আগামীর জন্য

   ” তারপর ঠাম্মি, রাজকুমারের কি হল?” অধীর আগ্রহে প্রশ্ন করে তোতোন।
” তারপর সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠি …” বাংলার রূপকথার জগতের ঝুলি খুলে উজাড় করে দেন মৃণালিনী তাঁর একমাত্র নাতি তোতোনের কাছে।
” তোতোন, তোতোন, কোথায় তুমি?” মায়ের ডাকে  তোতোন একটু কুঁকড়ে যায়।
” কি হল, তোমাকে ডাকছি, সাড়া দিচ্ছ না কেন? ওহো, আবার সেই অবাস্তব গল্পগুলো শুনছ? এর চেয়ে রাইমস্ গুলো তো মুখস্থ করতে পারতে, কাজে দিত! শুধু শুধু বোকা বোকা গল্পগুলো শুনে অমূল্য সময় নষ্ট করছ! আর মা, তোমাকে কতবার বলেছি , এসব বাংলা রূপকথার গল্পটল্প তোতোনকে শোনাবে না। ইংরেজি গল্প হলে তাও ঠিক ছিল। ও এসব বাজে গল্প শুনে কল্পনার জগতে বাস করতে শুরু করেছে!” বিরক্ত হয়ে বলে কেতকী।
” আমার তো খুব ভাললাগে মা… রাজকুমার, রাজকুমারী, পক্ষীরাজ ঘোড়া,  ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমী, রাক্ষসের গল্প শুনতে। ইংরেজি গল্পগুলো এত ভালই লাগে না।” তোতোন তাড়াতাড়ি বলে ওঠে।
” তুমি চুপ কর। মা, প্লিজ, বাংলা গল্প, কবিতা না শুনিয়ে পারো তো একটু ইংরেজি গল্প,  কবিতা শুনিও তোতোনকে।” কেতকীর কথায় কিছু না বলে চুপ করে থাকেন মৃণালিনী।
দুপদাপ পা ফেলে চলে যায় কেতকী।
“বাগানে বসে চুপিচুপি তুমি আমাকে বাংলা কবিতা, গল্প শোনাবে ঠাম্মি। মা তাহলে জানতেই পারবে না!” তোতোনের মুখে ষড়যন্ত্রের আভাষ।
” আচ্ছা, ঠাম্মি, তুমি তো আমাকে শিখিয়েছ, বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা। আর মাতৃভাষা মায়ের দুধের মত। তাহলে কেন মা, বাবা বাংলা সাহিত্য পছন্দ করে না?”
” তোমাকে স্বাধীনতার গল্প শুনিয়েছি না?  ইংরেজরা এসে আমাদের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে, মাতৃভাষা নয়, বিদেশী ভাষারই কদর বেশি। তাই তো বাংলায় ভাল করে কথা না বলতে পারলেই আজকাল মানুষের  গর্ব হয়। ইংরেজিতে কথা বলতে পারাটাই দস্তুর। চল তোতোন সোনা, বাগানে যাই।”

“এই শোন না, তোমার মায়ের রকমসকম আমার একদম ভাললাগছে না।” কেতকীর কথায় অফিসের ফাইল থেকে মুখ তোলে সুবর্ণ।
” আবার কি হল? তোমাদের শাশুড়ি বউমার যাঁতাকলে পেষাই হতে আর ভাললাগে না আমার।”
” উঃ! সবসময় পাশ কাটিয়ে যাওয়ার তাল তোমার! ছেলেটার কথা তো ভাববে, নাকি?”
কেতকীর কথায় এবার একটু সচেতন হয় সুবর্ণ, “কেন? তোতোনের কি হয়েছে?”
” তোমার মা যত রাজ্যের বাংলা কবিতা, রূপকথা ওকে শোনায়। সেদিন তোতোনের ক্লাস টিচার আমাকে নালিশ করলেন, তোতোন পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে উঠছে। মায়ের ঐ সব গল্প শুনেই এমনটা হয়েছে।” রাগ দেখায় কেতকী।
” আচ্ছা, আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলব। শোন, সামনে তো ভাষা দিবস আসছে। আমরা বন্ধুরা ঠিক করেছি ঐ দিন ছুটি নিয়ে শান্তিনিকেতনে যাব। বাচ্চাদের বাড়িতে রেখেই যাব, শুধু বউদের নিয়ে। ভাষা দিবস, তাই কোন বিলিতি নয়, কেবল দেশি সুরা, আর ওখানে পৌঁছে মাতব বাঁধনহারা  স্বাধীনতায়। ভাষা দিবসের সফল উদযাপন, কি বল?” চোখ টিপে বলে সুবর্ণ।
” উফ্, স্বাধীনতা মানে তো বউ পাল্টাপাল্টি!” ছদ্মকোপে বলে কেতকী।
” কেন বর পাল্টাপাল্টি করে তোমরা মজা লোটো না?” কেতকীকে এক হ্যাঁচকায় নিজের বুকের উপর ফেলে বলে সুবর্ণ।

          নির্দিষ্ট দিনে সুবর্ণ ও কেতকী মৃণালিনীকে তোতোনের দায়িত্ব দিয়ে সবান্ধবে চলে গেল শান্তিনিকেতনে। জানলার পাশে চুপ করে বসেছিল তোতোন।
” তোতোন সোনা, কোথায় তুমি? এই দেখ, তুমি এখানে? আর আমি সারা বাড়ি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি! কি হয়েছে? মনখারাপ?” তোতোনের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করেন মৃণালিনী।
আহা বেচারি  শিশু! মা বাবা কেমন করে ছোট্ট সন্তানকে ফেলে বেড়াতে চলে যায়! এই কি আধুনিকতা? বাচ্চাকে স্বনির্ভর করার পদ্ধতি? এতে কি মা বাবার সাথে সন্তানের দূরত্ব সৃষ্টি হবে না? সুবর্ণের ছোটবেলায় তো এমন করে তাকে ফেলে রেখে বেড়াতে যাবার কথা মৃণালিনী কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি! হয়তো তাঁরই ভাবনার ভুল, পুরোনো দিনের মানুষ তিনি! ভাবনাচিন্তাও পুরোনো, অচল! দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন মৃণালিনী।
তিনি তোতোনকে কোলের কাছে টেনে বলেন, “তোতোন সোনার সব প্রিয় খাবার বানাব আজ। বল তো, কি কি খাবে? আর একটা কথা শুনবে? আমি তোমার জন্য অনেকগুলো বাংলা গল্পের বই কিনে রেখেছি। তুমি প্রাণ ভরে পড়বে। আর আমার কাছে অনেক গল্প শুনবে। কবিতাও বলব।”
” তাই ঠাম্মা? কি মজা!” হাততালি দিয়ে ওঠে তোতোন।
             
              দুটো দিনই না হয় পেলেন মৃণালিনী! প্রাণ ভরে, নির্ভয়ে আগামী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেবেন নিজেদের সংস্কৃতি। এরাই তো দেশের ভবিষ্যত। বিদেশী ভাষার অর্চনা নিশ্চয়ই করবে, কিন্তু  আপন ভাষাকে অবহেলা করলে যে  নিজের ভিত্তিটাই দুর্বল হয়ে যাবে। তাই তো শত বাধা সত্ত্বেও মৃণালিনী অন্ততঃ একজন আগামী প্রজন্মকে শিখিয়ে চলেছেন নিজের সংস্কৃতির ধারক বাহক হতে।