ডাক্তারবাবু বললেন,
“এমনি সব ঠিকই আছে,বেবির ওয়েটটা একটু কম আছে l এখনও হাতে তিনমাস আছে, সামান্য ওষুধ দিলেই ঠিক হয়ে যায় এটা l কিন্তু আমি চাইছি না দিতে l আচ্ছা, এখন তো আমের মরশুম, তাই না…?”
পরের দৃশ্যকল্প –
ঝুড়ি ভর্তি আম চলে এলো সুদূর ডায়মন্ড হারবার থেকে l
বন্ধুর নিজের আমবাগানের l এই শহরে নির্ভেজাল ও চরিত্রবান আম পাওয়া দুষ্কর l
স্বামী নিজে হাতে আম ছুলে নিয়ে তারপরে কেটে পরিপাটি করে বাটিতে সাজিয়ে নিয়ে
আসছেন,আর গর্ভধারিণী গপাগপ সেগুলি খাচ্ছেন l প্রথম সন্তানটি সিস্টের জন্য নষ্ট হয়ে গেছিলো l
এবারে তাই সাংঘাতিক সব সতর্ক আয়োজন l ডাক্তার পরিবর্তন, অতএব সেই সাথে হলো চিকিৎসার পরিবর্তন l খবর পেয়ে খুঁজে খুঁজে শিয়ালদার এক এঁদো গলিতে গিয়ে ডক্টর কোনারকে পেলেন l
বুড়ো থুত্থুরে, দেখলে মনে হয়, উনিই রুগী l কিন্তু,মাউথ রেকমেন্ডেশন বলে কথা, তাও আবার শালীর!
স্পর্শ বড় সাংঘাতিক জিনিস! দু’বার পেট টিপে দেখলেন জাস্ট l পেট অর্ধেক খোলা, বিরাট একটা কুমড়োর মতো, ভিতরে কী ভাবে যে বাচ্চা থাকে মেয়েদের!
গর্ভধারিণী বললেন, “ডাক্তারবাবু, কুলু মানালির টিকিট অনেক আগে কেটেছিলাম, বুঝতে পারিনি তখন। এই অবস্থায় কি যাওয়া উচিত ?”
-হ্যাঁ যাও , অবশ্যই যাওয়া যায়। আগেকার মায়েরা সব কাজ বজায় রেখেই সন্তানের জন্ম দিতেন স্বাভাবিক ভাবে l পাহাড়ের মায়েরাও গর্ভবতী হন, তাঁদেরও চড়াই উৎরাই সামলাতে হয় l নিশ্চয় যাবে তোমরা, যাও ঘুরে এসো, বাচ্চাও ঘুরুক l
পেটে হাত রেখে আবার ডাক্তারবাবু বললেন, “ভিতরে যে মানুষটি আছে,দুর্ভেদ্য এক দুর্গের মধ্যে সে আছে, আর তোমার দুর্গ ওই তোমার স্বামী।সঙ্গে সঙ্গে পা মিলিয়ে যাও, ঘুরে এসো l”
পরের দৃশ্যকল্প –
“বুঝলে মা বাবারা , আগে বলেছিলাম কি তোমাদের , স্বামী স্ত্রীর মিলনে যে কামনা, সেখানেও অপূর্ব ত্যাগ থাকে! আবার সেখানে ভোগও পুণ্যের l অলীক উত্তেজনার খেলা ভুলে মিলনের মুহূর্তে অসীম স্পর্শের পূজা চলে তখন l দুই মন,দুই দেহ প্রবাহিত হয় এক সমুদ্রের দিকে তখন l এটা ভাবনার অভ্যাস ছাড়া আর কিছুই না, এগুলিই সুশিক্ষার প্রয়োগ সংসারজীবনে l কবি তাই বলেছেন, ‘মধুর বসন্ত এসেছে, মধুর মিলন ঘটাতে’। স্বামীস্ত্রীর সংসারের মতো বাঁধন আর কী আছে ! দেহ হলো ফুলদানী, বুঝলে, আর সেই দেহের ফুলদানীর উপর ফুলের সেজে ওঠা l মানুষকে তাই ফুলের মতো নির্মল হতে হবে, ফুলের মতো মন হতে হবে l ”
একজন সাধু এসেছিলেন বাড়িতে, কত শত কথা তার এরকম!
পাড়ার বুড়ো বুড়ি সব এসে হাজির l এরা স্বামীস্ত্রী দু’জনেই ছিলেন l এখনও স্বামীর মনে পড়ে যায় হঠাৎ করে সেই সাধুর কথlগুলো l
সেদিন অবাক এক কাণ্ড, বাচ্চা নাকি নড়ছে না!
-হ্যাঁ গো, সেই তিনটের সময় একবার লাথি মেরেছিলো, জানো, এখন রাত ন’টা বাজতে চললো, একটু হাত দিয়ে দেখো না গো।
ধড়াস করে উঠলো স্বামীর বুক l শাড়ী সরিয়ে হাত বোলায় একবার, এদিক ওদিক টেপে।নাহ, তাতেও হলো না, কান পাতলো এবার পেটে l
-একি গো, কান দিয়ে কী শুনবে?
-বেশি কথা বোলো না, চুপ থাকো।
গুড় গুড় আওয়াজ, তার মানেই সব ঠিক আছে, স্বামী ভাবলো এসব l
-এই তো আওয়াজ হচ্ছে, গুড় গুড়।
-আরে ধুর, ওটা তো গ্যাসের আওয়াজ হবে l এই চলো চলো, আমার ভয় লাগছে গো, হাসপাতাল চলো, ডপলার টেষ্ট করিয়ে আসি l
সেই রাত্রেই ছুট দু’জনে l কত চিন্তা মনে, খারাপ চিন্তা, ঈশ্বর ডাকা তখন l যেতে যেতে স্বামী বলছে,
“হ্যাঁ গো, নড়ছে? নড়ছে কি, বুঝতে পারছো?”
-আরে নড়লে তো বলতাম , কী একটা রিক্সা বাবা! উফ্,আমারই সারা শরীর নড়ছে ঝাঁকুনিতে, বুঝবো কী করে ?
স্বামী তার বাম হাত দিয়ে স্ত্রীর বাম বাহু শক্ত করে জড়িয়ে বললো, “এই ভাই,একটু আস্তে চালাও ভাই, পেটে বাচ্চা আছে l ”
-কীগো তুমি, এভাবে কেউ বলে, পেটে বাচ্চা আছে!
-কী বলবো, প্রেগন্যান্ট? না যদি বোঝে ?
-ওটা সবাই বোঝে।
গাড়ি চললো গড়গড়িয়ে l
পরের দৃশ্যকল্প –
-সিস্টার, বাচ্চা নড়ছে না সেই দুপুর থেকে।
-এদিকে এদিকে আসুন, আমার কাছে আসুন l
পেটে কী একটা ঠেকালো !
স্ত্রী বিস্ময়ে বললো, “নড়েছে, নড়েছে সিস্টার l”
-খুব দুষ্টু বাচ্চা এটা, আপনাদের দু’জনকে সঙ্গে করে নিয়ে একটু ঘুরু ঘুরু করে নিলো।এরম হয় কখনও কখনও, চিন্তার কিছু নেই l
‘প্রাণের জন্ম বড় সাংঘাতিক l পশু,পাখি মানুষ সেখানে সবাই সমান l কারোর হাতে কিচ্ছু নেই, শুধু ধারণ করা আর বাইরে থেকে সযত্নে লালন করা।পুরুষের গহীন মনের মধ্যেও যেন গর্ভ সঞ্চারিত হয়, সেখানেও সন্তান যেন অহরহ নড়াচড়া করে, ধীরে ধীরে শুভ সেই জন্মের জন্য বড় হয়ে ওঠে ‘l ভাবছিলো স্বামী কতকিছু এসব রিকশায় বসে l
পরের দৃশ্যকল্প –
-কী করেছেন মশায়! তাজ্জব l আম খাইয়েছেন নিশ্চয়!
এই তো অ্যানোমালি স্ক্যানে সুন্দর হিসেব পূর্ণ শরীরের l একদম ঠিকঠাক l
বুকের পাথর সরে গেলো যেন দু’জনেরই l অনেক পথ বাকি l জিতলো তারা আজ l নিশ্চিন্ত এই মুহূর্ত বড় অপূর্ব! ডাক্তার বললেন ” কোথা থেকে করাচ্ছেন ডেলিভারি? ”
সব শোনার পর ডাক্তারবাবু বললেন, “সেদিন আমায় জানাবেন l অনেকেই জানাতে ভুলে যান,দোষ দিই না।আসলে বাবা মা হবার পর আর হুঁশ থাকে না কারোরই l বয়স হয়েছে তো, নিজে আর অপারেশন করি না,নইলে আমারই হাতেই হতো,জানতে পারতাম l ”
ডাক্তারবাবুকে শেষ বারের মতো নমস্কার করে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো স্বামীস্ত্রী l
শেষ দৃশ্য –
স্ত্রীকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে গেল দু’জন l দুপুর একটা বাজে l স্ত্রীর ছোটবেলার দুই বন্ধু এসেছে l আলাপ এই প্রথম l অনেক কথা l স্ত্রীর সাথে তাদের গভীর বন্ধুত্বের যত গল্প l স্বামী শুনছে, সে নাকি আগের মতোই পাগলী আছে,সেই প্রমান তো বন্ধুদেরই কাছেই একমাত্র থাকে l স্ত্রীর প্রশংসা শোনার অপূর্ব নিখুঁত জায়গা হলো ছোট্ট বেলার বন্ধুদের সঙ্গ l সেখানে আসল মানুষটিকে জানতে পাওয়া যায় l সংসারে থেকেও যাকে জেনে ওঠা যায় না l
ঠিক একটা পঁয়ত্রিশ l চোখের সামনে জগতের একি এক অপরূপ দরজা খুলে গেলো আচমকা ! প্রবল কান্নার আওয়াজ, সেই খোলা দরজার সামনে একজন সিস্টারের কোলে একটি কার বাচ্চা ! হ্যাঁ হ্যাঁ, তার নাম ধরেই তো ডাকলো সিস্টার ! কাছে এগিয়ে গেলো স্বামীটি l
-আপনিই তো ?
-হ্যাঁ হ্যাঁ আমি।
নার্স, শিশুটির তোয়ালেটা সরিয়ে বললো,
-এই দিকে তাকিয়ে দেখুন, ভালো করে তাকিয়ে বলুন, ছেলে ? না মেয়ে ?
-মেয়ে, মেয়ে…।
দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো ধপাস করে l
তোয়ালে মোড়া বিদ্যুতের চমকের মতো কোথায় হারিয়ে গেলো তার মেয়ে ! আর সেই প্রথম কান্নার আওয়াজ !
পৃথিবীর চতুর্দিক থেকে যেন এক শব্দের ধ্বনি ছুটে এলো একমাত্র তারই কানে l
পিতা ! পিতা! পিতা !