জয়ের ঠিকানা

” রেণু, এ্যই রেণু, এখনো ঘুমাচ্ছিস, ওঠ মা, সকাল হয়ে গেছে ।”
মায়ের জোরালো কণ্ঠস্বরে গাঢ় ঘুম পাতলা হয়ে গিয়েছিল। ধড়মড় করে রাতের অবিন্যস্ত শয্যার উপর উঠে বসে আলস্য জড়ানো চোখ দুটিকে দু হাত দিয়ে কচলাতে কচলাতে মায়ের দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়েছিল  সেদিনের সেই চার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে রেণু ওরফে আজকের সাহিত্যিক রেণুবালা দেবী ।
– ” কি রে, কি হয়েছে তোর? এত ভয় পেয়েছিস কেন?
স্বপ্ন দেখেছিস?” মা ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সেই থেকে জীবনের এতখানি পথ পেরিয়ে অপরাহ্নের আলোয় বসে শৈশবের রেণু, আজকের সত্তর উত্তীর্ণা রেণুবালা দেবী, লিখে চলেছেন তার জীবনের এক অলৌকিক অনুভুতির কথা। এক বিচিত্র রহস্যের কথা,
যে রহস্য একটা বিরাট প্রশ্ন তুলে তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের অনেকগুলি দিনকে অসহনীয়, দুর্বিসহ করে তুলেছিল। কি একটা অজানা ভয় তাকে সব সময় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। জীবনকে হারাবার ভয়, আরও অনেক রকমারি ভয়, খুব ছোটবেলা থেকেই তার মনকে
প্রতিনিয়ত আকুল করে রাখত। এমনিতেই সে একটু ক্ষীনজীবী এবং রুগ্ন ছিল। তার এই অহেতুক ভয়ের জন্য পরিবারের সকলের কাছে তাকে অনেক গঞ্জনা সইতে হয়েছে।
— ” তুই এত ভিতু হলি কোথা থেকে? তোর মন এত দুর্বল কেন? একটু অসুস্থ হলেই এত ঘাবড়ে যাস কেন?”
বাবা, মা, জ্যাঠা, জ্যেঠিমা, ঠাকুরমা, কার কাছ থেকে না শুনতে হয়েছে তাকে একই কথা  — ” সব তোর মনের অসুখ, মনে জোর আনতে শেখ”। খুব ছোটবেলায় সে অনেক কথা বুঝত না। মাঝে মাঝেই একটা একই রকমের দুঃস্বপ্ন তার গভীর ঘুমের মধ্যে এসে তাকে নাড়া দিয়ে যেত। শৈশব, কৈশোর এমন কি যৌবনের অনেকগুলি দিন পর্যন্ত সে ঐ একই স্বপ্ন বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে —  যেন একটা ঘন গভীর জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছে, নিজের বাড়িটা কোথায় হারিয়ে গেছে, খুঁজে পাচ্ছেনা,… নিদারুণ  আতঙ্কে দিশা হারিয়ে একটা মৃত্যু ভয় এসে তাকে কোনঠাসা করে দিচ্ছে। এছাড়াও, কখনও সামান্য অসুস্থ হলেও সে ঘাবড়াত, এই বুঝি তার জীবন থেকে সে কোথাও হারিয়ে যাবে। কিন্তু কেন? কেন?? পরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে নানা জ্ঞানার্জনের মধ্যে দিয়ে তার মনে হতো এর সঙ্গে কি তার পূর্ব জন্মের কোন সম্পর্ক  আছে?
কিন্তু তাহলেই বা, তাতে তার কি দোষ? এ জন্মে কেন সে “এ তোর মনের অসুখ” বলে সকলের কাছ থেকে গঞ্জনা শুনবে? হে ভগবান, ছোট্ট রেণুকে তুমি তার এই অসহনীয় অবস্থা থেকে রক্ষা করো….
রেণুর মনের এই আকুল প্রার্থণা বোধ হয় ঈশ্বরের কানে পৌঁছাল। চিরকালের আবেগপ্রবন মেয়েটা ধীরে ধীরে বড় হতে হতে একসময়  অলৌকিক ভাবে আর একটি নতুন জগতের  সন্ধান পেয়ে গেল। ধরনীর সবুজ শ্যামল সুন্দর প্রকৃতির মাঝে হঠাৎ কোন এক আলোর দেবতা তাকে ডাক দিল। ” জল পড়ে, পাতা নড়ে” নামের কোন এক “ছন্দ – মিলে” র ঈশ্বর, ছোট্ট মেয়েটির হৃদয়ে এসে আসন পেতে বসলেন। “ভয়ঙ্করে”র জায়গায় “সুন্দর” এসে তার স্থান অধিকার করল।
বিশ্বকবির গান, কবিতা, গল্প তার কানে এলেই ছোট্ট মেয়েটি কেমন অবাক হয়ে ভাবতো, ইনি কে, এমন ভাবে মনের কথা বলে দিতে পারেন? আশ্চর্য! এইমাত্র এই কথাগুলিই তো তার মনের মাঝে গুনগুন করছিল? তবে সে কেন তার মনের কথা এমন করে প্রকাশ করতে পারেনা? মনের মধ্যে দুর্বার ইচ্ছা জাগলো, সেও লিখবে। দশ বারো বছরের রেণু হাতে তুলে নিল কাগজ কলম।
যেমন করে কবির রচনায় মনের কথা জীবন্ত হয়ে ওঠে তেমন করে তার কলমও সাড়া দেবে। কবিগুরুই তাকে পথ দেখাবেন। প্রিয় কবির হাত ধরে তার পথ চলা শুরু হলো। শুরু হলো নিদারুণ প্রচেষ্টা। একদিন ঝরঝর করে কলম থেকে বেড়িয়ে এল, বারো বছরের লেখা জীবনের প্রথম কবিতা,…  সাঁঝ আকাশে যখন ধীরে
সূর্য্যি মামা পড়ল হেলে
আবীর রঙ্গে মাখা,
তখন ওগো পাখীগুলি আপন নীড়ে
ফেরার লাগি, মেলে দিল পাখা….
কি এক বিহ্বল আনন্দে, পরম বন্ধু কবিগুরুর হাত ধরে
বালিকার মনে নতুন সৃষ্টি জন্ম নিল। প্রাণের ঠাকুর, আলোর দেবতা, মেয়েটির অশান্ত হৃদয় শান্ত করে দিয়ে, তার জীবনে ছন্দ এনে দিলেন। দিলেন প্রকৃতির মধ্যে অমৃতলোকের সন্ধান। দিলেন সৃষ্টি সুখের উল্লাস!
শুভ শক্তির কাছে অশুভ শক্তির পরাজয় হলো। অলৌকিকের স্পর্শে লৌকিক আতঙ্ক কেটে গেল। ধীরে ধীরে সেই ভয়ঙ্কর স্বপ্ন, গভীর রাতের ঘুমের দেশ থেকে অন্তর্হিত হয়ে তার স্বপ্নে আলোর রোশনাই নিয়ে এলেন বিশ্বকবি, কত বিচিত্র, কত সুন্দর, কত অভাবিত ঐশ্বর্য্যের সম্ভার নিয়ে। আর তারপর??
আজকের সাহিত্যিক রেণুবালা দেবী তার প্রাণের ঠাকুরের লেখা কয়েকটি লাইন নিজের জীবনের দীক্ষা মন্ত্র করে নিয়ে, আজও এগিয়ে চলেছেন –
” ভয় হতে তব অভয় মাঝে
নতুন জনম দাও হে….”