের অবস্থা বাস্তবিকই শোচনীয়। দীর্ঘ সময় ধরে রুজি বন্ধ থাকায় বহু পরিবারই ধুঁকছে। বিশেষত, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বিনোদন পেশায় যুক্ত মানুষগুলোর অবর্ণনীয় অবস্থার কথা সংবাদ মাধ্যম সূত্রে সুবিদিত আজ। ক্ষেত্রবিশেষে আত্মহননের পথও বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে কেউ কেউ। ভিন্ন পেশা আঁকড়ে ধরার ঘটনাতো আকচার ঘটছে। যদিও সেই পরিবর্তিত পেশাগুলো অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারছে, এ কথা বলা যাচ্ছেনা। বরং অনেকেরই ঘটি-বাটি চাঁটি হয়ে যাচ্ছে অনভিজ্ঞতার কারনে।
এই আবহে আলোচনা গুটিয়ে এনে যদি আমাদের পশ্চিমবঙ্গের নাট্য সংস্কৃতির আঙিনায় প্রবেশ করি, তাহলে ছবিটা আর একটু স্পষ্ট হবে। থিয়েটার হলগুলোতো বন্ধ। ফলে মেইন স্ট্রিম থিয়েটার চর্চ্চাও বন্ধ। করোনাকালের প্রথম দিকে অনেকেই ডিজিটাল থিয়েটারের প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা ফলপ্রসূ হয়নি। দর্শক মোবাইল কিংবা টিভি পর্দায় পয়সা দিয়ে থিয়েটার দেখতে রাজি হয়নি। তাঁরা ওটিটিতে সিনেমা দেখছেন চুটিয়ে, কিন্তু নাটকের বেলায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সঙ্গত কারনেই। থিয়েটারের যাঁরা এ বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগী হয়েছিলেন, তাঁরা বিশ্ব অঙ্গনে এই চর্চ্চার উদাহরণ টানলেও, চিঁড়ে ভেজেনি। ফলে ডিজিটাল থিয়েটারের ধারনা মান্যতা পায়নি আমাদের রাজ্যে, এমনকি এদেশের কোথাওই নয়।
এখানেই আর একটি প্রশ্ন উঠে এসেছে নতুন করে। মেইন স্ট্রিম থিয়েটারের ধারনা কি পাল্টাবে এবার? প্রসেনিয়াম মঞ্চের পাশাপাশি এতদিন ধরে রাজ্য জুড়ে যে অন্য আঙ্গিকের থিয়েটারগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলছে, এবার কি তারাই সামনের সাড়িতে চলে আসবে?
করোনা আরও কিছুকাল থাকলে ( মনে হয় থাকবেও) সেটাই হয়তো ভবিতব্য হতে চলেছে আমাদের থিয়েটারের। প্রসেনিয়ামের চাপে অন্য আঙ্গিকের থিয়েটারগুলো এতদিন সেভাবে প্রচার আলোতো পায়ইনি, ক্ষেত্রবিশেষে গড়পরতায় পেছনের সাড়িতে চলে গেছে ব্যবস্থার শিকার হয়ে। এটাযে ইচ্ছাকৃত তেমনটি না বলা গেলেও, আয়েসি শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনচর্যার প্রতিফলন ঘটেছে আমাদের মূল থিয়েটার চর্চ্চায়, এটা বলাই যায়।
এবার সম্ভবত দান ওল্টাতে চলেছে করোনা। কলকাতা সহ শহরতলি এবং জেলা শহরেও বহু স্টুডিও থিয়েটার গড়ে উঠেছে ইতমধ্যে। সেখানে অন্তরঙ্গ থিয়েটারের চর্চ্চাও শুরু করেছে অনেক দল। নামি-দামিরা এখনও এ অভ্যাস শুরু না করলেও, আগামীতে করোনার দাপট জারি থাকলে, তাঁরাও সামিল হতে বাধ্য হবেন। এই অন্তরঙ্গ আঙ্গিক ছাড়াও মুক্তমঞ্চ-পার্ক- ভগ্নপ্রাপ্ত জমিদার বাড়ি – নদীর ধার ইত্যাদি অঞ্চল নিয়েও নতুন করে প্রচেষ্টা নিচ্ছে বহু থিয়েটার দল। যাঁরা এখনও হল খোলার আশায় অপেক্ষা করছেন, তাঁদের ধৈর্যও প্রায় শেষ। “কতদিন নাটক না করে থাকা যায়”। অর্থ,প্রচারের বাইরেওতো প্যাশন বলে বস্তুটা হাঁপিয়ে উঠেছে।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে নাটকের নেপথ্যকর্মীরা, যাঁরা মূলত কলকাতা শহরে নাটক সূত্রেই জীবিকা নির্বাহ করেন, তাঁরা খুবই বিপদগ্রস্থ। অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থার মধ্যেই টিঁকে আছেন তাঁরা। অথবা গত বছর দশেক যাবত যে সমস্ত ফ্রিল্যান্সার অভিনেতৃবর্গ, যাঁরা নানা দলে ঘুরে ঘুরে অভিনয় করে পেশাদারিত্ব বেছে নিয়েছেন, তাঁরাও প্রচন্ড মুস্কিলে পড়েছেন, বলাই বাহুল্য। এখন যদি করোনার কারনে ক্রমেই সময়সীমা বাড়তে থাকে,তাহলে তাঁদেরও বিকল্প কিছু ভাবতেই হবে। বেসরকারী সহযোগিতায় কতদিন চলতে পারে? বিশেষত, সরকারও সেভাবে এগিয়ে এসে এঁদের পাশে দাঁড়ায়নি,না কেন্দ্র না রাজ্য।
পৃথিবীর ইতিহাসে ভাইরাসের চলন নিয়ে যে তথ্য মজুদ আছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে,মোটামুটি পাঁচ/সাত বছরের আগে কোন ভাইরাসেরই সুরাহা হয়নি। আমার ধারনা এবার করোনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবেনা। ফলে সেটা ধরে এগোলেই থিয়েটার উপকৃত হবে।
আগামীতে হল গুলো খুলে গেলেও কতজন বড় মাপের থিয়েটার নির্মাণ করবেন তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে। যত ভাল নাটকই হোক না কেন, বন্ধ ঘরে নাটক দেখার ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে অনেকের মনেই। বিশেষত যাঁদের বাড়িতে করোনা-মৃত্যু হানা দিয়েছে, তাঁরাতো বটেই। আমার ধারনা কোন দলই তাই বড় লগ্নির ঝুঁকি নেবেনা। আবার দর্শক-টানা নাটক করতে হলে নামি-দামি অভিনেতা,ঝাঁ চকচকে সেট, কিছু চমক ছাড়া চলেনা। তাছাড়া নেপথ্য কর্মী এবং ফ্রিল্যান্সারদেরও বাঁচানোর দায় আছে। এতসব ভাবনা-চিন্তা নিয়ে কলকাতার থিয়েটার কোনদিকে এগোবে সময়ের আগে তা অনুমান করা সত্যিই দুরূহ। যদিও কলকাতার সব দলই যে এসবের আওতায়, তেমনটা নয়। এমন বহু দলই আছে যাঁরা অবস্থা অনুযায়ী চলন পাল্টাবে। হলই তাঁদের থিয়েটার করার একমাত্র জায়গা, এমনটা ভাববে না তাঁরা। জেলা শহরের থিয়েটার চর্চ্চার সঙ্গে অনেক মিল পাওয়া যাবে এইসব দলগুলোর।
এবার জেলা শহরের দলগুলো কি ভাবছে তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। সব জেলা শহরেও মূল প্রবণতা প্রসেনিয়াম চর্চ্চা। কিন্তু প্যান্ডেমিক সময়ে ভাবনার বদল ঘটাতে এই দলগুলির তেমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ফলতঃ, করোনর প্রথম ঢেউ-এর পরপরই মঞ্চ থেকে মাঠে-বাটে নেমে আসতে দেখা গেছে বহু দলকেই। মুক্তমঞ্চ-অঙ্গণ-হলঘর কোথাওই নাটক করতে এঁরা পিছপা নয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুবিধা-অসুবিধা এরা আত্মস্থ করতে সময় নেয়না। শিলিগুড়িতে সব নাটকের দল মিলে গত ডিসেম্বর মাস থেকে প্রায় তিন মাস কাল যাবত প্রতি রবিবার স্থানীয় বাঘাযতীন পার্কে নাটক করেছে। দ্বিতীয় ঢেউ এসে থামিয়ে দিয়েছে এঁদের। আবারও প্রশাসনিক ছাড়পত্র পেলে জারি থাকবে এই প্রচেষ্টা।
আমরা জানি, করোনা পৃথিবীর অনেক ক্ষতি করেছে। মৃত্যুর পাশাপাশি সব দেশের অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এত নেতির মধ্যেও কিছু ইতির সন্ধান পাওয়া গেছে। পৃথিবীর মগজে একটা জোর ঝাঁকি দিয়েছে করোনা। ফলে আমরা নতুন করে আবার প্রকৃতি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছি। শুধু নিজে বাঁচা নয় অন্যকে বাঁচানোরও দায় আছে আমার, এই বোধ আবার ঘরে ফিরেছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচের অর্থ খরচ না করে সাধু উদ্যোগে সহযোগিতার কথা ভাবতে পারছি আমরা। নব প্রজন্ম দিনের পর দিন কমিউনিটি কিচেন চালাচ্ছে। দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এসবই আবার ফিরে পেয়েছি আমরা করোনা আবহে। আর তার প্রভাব পড়েছে সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও। বিশেষত, থিয়েটার চর্চ্চায়তো বটেই।
আমরা লক্ষ্য করেছি, বহুদিন থেকেই কলকাতা শহরের থিয়েটার গ্রুপ থিয়েটার চর্চ্চা থেকে সড়ে গেছে। কোম্পানি থিয়েটার-কর্পোরেট থিয়েটার-বিনোদন থিয়েটারে মজেছে কলকাতা। সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি নেপথ্যে চলে গেছে। এক ধরনের পেশাদারিত্বর কথা এখন কলকাতার থিয়েটারের বিশেষত্ব। মানুষ-সমাজ-দেশ বা অত্যাচারিত জনগন- রাস্ট্রীয় নিপীড়ন- মানুষের লড়াই, এগুলো বিষয় হিসাবে আর তেমন কল্কে পায়না। আজ করোনা এসে এসব নিয়ে আবার ভাবতে বলছে আমাদের। বিনোদনকে সঙ্গে নিয়ে এই বিষয়গুলো যদি আবার না ভেসে ওঠে কলকাতার থিয়েটার চর্চ্চায় তাহলে সবকিছুই মূল্যহীন হয়ে পড়বে। পূর্বসুরিদের নিরলস চর্চ্চা, তাঁদের আত্মত্যাগ, দায়বদ্ধতা অস্বীকার করে যেদিকে চলেছে থিয়েটার তার ভবিষ্যৎ যে উজ্জ্বল হবেনা, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। অবশ্য জানা নেই, এ কথাগুলো আদৌ ভাবা হবে কিনা?
জেলা-থিয়েটারে এখনও কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের ধারা বহাল আছে তা সে যতই জৌলুসহীন হোক না কেন,একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাই দলগুলোর প্রায় সবাই একমত যে, আগামী নাটক এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে যে কোন পরিসরে তা উপস্থাপিত করা যায়। আলো-মঞ্চ এসব সহযোগে বা না রেখেও নাটক করা যাবে সামান্য অদল বদল করে। ইমপ্রোভাইজেশনের প্র্যাকটিস রপ্ত করতে হবে। আর সর্বশেষ কথা, খরচ রাখতে হবে আয়ত্বের মধ্যে। নাটক লেখা এবং অভিনয়, মূল জোর থাকবে এই দুই বিষয়ে। আগামী থিয়েটার হয়তো গড়ে উঠবে নব আঙ্গিকে,নব সাজে। থিয়েটার হবে হলে-মাঠে-বাটে-আঙিনায়। সব থিয়েটার মিলেই হবে মেইন স্ট্রিম থিয়েটার,কেবল প্রসেনিয়ামকেই গুরুত্ব নয়।
পরিশেষে বলি, লোকনাট্য’র চর্চ্চাও চলে আসবে সমগ্র থিয়েটার চর্চ্চায়। রবীন্দ্রনাথের প্রাচ্য-থিয়েটার ধারনার নির্মাণে হয়তো কাজ শুরু হবে করোনা পরবর্তী থিয়েটার চর্চ্চায়। বলাই যায়, নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হল আজকের থিয়েটারের কাছে। ফসল কতটা তোলা যাবে সেটাই দেখার এখন।।
…………………………পার্থ চৌধুরী