স্মৃতির চেয়ার

ছোট্ট পিক-আপ ভ্যানটায় জায়গা হচ্ছিল না। শেষ মুহুর্তে প্রচুর কসরৎ করেও তাই শুকরাম মালি চেয়ারটা গাড়িতে তুলতে পারছিলো না কিছুতেই। স্টার্ট দিয়ে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। একটু দূরে নিজের গাড়িতে বসে লুকিং গ্লাসে দৃশ্যটা দেখতে দেখতে অধৈর্য হয়ে নেমে পড়ে বরুণ।
মালের গাড়িটা ছাড়ছে না দেখে প্রশ্ন জাগছিল সমরেশের মনে। বরুণ নামতেই তনুশ্রীকে জিজ্ঞেস করে,”কী হলো? গাড়িটা  ছাড়ছে না কেন ?”
-“কী জানি, কী হলো আবার!” তনুও উদ্বিগ্ন হয়।

খানিকবাদে গজগজ করতে করতে ফিরে এসে গাড়িটা স্টার্ট করে বরুণ। এসি অন করে  আলতো চাপে গাড়ি সেকেন্ড গিয়ারে ফেলে খুব নির্লিপ্তভাবে জানায়, “তোমার চেয়ারটা ওঠানো গেলো না বাবা। ওটা শুকরাম-কে দিয়ে এলাম।”
কথাটা বুঝে উঠতে যতটুকু সময়। তারপর চকিতে গাড়ির ব্যাক উইন্ড-স্ক্রিনের দিকে ঘাড় ঘোরায় সমরেশ। চেয়ারটা ধরে এদিকেই তাকিয়ে আছে শুকরাম। উদাস দৃষ্টিতে। বিদায় দিতে আসা মানুষজনের ভীড়টাও পাতলা হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। যতক্ষণ দৃশ্যটা দেখা যায় চোখ সরায় না সমরেশ। মুখ ফেরাতেই আড়চোখে তনুশ্রী লক্ষ্য করে প্রাজ্ঞ মানুষটার মুখে ছায়া ঘনানো বিষাদমেঘ একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে।
কাঁচভাঙা কাঠের  পুরনো আলমারি, একটা জারুল কাঠের সেকেলে ড্রেসিং টেবিল, কাঠের টপ লাগানো তিনপায়া লোহার টেবিল,জং পড়া রট-আয়রনের জুতোর শেল্ফ,একটা ঢাউস ডাইনিং টেবিল এসব সঙ্গত কারনেই বরুণের চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ গেছিল। এ ব্যাপারে দ্বিতীয়বার বাবার মতামত নেয়াটা প্রয়োজন মনে করে নি বরুণ।  আগেই কথা হয়েছিল সমরেশের সাথে, “তোমার এত কিছু কিন্তু ফ্ল্যাটে ধরবে না বাবা। আউট-ডেটেট স্ক্র্যাপগুলো দেখো যদি কাউকে সেল করা যায়।”

নতুন থ্রি-বিএইচকে টা -সম্প্রতি বাবার কথা ভেবেই নিয়েছে বরুণ। সেখানে সমরেশেরও চল্লিশ শতাংশ ইনভেস্টমেন্ট আছে। তবু  চিরকালীন ঋজুতা বজায় রেখেই বলেছিলেন, “দ্যাখো, তুমি যা ভালো বোঝো। তবে ঐ সেল-ফেলের ব্যাপারটাও তুমিই সামলিয়ো। আমার দ্বারা ওসব কোনো কালেই হয়নি। হবেও না।” বাতিলগুলো নামমাত্র দামে ছেড়ে দিয়ে বেছে বেছে চলনসই দু-তিনটে আসবাব, সমরেশের দু’ বাক্স বইপত্তর ,মায়ের আমলের যৎসামান্য কিছু  স্টিল-পেতলের বাসনকোসন, কিছু ক্রকারিস, কয়েকটা শো পিস, মায়ের আঁকা পেন্টিং আর অল্প কিছু টবসমেত দুষ্প্রাপ্য গাছ গাছড়ার সাথে চেয়ারটাও  প্যাকার্সের    লোকদের দিয়ে প্যাক করিয়েছিল বরুণ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেটাও হাতছাড়া হলো। ব্যক্ত না করলেও সমরেশের কষ্টটা বুঝতে পারছিল তনু।

রিটায়ারমেন্টের পর ছ’বছর এক্সটেনশনে থেকে অবশেষে পাকাপাকিভাবে বড়বাবু চলে যাচ্ছে । কথাটা চাউর হতেই দান কিংবা দাঁও প্রত্যাশীদের সংখ্যাটা ক্রমশ বাড়ছিল।
কানাঘুষো হতেই মালবাবু শম্ভু পালের স্ত্রী এসে আগেভাগে ইঁট পেতে রাখে,

“বৌমা, জিনিসপত্তর সবই কি নিয়া যাবা নাকি? ফ্ল্যাটে  এত সব লটবহর আঁটাইতে পারবা? “

“দেখি কী হয়, ও এসে কী বলে?”
বরুণের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইছিল তনুশ্রী। উত্তরটা মনমতো না হওয়ায় চটজলদি গামছা পাতে পালের বৌ, “যদি কিছু বেচবা ব’লে ভাইবে থাকো, তো আগে আমাকে বলবা। দাম দিয়া কিনবো। এমনি নিবো না।”
আর অদ্ভুত ব্যাপার,কদিন বাদেই সোনু রজকের বৌ এর মুখেও সেই একই কথা।কাপড় নেয়ার অছিলায় এসে তনুকে বলে,”ভাবী, বড়াবাবু যাইতেছে শুনলাম। আপনি কি সেইজন্য আইলেন, বাবুকে নিতে? বহুত ভালা আদমি ছিলেন বড়াবাবু…কত মায়া করতেন আমাদেরকে। আপনেরা জানেন নাই, টাকা-পইসা দিয়াও আমাদেরকে কতো মদত করসেন।”
-“তাই বুঝি?” শ্বশুর মশায়ের দুটো প্যান্ট, একটা সার্ট আর বিছানার চাদর দুটো গুনে দিতে দিতে তনু বলে,”শোনো, এগুলো এ সপ্তাহের ভেতরেই দিয়ে যেও কিন্তু।”
-“বড়াবাবু কী সামনে হপ্তাতেই চইলে যাবেন?”
-“কি জানি। এখনও ঠিক হয়নি। হলে জানতে পারবে। তোমার  পাওনাগন্ডা কিছু আছে?”
“না- না, পাওনা কিছু নাই…” বলে সোনুর বৌ কাপড়ের “গাঁঠরি” টা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
-“কিছু বলবে?” তনুশ্রী জানতে চায়।
“না,  মানে বলছিলম কি, যাইতে সময় যদি কিছু জিনিস বেচাবেচি করেন তো হামাকে জানাইবেন। পয়সা দিব,মাঙনি না লিব,কমবেশি করে দিয়ে দিবেন…ঠিক কি না?”

আসলে এই সুযোগসন্ধানের গল্পগুলো বহু কাল ধরেই চলে আসছে চা-বাগানে। ব্রিটিশ সাহেবরা যখন  চা-বাগান ছেড়ে চলে যেতেন, যাওয়ার সময় প্রচুর আসবাবপত্র, বই, শো-পিস,পেন্টিং এমনকি পোষ্য কুকুর গরুও দান করে অথবা স্বল্পমূল্যে দিয়ে যেতেন। সেসব বহুমূল্য আসবাবের জন্য ওৎ পেতে থাকতেন অনেকেই। কে কার আগে সেসব বাগিয়ে নেবে। তেমনি ভাবেই ঐ অ্যান্টিক, সুদৃশ্য ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের গদীআঁটা মেহগনি কাঠের চেয়ারটা লন্ডন ফিরে যাওয়ার আগে সমরেশের বাবা বড়বাবু অপরেশ চৌধুরী কে গিফট করে গেছিলেন মিঃ রিভস। সেই থেকে প্রেস্টিজ ফার্নিচার হিসেবে রয়েছে গেছিলো ওটা। পায়াগুলোয় সিংহের মুখ, পেছনের রেস্ট-পিসে চিনার পাতার অনবদ্য সুক্ষ্ম কাজ, চাইনিজ মিস্ত্রির হাতের মাস্টারপিসটা সমঝদারদের নজর এড়াতো না। মাঝে দু’বার শুধু পালিশ করানো ছাড়া কিছুই করতে হয়নি। শৌখিন অপরেশবাবু অফিস থেকে ফিরে চেয়ারটায় বসে চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়তেন। আর ঠাকুমা-শাশুড়ি নাকি কাপড়ে নারকোল তেল ভিজিয়ে রোজ ওটা পালিশ করে রাখতেন। চেয়ারটার প্রতি সমরেশের বাড়তি দুর্বলতা না থাকলেও, শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর তনু দেখেছে অফিস থেকে ফিরে  বারান্দায় ঐ চেয়ারেই ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতেন নিশ্চুপ হয়ে ।

পরবর্তী কালে বাবুদের মধ্যেও কেউ কেউ সেই ট্র্যাডিশন বজায় রেখেছিলেন। যাওয়ার আগে ঝড়তি-পড়তি দু’চারটে জিনিস বিক্রি অথবা ‘কানা গরু বামুনকে দান, বামুন বলে হোক কল্যাণ’ গোছের কিছু একটা রফাদফা করে চলে যেতেন। যে কারণে আজও এই ইঁট পাতার  প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা চলেছে।
           
দোতলার দক্ষিণ-পূর্বের বারো বাই তেরো পূব খোলা ঘরটা সমরেশের। অ্যাটাচ বাথ। লাগোয়া ব্যালকনি।সেখানে দাঁড়ালে সামনে পাকা রাস্তার ওপারেও সারসার কংক্রিটের আস্ফালন দৃষ্টি আটকায় । চোখ খুললেই সবুজ দেখার অভ্যাসটা বদলে নিতে এখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে  ইঁট-পাথরের অরণ্য দেখার অভ্যেস করে সমরেশ।

সেদিন সকালে ব্যালকনিতে এসে সবে দাঁড়িয়েছে , মোবাইলটা কানে নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায় তনু। কাউকে হিন্দিতে পথনির্দেশ দিচ্ছে , “হাঁ, হাঁ…সহি রাস্তাপর আয়ে হ্যায় আপলোগ। আব সিধা আ যাইয়ে থোড়ি দূর। হাঁ হাঁ…অব রুক যাইয়ে…”
গাড়িটা চোখে পড়তেই চমকে ওঠেন সমরেশ, “একি, তনু… এতো আমাদের বাগানের গাড়ি… এখানে কি করে এলো?”
ততক্ষণে চোখে পড়ে আরো দু তিনটে চেনা মুখ। ড্রাইভার বিষ্ণু, খালাসি বিক্রম আর কি আশ্চর্য… শুকরাম! গাড়ি থেকে কাগজে মোড়া কিছু একটা নিয়ে নামছে!

“চিনতে পারছেন বাবা?” তনুশ্রীর মুখে ঝলমলে হাসি।”হ্যাঁ, ও-তো বিষ্ণু, আর ও বিক্রম। আর, ওকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাব! আমাদের শুকরাম!”
“হ্যাঁ, আর ওর হাতে আপনার চেয়ারটা বাবা। যেটা ফেলে এসেছিলেন।”

অবাক চোখে চেয়ে থাকে সমরেশ, “ওটা কে আনলো… মানে ওটা তো… কিভাবে…!” কথা ওলোট-পালট হয়ে যাচ্ছিল সমরেশের।
“আসার পর শুকরাম ভাইয়া একদিন ছেলের ফোন থেকে ফোন করে, “বাবুকর কুর্সিমে মোয় কোইদিন বৈঠেক নি পারবু ছোটামাঈজি। উকে লে-ই যা।” ওকে বলেছিলাম বাগানের গাড়ি তো প্রায়ই আসে শহরে, পাঠিয়ে দিও নাহয়। আজ তাই, ও নিজেই নিয়ে এসেছে?”
-“বাড়ি চিনতে পারলো ওরা!” সমরেশের সহজ সরল প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলে তনুশ্রী।
“মোবাইলের যুগে কোনো কিছুই অসম্ভব নয় বাবা।”

ততক্ষণে চেয়ারটা নিয়ে ওপরে উঠে এসেছে শুকরাম। কাছে আসতেই শুকরামের পিঠে সস্নেহে হাত থরাখে সমরেশ। চেয়ারটা সযত্নে একপাশে রেখে তৃপ্তির অনাবিল হাসি হাসে শুকরাম। আর আচমকা চোখের কোণে বৃষ্টির আভাস পেতেই মুখ সরিয়ে চেয়ারটার গায়ে হাত বোলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সমরেশ।

গল্পটি লিখেছেন জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটা ব্লকের নয়াসাইলি চা বাগানের বাসিন্দা বিশিষ্ট গল্পকার সুকান্ত নাহা।