ভোট মিটলেও রাজনৈতিক হিংসা কমার রেশ নেই কোচবিহারে। শুধু বিরোধীদল নয়, শাসকদল তৃণমুল কংগ্রেসের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃত্বরাও আক্রান্ত হচ্ছেন আজকাল। ভোটের পরে শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্বদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় রাজনৈতিক মহলে নানা প্রশ্ন উঠছে। বিধানসভায় কোচবিহারে শাসকদলের ভরাডুবির ফলে শাসকদলের নেতৃত্বে এক রাজনৈতিক শুন্যতা দেখা দিয়েছে। ফলে তৃণমুলের হেভিওয়েট নেতাদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সেখান থেকেই ভাবমুর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য এই আক্রমণের নাটক হচ্ছে নাতো? প্রতিটি আক্রমণের ঘটনাকে ‘মিনি পুলয়ামা’ বলে ইতিমধ্যে আড়ালে আবডালে আলোচনা শুরু হয়েছে। কেননা, এইসব আক্রমণের ঘটনাগুলিতে শাসকদলের আক্রান্তরা যতই বিরোধীদের দিকে আঙুল তুলুক না কেন দলের অভ্যন্তরেই এগুলি সাজানো ঘটনা বলে অনেকেই দাবি করছেন। আবার অনেকেই শাসকদলের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের উপর আক্রমণের ঘটনা রুখতে না পারার জন্য পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাকেও দাবি করছেন। বৃহস্পতিবার তৃণমূল মহিলা কংগ্রেসের জেলা সভানেত্রী সুচিস্মিতা দেব শর্মার উপর দুষ্কৃতি আক্রমণের ঘটনার পরে সেসব আলোচনা এখন তুঙ্গে।
বিগত লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে পুলয়ামা আক্রমনের ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় দেশ জুড়ে তৈরি হওয়া জাতীয়তাবাদী ঝড়ে বিরোধীদের কুপোকাত করে বিজেপি। বিরোধীদের অনেকেই দাবি করেন, নিজেদের পালে হাওয়া ঘুরাতেই পুলয়ামা আক্রমণকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করে বিজেপি। না হলে সেইসময় দেশ জুড়ে যেভাবে সরকার বিরোধী হাওয়া ছিল তাতে মোদী সরকারের ফেরা অসম্ভব ছিল বলেই অনেকের মত। আর মোদী সরকারের সেই ফর্মুলাই নাকি এবার কোচবিহারের শাসক দলের অনেক নেতাই অনুসরণ করছেন বলে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবি মহলের একাংশ মনে করছেন ।
বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরোনোর পরেই আক্রান্ত হন তৃণমুল নেতা উদয়ন গুহ। এবারের নির্বাচনে স্বল্প ব্যবধানে হারার পরে নিজের এলাকায় রাজনৈতিক ভাবে পিছিয়ে যান উদয়নবাবু। নিজের রাজনৈতিক জমি ফেরাতে মরিয়া উদয়ন গুহ ফলাফলের পর থেকেই বেপরোয়া ভাবে ময়দানে নেমে পড়েন অনেকে মনে করেন। আর নির্বাচনের ফল ঘোষনার পরে এই বেপরোয়া মনোভাবের কারনেই আক্রান্ত হতে হয় তাঁকে বলে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবি মহলের দাবি। নিজের শহরেই দুষ্কৃতিদের হাতে আক্রান্ত হয়ে হাত ভেঙ্গে যায় তাঁর। দ্রুত খবর পৌছায় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। আর সেটাই আর্শীবাদ হয়ে উঠে তাঁর কাছে। নির্বাচনের পরে ফিরে পেয়েছেন দিনহাটা পুরসভার প্রশাসকের পদ। সুস্থ হয়ে ফিরে এসে দিনহাটায় বিজেপির সংগঠনে ধ্বস নামাচ্ছেন তিনি। দিনহাটার বিধায়ক পদ থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামানিক ইস্তফা দেওয়ায় উদয়নবাবু ফের বিধায়ক পদে তৃণমুল প্রার্থী হওয়ার জন্য দরবার করছেন। এই ক্ষেত্রে তাঁর আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা আলাদা মাইলেজ দিচ্ছে তাঁকে বলে বুদ্ধিজীবি মহলের মত ।
সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা সভাপতি পার্থ প্রতিম রায়ের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালনার ঘটনা ঘটে। কোচবিহার-১ ব্লকের নাটাবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের জিরানপুরের গুলি কান্ড কে ঘিরে তোলপাড় হয় জেলা ও রাজ্য। এই ঘটনায় পার্থ অনুগামীরা বিজেপির দিকে আঙ্গুল তোলে। কিন্তু দলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি ও নাটাবাড়ির তৃণমুল কংগ্রেসের প্রার্থী ঘটনাটিকে সাজানো বলে সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করেন। বিধানসভা নির্বাচনে শীতল্কুচিতে পরাজিত হন পার্থবাবু। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, লোকসভা নির্বাচনে এগিয়ে থাকা এই আসনে পার্থ প্রতিম রায়ের পরাজয়ের ঘটনা মেনে নিতে পারছে না তৃণমূলের অনেকেই। জেলায় তৃণমূলের ভরাডুবির পরে জেলার সভাপতি পদের ও পরিবর্তন হতে পারে বলে ইতিমধ্যে জোর গুঞ্জন চলছে। সেই প্রেক্ষিতে এই গুলি কান্ড পার্থবাবুকে ফের রাজ্য রাজনীতির লাইম লাইটে নিয়ে আসলো। সেইসাথে যোগালো বাড়তি অক্সিজেনও।
এদিন আক্রান্ত হন তৃণমূলের মহিলা নেত্রী শুচিস্মিতা দেব শর্মা। রাজ্যে মহিলা সংগঠনে শীর্ষ নেত্রী পরিবর্তনের পরে তাঁর জেলা সভানেত্রী থাকা নিয়ে অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছে। জেলা সভাপতির বিরোধী শিবিরের এই নেত্রীর পদে থাকা এখন অনেক জটিল অংকের খেলা। এই আক্রমণের ফলে শুচিস্মিতা ফের শিরোনামে চলে এলেন। এখন দেখা যাক এই আক্রমণের পরে তাঁর জেলা সভানেত্রীর পদ বহাল থাকে কিনা?
এইসব আক্রমণের ঘটনায় পুলিসকে নিয়ম করে নিশানা করতে ছাড়েননি শাসকদলের নেতারা। আক্রান্ত নেতা উদয়নবাবু এদিন ফেসবুকে লিখেন, কোচবিহার জেলা পুলিশের ব্যর্থতার ফলে একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে। রাজ্যপাল আর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভয়ে পুলিশ জড়োসড়ো হয়ে আছে। ক্ষমতাশীন দলে থেকেও তৃণমূলের নেতা নেত্রীদের বারবার এই পুলিশকেই কাঠগডায় তোলায় জল্পনায় ঘৃতাহুতির কাজ করছে। প্রশ্ন উঠছে জেলা পুলিস-প্রশাসন কি শাসকদলের নিয়ন্ত্রণহীন? শাসকের নিয়ন্ত্রণহীন? রাজ্যপালের নিয়ন্ত্রণাধীন?
নাকি রাজ্নৈতিক নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবি ও সুনাগরিকদের ‘মিনি পুলয়ামা‘ তত্ত্বই কোচবিহারের রাজনীতিতে আজ বাস্তব সত্য হয়ে দেখা দিল!