অভিমান

প্লেনে বসে চন্দার মনটা কখনো রাগে জ্বলে উঠছে, আবার কখনো দুঃখে কষ্টে যন্ত্রণায় বিদীর্ণ হচ্ছে !তারই ফাঁক দিয়ে মনের মধ্যে একপাশে গুটিয়ে  থাকা ভালোবাসার- কত আদরের স্মৃতি ফুলের মত সোহাগ বিছিয়ে দিচ্ছে। রাগ কষ্ট ভালোবাসার টুকরো টুকরো স্মৃতির ঢেউয়ে চন্দা অভির কাছ থেকে দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
অভি ছিল চন্দার ছোটবেলার বন্ধু । পাশাপাশি বাড়ি। একসঙ্গে খেলাধুলা করতে করতে স্কুলে যাওয়া, টিফিন ভাগ করে খাওয়া, খেলার সময় পার্টনার হওয়া, ক্রমে বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়া দুজনে দুজনের । মজার কথা ,ক্লাসের যে কোনো পরীক্ষায় প্রথম ,দ্বিতীয় স্থানটা ওদেরই ছিল । তবে গোলাপের কাঁটার মতো একজন ছিল – সে তনিমা। সে কেবলই চেষ্টা করতো ওদের বন্ধুত্বে ভাঙন ধরাতে । কিন্তু পারতো না । তবু অক্লান্ত চেষ্টা করে যেত । স্কুলের পরীক্ষার তৃতীয় স্থানে সে থাকত । ওই অবধি।  এর বেশি কাছে যেতে পারতো না ।আসলে তনিমা অভিকে খুব পছন্দ করত, চন্দাকে সহ্য করতে পারত না।  তনিমাকে নিয়ে চন্দা অভি নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করত। কখনো চন্দা চোখ গোল গোল করে বলতো , ‘অভি তুই যদি ওই মেয়েটার দিকে একটু ফিরেছিস ,তোকে আমি জানে মেরে দেব।’ অভি কাল্পনিক ভয়ে শিউরে উঠত। ‘তোকে দেখে এখনই আমার ভয় করছে রে চন্দু ! এমন রণং দেহি মূর্তি ধরিস না ! তোকে ছেড়ে কোথায় যাব ? বাপরে ! আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা ?’ চন্দা হেসে ফেলতো। অভি কপট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতো। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জীবন এল। অভি চাকরি পেল একটা বিদেশী খুব বড় কোম্পানিতে । যথেষ্ট পরিমাণ টাকা । নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ অনেক । অভি লেগে পড়ল অফিসে নিজের উন্নতিতে।  চন্দা একটা কলেজের অধ্যাপিকা হল ,সঙ্গে রিসার্চ করতে শুরু করল। একদিন অভি জানালো, ‘ জানিস চন্দু , একটা ঘটনা ঘটেছে । আমাদের অফিসে তনিমা ঢুকেছে আমারই ডিপার্টমেন্টে আমার জুনিয়র অফিসার হয়ে ।’ চন্দা চমকে উঠল । ‘তনিমা ? ও কি করে ওখানে গেল ?’  ‘তনিমার একাডেমিক রেজাল্ট তো ভালই ছিল । তার ওপর ইন্টারভিউতে টপার হলো । তাই ম্যানেজমেন্ট ওকে লুফে নিল।  আমার অবশ্য সুবিধেই হয়েছে । ও হবে আমার জুনিয়র অফিসার ।  প্রয়োজনীয় কাজ ওকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারব।’ চন্দা চুপ করে যায়। কথা বলে না । অভি চন্দাকে আদর করে, ‘ রাগ করলি পাগলি ? দূর তনিমাকে নিয়ে তোর ভয় কি ? এককালের স্কুল-কলেজের ক্লাসমেট এখন অফিস কলিগ এর বেশি কিছু নয়।’
মাস চারেক কাটার পর অভি বলে, ‘জানিস , ব্যাঙ্গালোরের অফিসে একটা ভার্চুয়াল কনফারেন্স ছিল । তনিমা তাতে বেশ ভালো বক্তব্য রাখল রে ।নিজের রিপোর্টগুলো বেশ গুছিয়ে প্লেস করল । সবাই খুব প্রশংসা করছিল ওর ।’  ‘আর তুই?’  ‘আমি ? আমি কি ?’ একটু অবাক হয়ে অভি তাকায় চন্দার দিকে । অভি হো হো করে হেসে ওঠে। ‘তুই সেই ক্ষেপীই রয়ে গেলি । আরে তোর কি ভয় ? তুই আছিস আমার এইখানে ?’ বলে নিজের বুকের বাঁ দিকটা দেখায় । চন্দা শান্ত হয়।  বলে,   ‘আমার ভয় করে জানিস !’  ‘না, ভয় পাস না । বিশ্বাস রাখ। দেখবি সব ভয় চলে যাবে । অভির দু’হাতের বাঁধনে চন্দা বলে, ‘ রাখি তো! তোকে ছাড়া আমি মরে যাব অভি !’ অভি তার মুখে হাত চাপা দেয় । ‘অমন কথা বলেনা চন্দু ! তাহলে আমার বেঁচে থাকা দায় হয়ে উঠবে ।’ এইভাবে আশায় আশঙ্কায় ভালোবাসায় অভিমানে দিন কাটে দুজনের। চন্দা কষ্ট পায় বলে অভি আর তনিমার কথা তোলে না চন্দার কাছে। তাতেও চন্দার রাগ হয়ে যায় । ভুল বোঝে । একদিন তাই অভি বলে,  ‘এক কাজ করি চন্দু। আয় । আমরা বিয়ে করে ফেলি। তাহলে দেখবি সব সমস্যা মিটে যাবে।’ চন্দা থমকে যায়। এই কথা তো চন্দা ভাবেনি।  তাই ‘পরে জানাবো ‘বলে চন্দা উঠে পড়ে । ওর নিজের রিসার্চ পেপার কমপ্লিট হতে আরো চার-পাঁচ মাস সময় লাগবে। তার জন্য এখনই সংসারে জড়িয়ে পড়া ওর পক্ষে অসুবিধেজনক।  সঙ্গে যে কথাটা তার মনে গভীর ভাবে দাগ কাটলো , আচ্ছা, বিয়ে করে সে তো বাড়িতেই থাকবে । অফিসের ঘটনা তো সে জানতে পারবে না । কেননা দিনের বেশিটা সময় তো ওরা একসঙ্গেই কাটায় । সেখানে চন্দার জায়গা কোথায় ? অভিকে ভুল বোঝা চন্দার শেষ হয় না, বরং বেড়েই চলে। বিশ্বাসের দাবি সন্দেহের কাছে মাথা নত করে।  চন্দা বিয়ের কথা নাকচ করে দেয় । বলে, ‘ তুই এ অফিস ছেড়ে দে অভি। অন্য অফিসে জয়েন কর । তারপর আয়, আমরা বিয়ে করি ।’ কিন্তু এই অফিসের এত সুযোগ এত ভালো স্যালারি ছেড়ে অভি অন্য অফিসে যেতে চায় না।
ভুল-বোঝাবুঝি চরমে ওঠে ।  অফিস ছাড়া না ছাড়ার জেদাজেদিতে অভি চন্দা দুজনে দুদিকে ছিটকে যায় । অভিমানে অন্ধ হয়ে একবার ভাবে চন্দা, যে সে আর বেঁচেই থাকবে না । তাতে অভি সারা জীবন কষ্ট পাক । কিন্তু সেটাতেও মন সায় দিল না। যে পৃথিবীতে অভি আছে সেই পৃথিবীতেই চন্দা থাকতে চায় । হোক না তা দূরে থেকে! তবু তারা দুজনেই থাকবে তো !
এদিকে চন্দার রিসার্চ সেন্টার থেকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ এল এ সময়ে। আগেও একবার এসেছিল কিন্তু অভিকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি ।এখন দ্বিতীয়বার সেই সুযোগ আসাতে সে রাজি হয়ে গেল। 
মাস দুয়েক হল চন্দা দেখা করে না অভির সঙ্গে ।অভি অনেক চেষ্টা করেও চন্দাকে ধরতে পারেনি। চন্দার কোনো সিদ্ধান্তই অভি জানতে পারল না। সে সম্পূর্ন অন্ধকারে থাকলো।
ফ্লাইটে ওঠার অল্প খানিক আগে চন্দা অভিকে জানালো তার বিদেশ যাওয়ার কথা, ফ্লাইট এর সময়ের কথা । চন্দার ফোন পেয়ে অভি স্থানুর মতো বসে থাকল । খানিকক্ষণ পর একটা প্লেনের গর্জনে সে আকুল হয়ে তাকালো ! তার সব সুখ শান্তি ভালোবাসা চলে গেল ওই “উড়ন্ত পাখি”টার সাথে।  মনে মনে বলল, ‘ চন্দু ,এত অভিমান তোর? আমাকে তুই ছেড়ে চলে গেলি ? একটুও বুঝলিনা আমায় ? তোকে ছেড়ে এখন কি করে কাটাবো আমি?’
প্লেনে বসে চন্দা দু চোখ বন্ধ করলো । চোখের কোনে টলটল করতে থাকলো  দু’ফোঁটা শিশির কনা !!
এরপর কেটে গেলো পুরো একটি বছর। তখন চন্দার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে সে ভারতে ফিরে যাবে অথবা এই বিদেশেই থেকে যাবে। সারাটা রাত ঘুম এলো না চন্দার। ভোররাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে। একসময় অভির ফোন নাম্বারটা টিপে দেয়। শোনে রিংটোনের শব্দ। কানেকশন হলে খুব শান্ত গলায় একটা স্বর ভেসে এল মোবাইল থেকে, ‘তুই কি আর ফিরবি না চন্দা?’ চন্দা কথা বলতে পারে না । কেবল ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ‘পাগলি একটা ! শুধু শুধু একটা বছর কষ্ট দিলি আর কষ্ট পেলি। কোন মানে হয়? আমার আর কিছু বলার নেই রে ! তুই তো জানিস —

‘রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে!’

অভি চুপ করে যায়। খানিকক্ষণ স্তব্ধতা। অভির কানে সুরের মতো ভেসে আসে , ‘আমি যাচ্ছি!’