অব্যক্ত

Estimated read time 0 min read

__”শোনো বড় বৌমা তুমি মাছের কালিয়াটা তুলে রাখ। এমনিতে অনেক বয়স হয়েছে আমার। খাওয়া দাওয়ায় একটু সংযম দরকার। কাল তো সকাল সকাল সব লোকজন এসে পড়বে। তুমি দেখ কোন আয়োজনে যেন ত্রুটি না থাকে। এবার আমি যাই তোমার শ্বশুরমশাইকে পান দিয়ে আসি”;এই বলে দুধ দিয়ে অল্প ভাত খেয়ে উঠে যান প্রবীণা গিরিজাদেবী। মাথা নেড়ে শাশুড়ি মার কথায় সম্মতি দেয় চৌধুরী বাড়ির বড় বউ রুমকি। বাড়ির সকলের খাওয়া হয়ে গেছে,শুধু ওর নিজের খাওয়াটাই বাকি।

অবশ্য সায় দেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করারও নেই রুমকির। মরমে আর অনুশোচনার চোরাবালিতে সবসময় ডুবে থাকে ও। অবশ্য তার একটা গভীর কারণ নিশ্চয়ই আছে সেটা হল ওর ছেলে ডোডো।অংশুমান ওরফে অংশুর সাথে এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে রুমকির জীবন বেশ সুন্দর চেনা পরিচিত ছন্দে এগোচ্ছিল। কলকাতার বালিগঞ্জ এলাকার মেয়ে ও। তারপর যা হয় আর কি! মেয়ে বড় হলে প্রতিটা মা বাবার মত ওর বাবাও সৎপাত্রের হাতে পাত্রস্থ করবেন বলে খোঁজখবর করতে থাকেন। এরকমভাবেই একদিন এক বহুল প্রচলিত সংবাদপত্র মারফত খোঁজ পেয়ে দেখাশোনা করেই রুমকির বিয়ে ঠিক হল মহিষাদলের চৌধুরী পরিবারের বড় ছেলে অংশুর সঙ্গে। এককালে চৌধুরীদের জমিদারী থাকলেও বর্তমানে পরিবারের অনেকেই চাকরিবাকরি করে।সেই কড়া রক্ষণশীলতা অনেকটা ফিকে হলেও পরিবারের আভিজাত্য এখনও বহাল। নিজেকে ওই পরিবারের সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছিল রুমকি।

বিয়ের বছর দুই পর ওর কোল আলো করে ডোডো এলো। বাড়িতে প্রথম বংশধর আসায় চারদিকে খুশির আবহাওয়া, মিষ্টি বিতরণ চললো। মাস ছয় পর ধুমধাম করে অন্নপ্রাশনও হল ছেলের কিন্তু সুখের খেলাঘরে অসুখ দানা বাধলো যখন একটু বড় হবার সাথে সাথে ডোডোর মুখে কোনো বুলি ফুটল না। অনেক দেব দেবীর মন্দিরে মানত, উপবাস,ব্রাহ্মণ আর কাঙালি ভোজন করিয়েও কোনো সুবিচার পাওয়া গেল না।দেখতে দেখতে সময়ের নদী বেয়ে আট বছর কেটে গেল রুমকির জীবন থেকে কিন্তু ডোডো ভাষাহীন। নিজের সন্তানের মুখে “মা” ডাক শোনা থেকে বঞ্চিত রুমকি।

একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় ফেটে যায় ওর বুক।ডোডো মুখে কথা বলতে না পারলেও মায়ের চোখের জল মুছে দেয়। ছেলেকে কোলে নিয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় রুমকি। খাবার টেবিলে বসে এসব ভাবতে ভাবতেই হাতের এঁটো কখন জানি হাতেই শুকিয়ে গেছে ওর হুঁশ ফেরে স্বামী অংশুর ডাকে,”কিগো ঘরে যাবেনা?ডোডো তোমাকে ছাড়া তো ঘুমাবেনা। সারা ঘর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ও। চলো শুয়ে পড়। আগামীকাল মায়ের জন্মদিন। লোকজন,অতিথিরা সব আসবে।একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও আজ।” হাত মুছে ঘরে যায় রুমকি। ডোডোকে ঘুম পাড়িয়ে বারান্দায় আসে ও।

আসন্ন দুর্গাপুজো আর আগামীকাল এই বাড়ির
সর্বময় কর্ত্রী মানে ওর শাশুড়ি মা গিরিজাদেবীর জন্মদিন উপলক্ষ্যে সারা বাড়ি কুচি কুচি আলোয় সাজানো হয়েছে। সেই আলোয় রুমকি দেখতে পায় গিরিজাদেবী বসে আছেন বাড়ির ঠাকুরদালানে।এক দৃষ্টিতে দেখছেন মৃৎশিল্পী জগদীশবাবুর শেষ মুহূর্তে নিপুণ হাতে দুর্গাপ্রতিমা গড়ার তুলির টান।

নিজে একজন নারী হয়ে কোথাও যেন রুমকি শাশুড়ির অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা বুঝতে পারে। শেষ বয়সে এসে নাতি ডোডোর এইরকম অবস্থা উনি সহ্য করতে পারেননা। মুখে অবশ্য উনি রুমকিকে কিছুই বলেন না;দোষারোপ করেন না শুধু বলেন,”সবটাই আমার কপাল বৌমা। নইলে মা দুর্গা এমন কেন করবে বল?”

নিজের মনেও কোন উত্তর খুঁজে পায়না রুমকি। ডোডোকে নিজের আরো কাছে আঁকড়ে ধরে ও।চোখ দুটো বড় উজ্জ্বল ডোডোর। মনে হয় কত কিছু বলতে চাইছে কিন্তু কে বুঝবে ওর ভাষা?বছর দেড়েক হল ডোডোকে একটা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করেছে রুমকি,যদি কিছু উন্নতি হয় ওখানে স্পীচ থেরাপি চলে।আকার ইঙ্গিতে অনেক কিছু এখন বলতে পারে ডোডো।এদিকে রাত পোহালে কাল গিরিজাদেবীর জন্মদিন। উনি আর ওনার স্বামী মিলে অনেক করে বারণ করা সত্বেও ছেলেরা বিশেষ করে বড় ছেলে অংশু শোনেনা বলে,”সারাজীবন তোমরা আমাদের প্রতি দায়িত্ব;কর্তব্য পালন করলে।আমরা এগুলো করে যদি একটু শান্তি পাই তাহলে বাধা দিওনা মা”। নিজেদের মায়ের জন্মদিন পালন করবেই করবে ওরা। সবকিছুর আনন্দের মধ্যেও যেন গলার কাছে একটা না বলা কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে ওনার। ঠাকুর দালানে বসে মা দুর্গার মুখের দিকে চেয়ে গিরিজাদেবী বলেন,”একি করলে মা!জীবনের বেলাশেষে এরকম অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। নাতিটার সাথে কথা বলতে পারিনা মন খুলে। ঠাম্মি ডাক শুনতে পাইনা ওর মুখে। সেইভাবে কাছে টানতে পারিনা। আগামীকাল কত উপহার পাব অন্যদের কাছ থেকে কিন্তু সব উপহারের সেরা উপহার হত যদি ডোডোর মুখে ভাষা ফুটতো।” এলোমেলো ভাবতে ভাবতে গিরিজাদেবীর চোখে ঘুম চলে আসলে নিজের ঘরে উনি বিছানায় গা এলিয়ে দেন। অন্ধকার রাত পেরিয়ে চলে আসে শিউলি ফুলের গন্ধ মাখা এক নতুন ভোর।

গিরিজাদেবীর ঘুম ভাঙ্গলো এক নরম হাতের স্পর্শে। চোখ মেলতেই দেখেন ডোডো একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওনার বিছানার পাশে। হাত দুটো পিছনে লুকানো কি আছে ওর হাতে?চোখে অনেকটাই ঝাপসা দেখেন উনি। বিছানার পাশে সেগুন কাঠের তেপায়া থেকে চশমাটা চোখে দেন উনি জিজ্ঞাসা করেন,”কি ডোডোবাবু কি এনেছ এই বুড়ির জন্মদিনে?”ডোডো ঠাম্মার হাতে তুলে দেয় শিশির ভেজা ভোরের এক মুঠো শিউলি ফুল। গিরিজার বুকে এতদিনের জমে থাকা কান্নাগুলো মুক্তোর বিন্দুর মত টুপটাপ যেন ঝরে পরে ফুলের মধ্যে। ঠাম্মার চোখের জল মুছে দিয়ে ডোডো হাত ধরে টানতে থাকে ওনাকে।গিরিজা বলেন, “কোথায় যাব দাদুভাই?কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে!”;তারপর ওর হাত ধরে যেতে থাকেন মন্ত্রমুগ্ধের মত। ডোডো নিজের ঘরে গিয়ে আঁকার খাতা পাতা খুলে দেখায় একটা ছবি তাতে রং বেরঙের পেন্সিল দিয়ে লেখা “হ্যাপি বার্থডে”। এই প্রথম নাতির কথা না বলতে পারার সব দুঃখ ভুলে ওকে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে জড়িয়ে ধরেন গিরিজা। উনি বুঝতে পারেন আসলে কথা বলতে না পারলে কি হবে ডোডোর প্রখর বোধশক্তি রীতিমত অবাক করার মত। এর চেয়ে অন্য সকলের দেওয়া উপহার অনেক ম্লান।

_”মা কোথায় গেলেন আপনি? তখন থেকে আপনাকে খুঁজছি নিন এই পায়েসটুকু খেয়ে নিন দেখি”; রুমকি ঘরে ঢুকে ঠাম্মা নাতির ভালোবাসার দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই চোখ জলে ভিজে আসে ওর।গিরিজাদেবী বলেন,” বড় বৌমা এতদিন ভাবতাম অনেক দুর্ভাগ্য ছিল বলে এরকম নাতি পেয়েছি কিন্তু আজ বলছি অনেক পূণ্যকর্ম করলে তবে এরকম নাতি পাওয়া যায়। ধন্য ওর সাধারণ জ্ঞানবোধ,বাড়ির সকলে যখন আমার জন্মদিন নিয়ে আলোচনা করছে,উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে ও সেটা ঠিক দেখে বুঝতে পেরে ঠাম্মির জন্য উপহার দিয়েছে। আমার সব জন্মদিনের সেরা উপহার পেলাম আজ।” গিরিজাদেবীর স্বামী রণেন চৌধুরী ঘরে ঢোকেন এবার বলেন, “বলেছিলাম তো আমি কার নাতি দেখতে হবে তো? দেখেছ ঠিক সময়ে প্রমাণ পেলে তোমরা।”

ডোডোর হাত ধরে ঠাকুরদালানে যান দাদু আর ঠাম্মা মিলে। ওয়েবক্যামে সম্পর্কের এই মিষ্টিমধুর ছবি তুলে রাখে ডোডোর বাবা অংশু। গিরিজা দেবী আর ওনার স্বামী রণেনবাবু দুজন মিলে মা দুর্গার আশীর্বাদ নিয়ে ঠিক করেন রাত পোহানো শরৎকালের সকালের সোনাঝরা রোদে আগামীর বাঁশিটা তুলে দেবেন চৌধুরী পরিবারের উত্তরসূরী ডোডোর হাতে। অব্যক্ত ভাষাগুলো বড় জীবন্ত হয়ে ওঠে আজ। মা দুর্গাও মুচকি হাসেন। বলা হোক বা না বলা এই পৃথিবীতে সকলে তো ওনারই সন্তান;অমৃতের পুত্র।

        ............পুষ্পিতা ভৌমিক

You May Also Like

More From Author