শীর্ষে ওঠার পথের সন্ধানে

দেবলীনা বিশ্বাস আমাদের কাছে পরিচিত এক জনপ্রিয় নাট্যকর্মী হিসেবে। তাঁর অভিনয় নির্দেশনায় মুগ্ধ হতে হয় বারবার। এবার তাকে অন্যরুপে পেলাম। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে দেবলীনা বিশ্বাসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ শীর্ষবিন্দু’। স্বাভাবিক ভাবে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ নিয়ে পাঠকের আগ্রহ থাকবে একটু বেশি। তবে বইটি পড়ে এককথায় বলা যায় নিরাশ করেননি দেবলীনা। জীবনে চলার পথে চলতে চলতে হয় অভিজ্ঞতা। আর সেই ফেলে আসা সময়ের অভিজ্ঞতাকে সৃজনশীল মানুষেরা তুলে ধরে নিজেদের মত করে। এতদিন সেই অভিজ্ঞতাকে নাটকের মধ্যেদিয়ে তুলে ধরত সে। আর এবার একটু অন্যপথে হেঁটে কবিতার মাধ্যমেই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর ভাবনার। হয়ত সেকারনেই ফেলে আসা সময়কে নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছেন কবি।

ভূমিকাটিও চমৎকার লিখেছে সে। নদীকে মানবিক স্বত্বা দিয়ে সে নদীর বহমানতার মধ্যে খুঁজে পেতে চায় সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছনোর পথকে। কিন্তু তবুও সে সেই পথের খোঁজ পায়না। তবুও নিরাশ না হয়ে সেই পথ সে খোঁজে প্রতিটি মুহূর্তে। আর সেই পথ খুঁজে চলার অভিজ্ঞতাই ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতায়। ‘প্রিজমের ভেতরে গলে পড়া আলোর দোহাই, জানতে চেওনা শীর্ষবিন্দু কোথায়’ ?  আসলে এই একটি লাইনেই সে বুঝিয়ে দিয়েছে আলোকময় এই দুনিয়ায় শীর্ষবিন্দুর খোঁজ সে একদমই জানেনা। তাই মদনমোহন বাড়ির নহবৎখানার সুর কিংবা দুরে আজানের ধ্বনি তাকে জানিয়ে দেয় শীর্ষবিন্দু না পাওয়ার কথা। ফেরা কবিতাটি বেশ লাগে। তিনি লিখেছে ‘ এভাবেও ফিরে আসা যায় / দাবার শেষ চালে মাত দিয়ে’। আসলে বেচে থাকতে হলে ফিরে আসতেই হয় এই গভীর উপলব্ধি বোধের প্রকাশ পায় তাঁর ফেরা কবিতার শেষ লাইনে। অধরা সময়, মনের অসুখ কবিতায় আছে কবির গভীরতার ছাপ। তবু পরিযায়ী পাখিরা দিন গোনে/ একদিন ঠিক মিলে যাবে সব সীমান্ত সবাইকে একসাথে মিলিয়ে দেওয়ার গভীর স্বপ্ন। বারবার হাত বাড়াই, কি জানি কি চাই ?  সত্যিই এ প্রশ্ন তো বহু মানুষের। আর সেটাই চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। প্রতিটি কবিতা শুধু দেবলীনার ভাবনা এমন ভাবলে ভুল হবে। তাঁর কবিতায় মধ্যেও খুব নিপুনভাবে তিনি পাঠকের কাছেও অনেক প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছেন। নারী না মানুষ তেমনি এক কবিতা। দুঃখ তোমায় নিলাম আপন ঘরে / শিড়দাড়ায় লাভাস্রোত অবশ করে। আসলে দুঃখও যে জীবনের এক অংশ আর তাকে মানা কঠিন হলেও তাকে মেনে নিয়ে চলতে হয় এই উপলব্ধিবোধ তাঁর একদম সঠিক। আসলে মানুষের জীবনের কোন এক সময় আসে যখন সবকিছু যান্ত্রিক মনে হয়। আর সেটার ব্যাতিক্রম হয়ত কবিও নন। নইলে লিখতে পারে নিয়ম মাফিক বসন্ত এলো / এ যেন পোড়া বসন্ত। অনেক কঠিন কথা খুব সুন্দর লেখনীতে তুলে ধরার প্রয়াস দেবলীনার সত্যিই অনবদ্য। নইলে সে লিখতে পারে ভালোবেসে বারবার মৃত্যুকে জড়িয়ে ধরি। রাজবাড়ির ঝুলবারান্দা বেয়ে / সাগর দিঘির গহীন অন্ধকারে নাগরিক সন্ধ্যাতে সে নিজেকে যেভাবে উপলব্ধি করে তা সত্যিই অতুলনীয়। নিজের আবেগের বহিঃ প্রকাশ তাঁর কবিতার বিশাল গুণ। অভিমান মানুষেরই হয়। কিন্তু তাই বলে অভিমান নিয়ে বসে থাকেনা সে। সেজন্যই অভিমানের অবিধান ফুরিয়ে যায় তাঁর বছরের শেষে। আসলে তাঁর এই ভাবনায় কোন কপিরাইট নেই কারন তাঁর মত করে অনেকেরই যাপন। সেই জন্য তাঁর নিজের রোজনামচা হয়ে ওঠে আমাদের রোজনামচা। তিনি লিখেছেন শীর্ষবিন্দুতে আছে ভালোবাসার জয়। কিন্তু আগেই কবি লিখেছেন শীর্ষবিন্দু তে পৌছন হয়না। তারমানে ভালোবাসার জয় হয়না ? কিন্তু এটা বেমানান তাঁর লেখায়। কারন ভালো না বাসলে এমন কবিতা লেখা যায় কি ?  এটা কবিকেও ভেবে দেখা উচিৎ। আর শেষ কবিতায় যেখানে তিনি লিখেছেন ‘জন্ম নেব আবার’। আসলে জীবনের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে কেউ আবার জন্ম নিতে চায় ? আসলে শীর্ষবিন্দুতে পৌছোতে হলে দরকার যে এই জীবনেরই। তাঁর আবেগ, উপলব্ধির অসাধারন ভাবে তুলে ধরেছে তাঁর এই প্রথম কাব্যগ্রন্থ।

অনুপম দাশগুপ্তের করা বইটির প্রচ্ছদও দৃষ্টিসুখ এনে দেয়। তবে ৮৭টি কবিতা আছে তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে। তাই একটা সূচিপত্র থাকা খুব দরকার ছিল। আশাকরি আগামী কাব্যগ্রন্থে সেটা থাকবে। এটা কবির কাছে প্রত্যাশা থাকতেই পারে কারন নাটকের মত কবিতাতেও থাকতে যে তিনি এসেছেন।