ঘুম

আপনি কি ঘুমিয়েই জাগেন না জেগে ঘুমোন ?
আমাদের ঘুমের অভ্যাস কি কৃত্রিম  ?
ব্যাসদেবের গীতার সাথে আধুনিক মলডোভায় জন্ম নেওয়া বিজ্ঞানী ক্লিটম্যান-এর গোপন সূত্র কি ?
পরীক্ষার আগের রাতে কি রাত জেগে পড়লে ভালো নাকি ঘুমোলে ভালো ?

এসব জটিল প্রশ্ন।

ছাড়ুন তো জটিলতা!
একটা নিপাট সহজ প্রশ্ন করি

আপনার সকাল কিসে মধুর হয় ? ধোঁয়া ওঠা দার্জিলিং-চা এ? নাকি ফ্লুরিজ এর কেক এ?
আমার অবশ্য সকাল ভালো হওয়ার প্রধান কারণ-  আগের রাতের ভালো ঘুম।  শুধু আমার নয় অনেকেরই তাই।
প্রতি রাতে একই রকম ভালো ঘুম যদিও বিলাসিতা।  মেলা ভার। তবুও আশা তো থাকে।
এদিকে ঘুমহীনতার আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান ঘুম ভেঙে যাবার জন্য যথেষ্ট।
গবেষণায় আমরা জানতে পেরেছি পঞ্চাশের পরে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ জন মানুষ ঘুমের সমস্যায় ভোগেন। ষাটের কোঠা পেরোনোর আগেই প্রতি ৩ জনে ১ জন মানুষই মনে করতে থাকেন একা শুলে বোধহয় আরও বেশি ভালো ঘুম হয়। তাই বাড়িতে দোকা থাকলেও ঘুমের প্রত্যাশায় বিছানায় হয়ে যান একা। তাতে আরো ভালো ঘুম হয় কিনা – তা বিতর্কিত।   ভারতে প্রতি ১০ জন
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৯ জন, প্রয়োজনের তুলনায় কম ঘুমোন।  আর ২০ জনে ১ জন ঘুমের অসুখে ভোগেন। তবে মাথায় রাখুন, ভারতের এই তথ্য বিশেষ ঘুম সহায়ক-যন্ত্র বিক্রেতা এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মার্কেট সার্ভেতে পাওয়া- তাই বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নাতীত নয়। তথ্যের সত্যতার চুল চেরা বিচার আমাদের কাছে নেই কিন্তু সমস্যার ব্যাপকতার আভাস মেলে এই পরিসংখ্যানে। এছাড়াও জানতে পেরেছি ভারতীয় উপমহাদেশে মহিলারা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি ঘুমের অভাবে ভোগেন।

ঘুমের অভাব শুধুমাত্র মানুষ ও তার পরিবার নয়, দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের উপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে ঘুম কম হতে থাকলে মানুষের ক্রনিক শারীরিক ও এবং মানসিক সমস্যার সূত্রপাত হতে পারে। ভূরি ভূরি প্রমাণ মেলে যে সঠিক ঘুমের অভাবে কিভাবে ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার, ক্যান্সার, ওবেসিটি বা স্থূলতা এবং হার্টের প্রবলেম বেড়ে চলেছে উত্তরোত্তর। ভালো ভাবে না ঘুমোলে এই অসুখ গুলোর বিরুদ্ধে লড়াই হয়ে যায় আরো কঠিন।  2010 সালে কাপুচ্চিও সাহেবের গবেষণায় আমরা জানতে পারি যে খুব কম ঘুম এবং খুব বেশি ঘুম  দুটোই সমান ক্ষতিকর এবং তা মানুষের মৃত্যুর হার বাড়িয়ে দেয়।

অনুপম -রূপঙ্কর- শ্রেয়ার কথা মতো চলুন আরো ‘গভীরে যাই’

ঠাট্টা করে বলা হয় সবকিছুই বেদ এ আছে । বেদে আছে কিনা তা দেখার সুযোগ না হলেও, গীতা কিন্তু ঘুম নিয়ে বেশ সাবধানী।
গীতার অনুচ্ছেদঃ ৬ শ্লোক ১৬ তে স্পষ্ট দেখতে পাই  যথেষ্ট ঘুম দরকার বনবাসী কঠোর যোগীর জন্যও।  ঘুম কম হলে যোগীর সাফল্যের পথেও আসে বাধা।  পন্ডিতরা ব্যাখ্যা করেছেন যে সঠিক সময়ে না ঘুমোলে ক্লান্তিতে চোখ আর মন বুজে আসতে পারে বিপদজনক সময়ে।  ফল মারাত্মক।  তবে সেই গীতাতেই উল্লেখ পাই (অনুচ্ছেদঃ ১৮ শ্লোক ৩৯) আলস্যের ঘুম- যে ঘুম নেশাতুর সেই ঘুম কিন্তু খাঁটি ঘুম নয়।
প্রতিধ্বনি পাই কালিদাসের কুমারসম্ভবমেও।  কালিদাস লিখেছেন শরীর ও মন মানবধর্ম রক্ষার অন্যতম অস্ত্র।  আর ঘুমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে শরীর ও মন -দুই-ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আমি গীতা জানি না। খাঁটি কুমারসম্ভবম পড়ার সুযোগও হয়নি।  এসব জীবনের বাঁকে পাওয়া নানা সিধুজ্যাঠাদের কাছ থেকে শোনা।

যদিও আমরা জীবনের অনেকটা সময় ঘুমিয়েই কাটাই তবুও ঘুম নিয়ে খুব বেশি আধুনিক গবেষণা এখনো পর্যন্ত হয়নি। যেটুকু হয়েছে তাতেই ‘থ’ হয়ে যাচ্ছি।  ঘুমের সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক উল্লেখ পাওয়া যায় এরিস্টটলের লেখনীতে।  উনি  ঘুম-কে জীবনের পুনর্নবীকরণ এর উপায় বলে বাতলে ছিলেন। তারপর শতকের পর শতক কেটে গেছে । ঘুম নিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে বিজ্ঞান।
1920 র আগে পর্যন্ত আমরা ঘুমকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলেছি ঘুম কর্মনাশা। ঘুমের সময় মানুষের মন নিস্তেজ হয়ে থাকে। বলেছি ঘুমন্ত মানুষ নিস্কর্মের ঢেঁকি। শেষে এই বিজ্ঞানের-ই ঘুম ভাঙলো 1920 সাল নাগাদ। মানুষ অবাক হয়ে জানতে শিখলো ঘুম অত্যাবশ্যকীয়। মানে ঘুম মোটেই ঘুমিয়ে থাকার সময় নয়। ঘুমিয়ে, মানুষ আসলে থাকে জেগে।
সারাদিন কাজ করে হাত-পা- মুখ। আর ঘুমের সময় সারা রাত ধরে জেগে জেগে আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের ঘর-গেরস্থালি গুছিয়ে দেয়। আশ্চর্য !

তাই গভীরে যাও, আরো গভীরে যাও….
ব্যাপারটা  ঠিক কী ? মানব শরীরে হালকা বিদ্যুৎ খেলছে সারাক্ষন।  এর মধ্যে হৃৎপিণ্ড আর মস্তিষ্কের বিদ্যুৎক্ষরণের গতিপ্রকৃতির জ্ঞান আমাদের জীবন রক্ষার কাজে খুবই কাজে আসে।  আমাদের হার্টের কাজকর্ম ঠিক হচ্ছে কিনা জানার জন্য আছে  ECG আর মস্তিষ্কের কাজকর্মের চাপ মাপার জন্য আছে ইলেক্ট্রো এনসেফালোগ্রাফি বা EEG । এই যন্ত্র মাথায় লাগিয়ে আমরা দেখতে শুরু করলাম মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালী। জেগে থাকার সময় বা উত্তেজিত হলে মস্তিষ্কের বিদ্যুৎক্ষরণ বা ইলেকট্রিক্যাল অ্যাক্টিভিটি যায় বেড়ে। সেটা না হয় প্রত্যাশিত। কিন্তু ঘুমন্তমানুষের EEG করে বিজ্ঞানীদের রাতের ঘুম উড়ে যাওয়ার জোগাড়। তাহলে কি মেশিন ভুল? কিন্তু না। জানা গেল ঘুমিয়ে থাকার সময়ও আমাদের মস্তিষ্ক কাজ করে যায় পুরো দমে। কিছু কিছু সময় রাতের মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালী, দিনের কিছু সময়ের থেকেও অনেক গুণ বেশি।

বেশ তাজ্জব ব্যাপার তাইনা?

মলডোভায় জন্মানো ‘পাগল’ বিজ্ঞানী ক্লিটম্যান আর তাঁর ‘ততোধিক পাগল’ আমেরিকান ছাত্র ইউজিন আসরিস্কি রাতের পর রাত  না ঘুমিয়ে ঘুমন্ত মানুষের ঘুম নিয়ে কাটাছেঁড়া করতেন। 1930 সাল নাগাদ  ডক্টর ন্যাথানিয়েল ক্লিটম্যান ঘুম আর জাগরণর মধ্যে যে ছন্দ আছে সেই ব্যাপারে আমাদের আলোকিত করেন ।  জানতে পারলাম এই ছন্দ বিগড়ে গেলে বা ঠিকঠাক ঘুমের অভাবে মানুষের শরীরের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় বাঁধা পরে।  মনের সতর্কতা ভোঁতা হয়ে যায়। দুঃখজনক ভাবে ইউজিন মারা যান এক মর্মান্তিক পথদুর্ঘটনায়। রাত-দিন পরিশ্রমে ক্লান্ত ইউজিন চালকের আসনে বসে চলন্ত গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

ক্লিটম্যান-ইউজিনের  ঘুম নিয়ে গবেষণার বছর দশেক পরে সুইস গবেষক ওয়াল্টার হেস খোঁজ পান যে মস্তিষ্কের একদম গর্ভগৃহে থ্যালামাস বলে একটা ছোট্ট অঙ্গ আমাদের ঘুম আর জেগে থাকার মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে। এরও এক দশক বাদে 1950 সালে বিজ্ঞানী ক্র্যামার আর হফম্যান  আমাদের সামনে তুলে আনলেন মানব শরীরের এক অদৃশ্য ঘড়ির কথা। নাম হল তার
‘সার্কাডিয়ান ঘড়ি’ (ল্যাটিন ভাষায় Circa  মানে আনুমানিক , Diem মানে দিন )। বৈজ্ঞানিক জগতে তোলপাড় পড়ে যাওয়া এই গবেষণায় আমরা জানতে পারলাম যে দেয়ালে ঘড়ি না থাকলেও কিভাবে আমাদের শরীর ও মন একটা নির্দিষ্ট ছন্দে চলে আসছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী। দেয়ালে টানানো ঘড়ির কাঁটা আমাদের দুজোড়া চোখের সামনে না থাকলেও, ঠিক একটা সময় অন্তর আমাদের ঘুম পেয়ে যায়।  একটা সময় অন্তর আমাদের খিদে পায়। আমাদের শরীরের হরমোন গুলোর ও নানারকম আবর্ত চলতে থাকে এই অদৃশ্য ঘড়ির প্রভাবে। মাসে মাসে মহিলাদের ঋতুচক্র পর্যন্ত চলতে থাকে এই ঘড়িতে ভর করে।

যদিও বিজ্ঞান প্রথমে এই ঘড়ির কথা বিশ্বাস করতে চায়নি। পরবর্তী পনেরো কুড়ি বছর ধরে ফরাসি এবং জার্মান বিজ্ঞানীরা ভূগর্ভের অভ্যন্তরে নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে মানুষকে নিয়ে গিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করে শেষে এই ঘুম-ঘড়ি কে মান্যতা দেন। এই ঘুম ঘড়ির অমোঘ নির্দেশে চলে আমাদের শরীর-মন।  বাড়ির দেওয়াল ঘড়ির কাঁটা ভুল থাকলে দৈনন্দিন কাজ কর্মের ব্যাঘাত ঘটে।  ঠিক তেমন-ই, আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যের জৈবিক ঘড়িকে অনিয়মিত করে তুললে শারীরবৃত্তিয় কার্যপ্রণালী বিভ্রান্ত হয়ে ধ্বংস করে আমাদের স্বাস্থ্য।
এখানেই শেষ নয়। ঘুম নিয়ে চাঞ্চল্যকর আরও তথ্য পাওয়া গেলো EEG পরীক্ষা নিরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে।  শুনবেন সেকথা ? ধৈর্য ধরতে হবে কারণ এ এক জটিল আঙ্গিক।

গবেষণা লব্ধ EEGর রেখা খুঁজে খুঁজে ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্কের কার্য-প্রণালীকে    মোটের উপর দু’ভাগে ভাগ করে ফেলা হলো। একটা হল  REM  ঘুম আর আরেকটা হলো non-REM ঘুম। একটা non-REM আর একটা REM ঘুম মিলে হয় একটা স্লিপ-সাইকেল বা ঘুম-আবর্ত।  ধরে নিন এটা ঘুমের এক-একটা শিফট। একটা ঘুম-আবর্ত ১ থেকে ২ ঘন্টা চলে।  আর কয়েকটা ঘুম আবর্ত নিয়ে আমাদের পুরো রাতের ঘুম।

ঘুমটা শুরু হয় non-REM স্লিপ প্যাটার্ন  বা non-REM ঘুম দিয়ে।  এই non-REM (non-Rapid Eye Movement) ধরনের ঘুমেরও তিন রকমের ভাগ রয়েছে। একেকরকম ভাগে মস্তিষ্কের তড়িৎ ক্ষরণ একেক রকম হয়। এই সময়ে ঘুমের মধ্যে কখনও কখনও আমরা প্রলাপ বকি বা দাঁত কিড়মিড় করি।  কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারো বিছানাও ভিজে যায়।
এরপরেই আসে REM (Rapid Eye Movement) ঘুম। এইরম ঘুমে আমাদের বন্ধ চোখের মনি গোল গোল করে ঘুরতে থাকে- আমরা দেখি স্বপ্ন। হাত পায়ের মাংসপেশি হয়ে যায় একদম নিস্তেজ । যাতে আমরা স্বপ্ন দেখে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করতে না শুরু করি।

ঘুমন্ত মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল অ্যাক্টিভিটির ছন্দ কে যদি আমরা দামামা বাজানো বা ড্রাম বাজানোর সঙ্গে তুলনা করি তাহলে দেখতে পাব যে কিছু সময় মস্তিষ্কের সব অংশ খুব সমবেতভাবে ড্রাম বাজিয়ে চলে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সময় এই ড্রামের আওয়াজ খুব দ্রুত ছন্দে চলে। আর তার পর স্বল্প কয়েক মিনিট এই ড্রামের আওয়াজ চলতে থাকে একদম দৃঢ় কিন্তু ধীর লয়ে। শুধু এই সময়টায় আমাদের স্মৃতি শক্তি হয়ে ওঠে প্রখর। তারপরেই আবার দ্রুতলয়ে ড্রামের আওয়াজ ফিরে আসে।

কিন্তু কিভাবে স্মৃতি প্রখর হয় ?
বোঝার সুবিধার জন্য ধরে নেওয়া যাক আমাদের মাথার তথ্যগুলো একটা বইয়ের লাইব্রেরীর মতো। অতীত স্মৃতিগুলো বইয়ের আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো। নতুন স্মৃতিগুলো দরজার কাছে বসে থাকা লাইব্রেরিয়ান এর সামনের টেবিলে এলোমেলোভাবে রাখা। আমাদের লাইব্রেরির নিয়ম যে সঠিক সময়ে যদি এই এলোমেলোভাবে রাখা বইগুলো বইয়ের তাকে না ওঠে তাহলে পরের দিন হাউসকিপিং স্টাফ এসে এগুলো কে আবর্জনা ভেবে ফেলে দেবে। এদিকে আমাদের লাইব্রেরিয়ান শুধুমাত্র কাজ করতে পারেন যখন ড্রামের আওয়াজ খুব ধীর শান্ত গতিতে চলে। ড্রামের আওয়াজ যতক্ষণ ধরে শান্ত ধীর হবে তত বেশি বই সাজাতে পারবেন আমাদের গ্রন্থাগারিক।  অক্লান্ত পরিশ্রম আর পাগলের মতো বই সাজানো চলতে থাকে আমাদের মস্তিষ্কে – ঠিক যখন আমরা ভাবি – আমরা বোধয় ‘ঘুমিয়ে’।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে ঘুমের মধ্যে একটা খুব ছোট কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের তাৎক্ষণিক দৈনন্দিন স্মৃতিগুলো অতীত স্মৃতির সাজানো তাকে যাওয়ার সুযোগ পায়। ঘুম কম হলে বা স্ট্রেস থাকলে এই ধীরলয়ে দামামা বাজানোর যে প্রক্রিয়া (slow beat sleep) সেটা বন্ধ হয়ে যায় বা আরো সংক্ষেপ হয়ে যায়। তাই আমাদের নতুন তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা হয়ে যায় অকেজো। বুঝতেই পারছেন যে পরীক্ষার সময় যথেষ্ট ঘুম দরকার। না ঘুমিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলে স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।
এখানেই শেষ নয়।  আমাদের মস্তিস্ক (ব্রেইন ) ও পিঠের স্নায়ুকলা ( সুষুম্না কান্ড বা স্পাইনাল কর্ড ) একধরণের রস বা সেরিব্রো-স্পাইনাল ফ্লুইড এর মধ্যেই ভাসতে থাকে। এই স্লো বিট ঘুমে স্নায়ুকোষ এই সেরিব্রো-স্পাইনাল ফ্লুইডে ভালোভাবে স্নান করে নেয় যাতে মস্তিষ্ক এবং সুষুম্না কান্ডের মধ্যে জমে থাকা নানারকম ক্ষতিকারক রাসায়নিক বেরিয়ে চলে যায় আর আমাদের মস্তিস্ক হতে পারে শুদ্ধ। কি সাঙ্ঘাতিক !

আবার জানা গেছে কিছু কিছু স্নায়ুরোগে যেমন ডিমেনশিয়া বা অ্যালজাইমারস ধরনের সমস্যায় লাইব্রেরিয়ানের কাজ করা এতটা সংক্ষেপ হয়ে যায় যে নতুন বই গুলো আর তাকে উঠতেই পারে না বরং পুরনো বইগুলো আস্তে আস্তে লাইব্রেরি থেকে হাওয়া হয়ে যায়। অল্প পুরোনো বইগুলো আগে দ্রুত মিলিয়ে যায় আর অনেক পুরোনো বইগুলো থুড়ি স্মৃতি গুলো তাও কিছুদিন থাকে।  তাই কিছু কিছু স্নায়ুরোগে দেখা যায় যে সেই মানুষের আশ্চর্যজনকভাবে সুদূর অতীতের যেমন ছোটবেলাকার কথা মনে থাকলেও,  যে ঘটনা সদ্য হয়েছে সেই তথ্য অনেক সময় তার মনেই  থাকেনা।

গবেষণা আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে কম ঘুমোলে ব্লাড প্রেসারের সমস্যা, স্ট্রেস, ডায়াবিটিস থেকে শুরু করে হার্ট ফেইলিওর এর সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে।  বাড়ছে ক্যান্সার। বেড়ে যাচ্ছে মোটা হবার প্রবণতা।  লন্ডনের পাতালরেল শিফট এ কাজ করা রাতের কর্মীদের ওপর সারি য়ুনিভার্সিটি র তদন্তে জানা যাচ্ছে ঘুমের সময় ওলোটপালোট হয়ে গেলে ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বাড়ছে।  ভণ্ডুল ঘুমের প্রভাব মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যায়।  এমনকি মানুষের আণুবীক্ষণিক কোষস্তরে গিয়ে ক্রোমোসোম / জিনের কার্যক্ষমতা (gene expression ) চৌপাট করে দিতে পারে ঘুমের অভাব।

এসব শুনে ভয় না পেয়ে বরং ঘুম নিয়ে সচেতন হন । আপনি যদি ভাগ্যবান হন এবং রাতে ছ- সাত ঘন্টা ঘুমের সুযোগ পান – তার সদ্ব্যবহার করুন।  না,  অফিসের কাজ আছে বলে ঘুমোতে পারি না, একটু রাত জেগে ওয়েব সিরিজ দেখলে কীই বা  এমন ক্ষতি হবে  – দয়া করে এসব বলবেন না।  এক দিন , দু দিন , এক হপ্তা চলতে পারে।  অন্তত মাসের পর মাস বলবেন না।  ঘুমকে যথাযথ সম্মান না দিতে পারলে ঘুম তার প্রতিহিংসা একদিন চরিতার্থ করবে। করবেই।

তবে অনেকেই ততটা ভাগ্যবান নন।  তাঁদের ইচ্ছে থাকলেও ঘুম আসেনা।  ঘুম এলেও ঘুম থাকে না।  তাই সচেতনতাকে আতঙ্কে পর্যবসিত করে ফেলা উচিত নয়। তাঁদের সম্মান জানিয়ে দু কথা বলি।  সারাক্ষন ‘ঘুম হচ্ছে না’ , ‘ঘুম হচ্ছে না’ ভাবলে আরো বেশি শরীর খারাপ হয়ে যেতে পারে। তাই দরকার ঘুম সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত ধারণা পাল্টাবার । একঘুমে রাতকাবার না হলে অনেকেই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু এটাকে বোধহয অসুখ বলে ভাবার কারণ নেই।

নির্ঘাত এতক্ষনে আপনি মনে মনে ভাবছেন রাতে মোবাইল আর টিভি দেখার অভ্যাসটা না বদলালেই নয়।  কিন্তু মানুষের ঘুমের অভ্যাসকে সুপরিকল্পিত ভাবে বদলে দেওয়া হয়েছে শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে। এক ঘুমে রাত  কাবার – এই ধারণার জন্ম সেই সময়েই। চলুন ঘুম নিয়ে পেছনে ফিরে তাকাই।
পৃথিবীর বয়স পঁয়তাল্লিশ কোটি। মানুষের বয়স পঁচিশ লক্ষ বছর। ইদানীংকালের সাড়ে-তিনশো বা চারশো বছর বাদ দিলে, বাকি প্রায় চব্বিশ লক্ষ সাড়ে নিরানব্বুই হাজার বছরই মানুষ ঘুমিয়ে এসেছে প্রায় সারা রাত। এই ঘুমও কিন্তু একনাগাড়ের ঘুম ছিলনা। রাতের ঘুম বেশিরভাগ সময়ই দ্বিখন্ডিত বা ত্রিখন্ডিত ঘুম ছিল। দ্বিখন্ডিত ঘুমের অজস্র উদাহরণ পাওয়া যায় ইতিহাস ঘাটলে।

আধুনিক ঘুমের অভ্যাস যে কতটা কৃত্রিম  সেটা নিয়ে সবচেয়ে বড়ো বোমা ফাটিয়েছেন আমেরিকার ভার্জিনিয়া টেক ইউনিভার্সিটি র গবেষক রজার ইকার্শ। দেড় দশক ধরে ইতিহাসের পাতা তন্ন তন্ন খুঁজে তিনি যা পেয়েছেন তা রাতেরঘুম কেড়ে নেবার জন্য যথেষ্ট। এর পর সারা পৃথিবী জুড়ে যা গবেষণা হয়েছে তা ঠারেঠোরে ইকার্শ এর গবেষণাকেই মান্যতা দেয়। যবে থেকে ঘুমের ছন্দ কে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভেবে লিপিবদ্ধ করেছে প্রায় তবে থেকেই আমরা দেখেছি মানুষের ঘুম কখনোই একঢালা ছিল না। রাতে পূর্বপুরুষরা ঘুমোতেন কয়েক ঘন্টা। তারপর খানিকটা জেগে। তারপর আবার কয়েক ঘন্টা ঘুম। মাঝের জাগরণের সময়ে গেরস্থালির কাজ থেকে ধ্যান, যৌন সম্পর্ক থেকে শুরু করে প্রতিবেশীর বাগান থেকে আপেল চুরি সবই চলত। হোমারের ওডিসি থেকে নাইজিরিয়ার প্রাচীন জনজাতির নৃতত্ব গবেষণায় তার প্রমান মেলে।

দ্বিখন্ডিত নিশি-ঘুম আমাদের মজ্জায় মজ্জায়। চব্বিশ লক্ষ সাড়ে নিরানব্বুই হাজার বছরের অভ্যাসকে আমরা জোর করে পাল্টে ফেলতে শুরু করলাম আজ থেকে মাত্র সাড়ে তিনশো বছর আগে। যে রাতের উপরে একচেটিয়া দখল ছিল চোর এবং দেহ ব্যবসায়ীদের, সে রাতের উপরে মানুষের দখলদারি শুরু হলো প্যারিসে। 1667 সালে প্যারিসে জ্বললো প্রথম রাস্তার আলো। সাধারণ নাগরিকরা আরো রাত পর্যন্ত কাজ করার এবং সুস্থভাবে রাস্তায় বেরোনোর আরো সুযোগ পেলেন। শোনা যায় রাতের অপরাধ জগত কে সংকুচিত করে তোলার লক্ষ্যেই প্যারিসে রাস্তার আলো জ্বলতে শুরু করে। অপরাধের মাত্রা কমে ছিল কিনা জানা নেই তবে হাস্যকর ভাবে পিক পকেট এর সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে যায়। তার কারণ, রাতে তখন মানুষের জমায়েত শুরু হলো। সে যাই হোক, মানুষ কিন্তু পেল অনেকটা সময় কাজ করার সুযোগ।

এরপর শুরু হলো শিল্প বিপ্লব। মানুষের রাত আরো ছোট হয়ে এল। থুড়ি, বলা উচিত, রাতের ঘুম কে আরো ছোট করার প্রয়োজন এলো। কলকারখানায় শিফট এ আরো বেশি শ্রমিক পাবার লক্ষে সংগঠিত ভাবে রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক চাপ শুরু হলো। আরো আরো অল্প সময় ঘুমের জন্য বরাদ্দ করার জন্য প্রচার শুরু হয় নানা রকম পত্র-পত্রিকা । দ্বিখণ্ডিত ঘুম কে অস্বাভাবিক বলে আখ্যা দেওয়া হলো। অখন্ডিত ঘুম অল্প সময়ে সমাপ্ত হয় বলে তা ‘স্বাভাবিক’ বলে প্রচার শুরু হলো। এমন কি উচ্চবিত্তদের সোসাইটিতে রাত জেগে থাকা ফ্যাশনে পরিণত হল। ১৮২৯ সালেও প্রাচীন মেডিক্যাল জার্নালে অভিভাবকদের তদ্বির করা হতো যাতে ওনারা বাচ্চাদের ঘুমের অভ্যাস পরিবর্তনে বাধ্য করেন। অর্থনীতি পিছিয়ে পড়ার আশংকায় লক্ষ বছরের ঘুমের অভ্যাস কে ভেঙে ফেলা কতখানি যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্ন বিতর্কের জন্ম দিতে পারে।

যদিও শিল্প বিপ্লবের পর থেকে কয়েকশ বছরের একনাগাড়ে ঘুমের অভ্যাস আমাদের মধ্যে অনেকেরই শরীর এবং মন কে তৈরি করে দিয়েছে, কিন্তু অনেকেই রাত্রে একনাগাড়ে ঘুমাতে পারেন না। এছাড়া, দুশ্চিন্তা, উত্তেজনা বা স্ট্রেস অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় কয়েক লক্ষ বছরের পুরনো দ্বিখন্ডিত ঘুমের অভ্যাসে।
এতো গেলো রাতে।  তাহলে দুপুরের ঘুম ?

1999 নাগাদ ঘুম-বিজ্ঞানীরা আমাদের বলেন যে মানুষের শরীরের শারীরবৃত্তীয় ঘড়ি আমাদের শরীরকে রাতের খানিকটা তো বটেই কিন্তু তার সাথে সাথে দুপুরবেলাতেও ঘন্টাদুয়েক ঘুমিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেয় কিন্তু আমরা কি সেই ঘুম ঘুমোতে পারি? একদমই না।

দুপুরে একটুস ভাতঘুম। আহা ! কার না ভালো লাগে।  মেগাস্থিনিস তাঁর লেখা  ‘ইন্ডিকা’ তে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন যে ভারতীয়রা একদম গ্রীক-দের মতো – দু দেশ ই দুপুরে ঘুমোতে পছন্দ করে। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে কোষ্ঠকাঠিন্য , বদহজম আর বাতের নিদান হিসেবে দুপুরে বাঁ-পাশ ফিরে স্বল্প বিশ্রামের পরামর্শ রয়েছে। যার নাম বামকুক্ষি । মির্জা গালিবের বাড়ির সামনে নোটিশ থাকতো দুপুরে ডাকাডাকি করা নিষেধ। আবার নব্য-ভারতে ভাতঘুম হয়েছে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি।  গোয়ার প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী বিজয় সরদেশাই কিছুদিন আগে বলেছেন উনি নির্বাচনে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হলে কোঙ্কনিদের দুপুরে বিশ্রাম নেবার প্রাচীন অভ্যাস কে আবার ফিরিয়ে দেবেন। এতো গেলো ভারতবর্ষের কথা – এবার একটু ঘুরে আসি।  প্রাচীন গ্রিসের সিয়েস্তা আঠারোশো শতাব্দীতেও জনপ্রিয়। গ্রীক দার্শনিক শোপেনহাইয়ার-ও দুপুরে বিশ্রামের অনাবিল আনন্দের কথা বলেছেন।  যাহাই ইতালি , গ্রীস বা স্পেন এর ‘সিয়েস্তা’, তাহাই অত্যাধুনিক ‘বিউটি স্লিপ’ বা ‘ন্যাপ’ আর তাহাই প্রফেট মোহাম্মদের ‘কাইলুল্লাহ’ বা বৌদ্ধ ধম্মপিটকের ‘নির্ভানিক’।  তাজা থাকার চাবিকাঠি।  কিন্তু আবার অতিরিক্ত হলে ‘তাহাই’ রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ (ঐতিহাসিক ইভান এন্ড্রুজ- 8 Reasons Why Rome Fell) ।  খুব বিচক্ষণের মতোই স্কটিশ চিকিৎসক -লেখক ক্রোনিন সাহেব সাবধান করে দিয়েছেন দুপুরের ছোট্ট বিশ্রাম যেন লম্বা ঘুম না হয়ে যায়।  তাহলেই স্বাস্থ্যের সর্বনাশ।  ঠিক যেমন,  যে লবন স্বল্প পরিমানে খাবারকে করে সুস্বাদু, সেই লবন ই বেশি হয়ে গেলে রান্না পাতে দেওয়া যাবে না।

মার্কিন গবেষক জেরোম সিগাল অবশ্য এসব মানেন না।  নামিবিয়া, বলিভিয়া আর নাম না জানা ভানুয়াটু দেশের সুদূর ‘টানা’ দ্বীপের আধুনিক সভ্যতার অভ্যাস থেকে দূরে থাকা আদিম জনজাতির বাসিন্দাদের  ঘুমের অভ্যাসের তথ্যানুসন্ধান করে তিনি বলেছেন দুপুরে ঘুমের গুজব সব ফালতু। আমরা যেমন আছি তেমনই ভালো। কিন্তু তাঁর গবেষনাই যে শেষ কথা তা হলপ করে বলা মুশকিল। যে দ্বীপ এ ল্যাপটপ নিয়ে সাহেব-সুবো রা পৌঁছে যেতে পারেন প্রশ্ন থাকে তাঁরা কি সত্যিই আধুনিক সভ্যতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ?

বিবর্তনের দিক থেকে দেখতে গেলে বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী দিনের মধ্যে কোনো না কোনো সময়ে অল্প বিস্তর ঝিমিয়ে নেয়। এখনো পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই বাচ্চা এবং বয়স্ক দের মাঝে মাঝে ন্যাপ নিয়ে নেওয়ার একটা প্রবণতা অমিল নয়। সুতরাং দিনের মধ্যে আধটু একটু ঝিমিয়ে নেওয়া একদমই কোন অপরাধ নয়।  তাই দিনের বেলা যদি কাজ করতে করতে খুব ঘুম পেয়ে যায় তাহলে কয়েক মিনিট এলার্ম দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেওয়াটা কাজের কাজ  বলেই ভাবতে শিখুন।

ওদিকে দিনের বেলার যে  ছোট্ট ন্যাপ  আপনাকে চাঙ্গা করে তোলে,  রাতে এই ছোট ঘুম মোটেই কার্যকরী নয় ।

রাতে চাই ঘুম-আবর্ত বা স্লীপ সাইকেল ধরে ঘুম। মনে আছে তো আগেই বলেছি স্লিপ সাইকেল এর কথা? একটা non-REM আর একটা REM  মিলিয়ে একটা শিফট। একেকটা স্লিপ-সাইকেলে মস্তিস্ক অসম্ভব গতি তে চূড়ান্ত মনোসংযোগ করে কাজ করে যায়।  তাই অসম্পূর্ণ ঘুম-আবর্তের মধ্যে ঘুম ভেঙে গেলে মস্তিস্ক এতটাই অসন্তুষ্ট হয়ে যায় ঘন্টার হিসেবে অনেক ঘুমিয়েও মনে হবে ভালো ঘুম হলো না।

তাহলে আরো ভালো ঘুমোনোর চাবিকাঠি কি ? যেকোনো লাইফস্টাইল পত্রিকার  বছরে একটা করে  প্রচ্ছদ সাধারনত হয়ে থাকে ঘুমের উপরে । সংসারী মানুষজন যে নিয়ম মেনে এসব করতে কমই পারবেন, তা  বলাই বাহুল্য । তাও নিয়ম যখন আছে, তা  জেনে রাখাই  ভালো । বলা যায়না কখন কাজে লাগে !

দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের সমস্যা থাকলে, খুব অসুবিধে না হলে রাতে শোয়ার আগে ঈষদুষ্ণ জল দিয়ে স্নান করে নিন। স্নান করার সময় নিজের হাতে মুখ আর ঘাড়ের মাংসপেশি গুলোকে একটু ম্যাসাজ করে দিন। হাত আর পায়ের মাংসপেশীগুলোকেও একটু ম্যাসেজ করে নিতে পারেন । বেশ তরতাজা লাগবে। এই সময় হালকা ল্যাভেন্ডার বা ক্যামোমাইল এর সুবাস হলে তো কথাই নেই। কিছু বিজ্ঞানী দাবি করেন ঘুমোনোর আগে ক্যামোমাইল, লেমনগ্রাস দেওয়া গ্রিন টি নাকি ঘুমের আবাহন কে আরো বেশি মধুর করে তোলে- চেষ্টা করতে ক্ষতি কি।

শোয়ার ঘরের তাপমাত্রা খুব বেশি বা খুব কম না থাকা ই বাঞ্ছনীয়। বিছানায় পৌঁছে চোখ বুজে করে নিতে পারেন একটু হালকা ধ্যান, নরম হলুদ আলোতে পড়তে পারেন একটু বই। খুব সাদা বা এল ই ডি র নীলচে সাদা আলো কিন্তু ঘুমের জন্য ভালো নয়।  গান ভালো লাগলে হালকা আওয়াজ এ  নরম গান শুনতে পারেন। এই ধরুন চৌরাসিয়ার হিন্দুস্তানি
ভৈরবী ! দেখবেন কখন ঘুমে চোখ বুজে এসেছে। আর যদি সহজে ঘুম নাও আসে তবুও হতাশ হয়ে পড়বেন না শরীর এবং মন যদি খানিকটা সময় বিশ্রামে থাকে তাহলেও অনেকটাই সুফল মেলে।  আর হ্যাঁ নরম বালিশের শোবার মজাই আলাদা। বিছানার চাদর যদি পাতলা সূতির হয় তাহলে খুব ভালো যাতে গায়ের ঘাম গুলো চাদরে শুষে যেতে পারে।

রাতে ভালো ঘুমের জন্য আরও যেটা বেশি দরকার সারাদিন যথেষ্ট পরিমাণে জল খাওয়া। আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান দেশে যথেষ্ট পরিমাণে জল খাওয়াটা খুব বেশি দরকার। কারণ ঘামের সাথে প্রচুর পরিমাণে জল বেরিয়ে যায় এমনিতেই। রাত আটটা নটার পর থেকে জল খাওয়াটা একটু কমিয়ে দিন, যাতে ঘুমের মধ্যে আপনাকে বারবার বাথরুমে না যেতে হয়। আমরা জেনেছি যে দিনের মধ্যে অল্প বিস্তর সময় ছোট্ট সময় হালকা ঘুমিয়ে নিতে পারলে সুবিধা কিন্তু সেই ঘুম যাতে বিকেল চারটার মধ্যেই হয় সেটা চেষ্টা করুন।

ঘুমের অসুবিধা থাকলে বিকেলে সন্ধ্যার পর থেকে খুব বেশি চা কফি না খাওয়াই ভালো। চা কফির বা কোলা জাতীয় নরম পানীয়ের মধ্যে ক্যাফেইন থাকে যেটা আমাদের মস্তিষ্ককে আরো বেশি সজাগ রাখতে সাহায্য করে- যা ঘুমের পরিপন্থী। অনেকে ভাবেন রাতে নাইট ক্যাপ একপেগ হুইস্কি বা এক গ্লাস ওয়াইন ঘুমোতে সাহায্য করবে।  এক দিন, দু-দিন সেটা ভালো কাজ করলেও, নিয়মিত এলকোহলের সাহায্যে না ঘুমোনোই কিন্তু ভালো।  অতিরিক্ত মদ্যপান তো নৈব নৈব চ।  একদম ভরপেট খেয়ে ঘুমোতে যাবেন না।  আকণ্ঠ খাবার পর চোখ বুঁজে আসতে  পারে। তবে সেটা ঘুম নয়।  অবসন্নতা। এই সময় খাবার দাবার হজম করার জন্য সারা শরীর থেকে রক্ত চলে আসে পেটে। এই ‘ঘুম’এ উপকারের থেকে অপকার বেশি।  চেষ্টা করুন যাতে খাওয়া আর ঘুমের মাঝে ঘন্টাখানিকের বিরতি থাকে।

নিয়মিত যোগ ব্যায়াম ও এরোবিক্স এর সাহায্য নিন।  দিনের মধ্যে দু’একটা সময় লম্বা হাঁটুন। সপ্তাহে ঘন্টা চার ঘাম ঝরানো পরিশ্রম করা খুব দরকারি এবং উপকারী। ঘরের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট দূরত্ব হেঁটে এ ঘর ও ঘর করা বা রান্না ঘরে বসে অনেকক্ষণ হাতা খুন্তি নেড়ে রান্না  করায় আপনার শরীর অবসন্ন বোধ করলেও, তাতে দৈনন্দিন শরীরচর্চার প্রয়োজন মোটেও মেটে না ।

দিনের পর দিন ঘুম যদি  সত্যি সত্যিই কম হয় তাহলে ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়া দরকার। তবে প্রতিরাতেই যে একদম কাঁটায় কাঁটায় সাত ঘন্টা ঘুম হবে এরকম দাবি কেউ করতে পারেন না। কোনও রাতে ঘুম খানিকটা কম হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়  সপ্তাহের গড়ে শরীর ঠিক ঘুম পুষিয়ে নেয়।

সুতরাং মনে বেশি দ্বিধা না রেখে সুযোগ পেলেই ভালো করে ঘুমিয়ে নিন।  শান্তিতে।