১২০ গ্রাম সোনার জিহবা, ৫ কিলো ওজনের রুপোর নুপুর, হিরে বসানো সোনার টিপ, আট ফুট রূপোর নরমুন্ড মালা দিয়ে এবার সেজে উঠছে উত্তরবংগ তথা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বোল্লা রক্ষা কালিমাতা।আজ থেকে বালুরঘাট থেকে ২৬ মাইল দুরত্বে বোল্লা গ্রামে বাসৎরিক পুজো শুরু বোল্লা রক্ষা কালি মাতার।চারদিন ধরে চলা এই পুজোয় সোনা ও রুপো মিলিয়ে অন্তত ৩০ কেজি ওজনের অলংকার পড়ানো হবে সাড়ে সাত ফিট উচ্চাতা বিশিষ্ট জাগ্রত এই মায়ের প্রতিমাকে। এর পাশাপাশি, এবছরই প্রথম মন্দিরে সারাবছর ভক্ত এবং পূর্ণাথীদের জন্য সাড়ে তিন কিলো রুপো দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বোল্লা কালির মুখ।
উত্তরবঙ্গের রাস উৎসবের পরেই দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বোল্লা গ্রাম পঞ্চায়েতের বোল্লা রক্ষা কালি পুজো অন্যতম। বোল্লা গ্রামের নাম অনুসারেই মায়ের নামকরন বোল্লা রক্ষা কালী মাতার। এই পুজোয় কোনো তিথি নক্ষত্র দেখে নয়,শুধু মাত্র রাস পূর্ণিমার পরের শুক্রবার এই পুজোর নিয়ম। যা চলে আসছে অন্তত চারশো বছর ধরে। এবারও তার ব্যাতিক্রম হয় নি, আজ রাস পূর্ণিমার পরের শুক্রবার, এদিন বোল্লা কালির বার্ষিক পুজো অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। তিন দিন পুজো ও মেলা শেষে মায়ের প্রতিমা মন্দির সংলগ্ন পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়ে থাকে। ফলে সারাবছর বোল্লা মাতার দর্শন করতে পারেন না পূর্ণার্থীরা। বরাবরের এই বিষয়টিকে নজরে রেখে এবার রুপো দিয়ে মুখ তৈরি করা হয়েছে ৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে। যা স্থায়ীভাবে রাখা থাকবে মন্দিরের বেদীতে। বোল্লা কালীর পূজার ইতিহাস প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো। জনশ্রুতি অনুযায়ী, কথিত আছে, জনৈক এক ব্যক্তি ( অবশ্য এই নিয়ে মতান্তর রয়েছে অনেক পুরনো বাসিন্দারা বলেন পুরুষ নয় মহিলা)মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুকুর থেকে মায়ের শিলাময় রূপটি উদ্ধার করেন ও প্রতিষ্ঠা করে নিত্য পূজা শুরু করেন। এই সময়ে মাকে ‘মরকা কালী’ বলে অভিহিত করা হত। প্রতি জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যায় হত মায়ের বিশেষ পূজা। এরপর ইংরেজ আমলে স্থানীয় জমিদার মুরারিমোহন চৌধুরী ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ঘটনাক্রমে বহু গ্রামবাসী সহ তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তখন তিনি মড়কা কালী মায়ের কাছে প্রার্থনা করেন এবং বিচারে তিনি ও গ্রামবাসিরা বেকসুর খালাস পান। মা তাদের মনস্কামনা পুরন করায় মাকে পুজো দেবেন বলে জ্যৈষ্ঠ মাস আসতে দেরি থাকায়, সেই সময় তিনি ধার্য করেন যে, রাস পূর্ণিমার পরবর্তী শুক্রবারে মায়ের পুজো করবেন। সেই থেকে রাস পূর্ণিমার পরবর্তী শুক্রবারে দেবীর বাৎসরিক পুজো ও মেলা ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে আজও অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সালটা ছিল ১৯২০। মা তখন থেকে রক্ষা কালী নামে পরিচিত হন পরে গ্রামের নাম বোল্লা জুড়ে গিয়ে বোল্লা রক্ষা কালী মাতার নামে খ্যাত হন।
মানুষের বিশ্বাস, বোল্লা কালী মা তাঁদের সমস্ত মনস্কামনা পূরণ করেন। বহু ভক্ত মানত করা ছোট ছোট কালী মূর্তিতে পূজা দেন ও খাজা বাতাসা নৈবেদ্য অর্পণ করেন।এই পুজোতে খাজা – বাতাসার আলাদা আকর্ষন আছে। এছাড়াও প্রচুর সোনা ও রুপোর অলংকার জমা পড়ে মায়ের কাছে মানসিক হিসেবে।স্থানীয় মুসলিমরাও হিন্দুদের সাথে মায়ের উদ্দ্যেশ্যে পুজো দেন। সেদিক দিয়ে দেখলে এই পুজোতে সম্প্রীতির মেলবন্ধনের অন্য নিদর্শনও বলা যায়। বোল্লা রক্ষা কালি মন্দিরের পুরোহিত অরূপ চক্রবর্তী জানান, কমিটির তরফে ৫ কিলো ওজনের রুপোর নুপুর দেওয়া হলেও, সোনার জিহবা, সোনার ওপর হিরের টিপ, মুন্ড মালা সহ অনান্য সমস্ত কিছুই দিচ্ছেন পূর্ণার্থীরা। জেলা তো বটেই, রাজ্য ও ভিন রাজ্যের এমনকি নেপাল ও বাংলাদেশ থেকেও লক্ষাধীক পূর্ণার্থীরা এই পুজোয় আসেন এবং মানত করে থাকেন।ইতিমধ্যেই পুলিশ প্রশাসন নির্বিঘ্নে পুজো ও মেলার দিন গুলো পার করতে সিসি টিভিতে মুড়ে ফেলার পাশাপাশি কয়েক শো উর্দিধারি এবং সাদা পোশাকের পুলিশ মেলা প্রাংগনে নজরদারি চালাচ্ছে।পুরো পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আজ খোদ জেলা শাসক বিনিত কৃষন ও জেলা পুলিশ সুপাল মন্দির ও মেলা প্রাংগনের বিভিন্ন জায়গার নিরাপত্তা ব্যবস্থ্যা খতিয়ে দেখেন।আজ মায়ের পুজা উপলক্ষে ইতিমধ্যে নানান প্রান্ত থেকে ভক্তজন ও দর্শনার্থীরা মেলা প্রাংগনে এসে জড় হতে শুরু করেছে।প্রসংগত এই পুজোয় ভক্তদের মনস্কামনা পুর্ন হওয়ায় এই পুজোর দিন প্রায় দশ হাজারের কাছাকাছি পাঠাবলি হয়ে থাকে।পাশাপাশি মানতের ছোট মায়ের অসংখ্য মুর্তি মায়ের পুজার সাথে পুজিত হয়।এবারও তার অন্যথা হবার নয় বলেই মনে করছে পুজা কমিটির সদস্যরা।যদিও একটি পুশুপ্রেমী সংস্থ্যা এই পাঠাবলি প্রথা রোধে হাইকোর্টে মামলা করলেও হাইকোর্ট সেই আবেদনে সাড়া দেয় নি।বরং ধর্মচারন সবার করার অধিকার রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে কয়েক দিন আগে। বোল্লা এলাকায় মায়ের পুজো ও মেলাকে কেন্দ্র করে যে সম্প্রতির মেলবন্ধন ঘটে তারই বছর ঘোরার অপেক্ষায় চেয়ে থাকে এলাকাবাসী সহ জেলার মানুষরা।