শহরের উত্তর প্রান্তের অপেক্ষাকৃত অলস ঝিমানো পাড়াগুলোয় কাঠফাঠা দুপুর বাঁ মেঘমেদুর বিকেলের তন্দ্রালসতা কাটিয়ে যদি দরজার কড়ানাড়ার সাথে মিহি মিষ্টি গলায় ডাক শোনেন – একটু মিটারটা দেখব। তবে দরজা খুলে যে ছোটখাটো মানুষটিকে আপনি দেখতে পাবেন সে স্ববিরোধিতায় ভর্তি। চার ফুট দশ কি পাঁচ ফুটের এই মানুষটি সবসময় চনমনে। চোখে বোতলের পেছনের মত মোটা গ্লাস। গালে মাথায় খোঁচা খোঁচা চুল। কৃশ চেহারা। কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা। বয়স অনুমান করা কঠিন। তবে ৩৫ থেকে ৪৫ এর মধ্যে বলা যায়। সবচেয়ে স্ট্রাইকিং হল ওর মুখের হাসি। একটা স্মিত গোবেচেরা হাসি ওর মুখে ঝুলে থাকে সবসময়। অতি বিনয়ী এই লোকটি হল পার্থ। ইলেকট্রিক অফিসের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বড়বাবুর একমাত্র ছেলে।
সত্যবাবু আমাদের ইংলিশের টিচার। বায়োগ্রাফি শেখাতে গিয়ে মনীষীদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড যথাসম্ভব অ্যাভয়েডই করে যেতেন। বাবা মা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলে বলতেন – বাপ-মা দিয়ে কি হবে রে বোকা! বংশপরিচয় নয়, কাজই মানুষের আসল পরিচয়। বলে তা জাস্টিফাই করার জন্য ভারী ভারী শ্লোক আওড়াতেন। পরে বাবার কাছ থেকে শুনেছিলাম সত্যবাবুরা ছিলেন মস্ত জমিদার। পরে নিজের বাপের জমির পাট্টা বিলিয়ে দিয়েছিলেন অভাবী উদ্বাস্তু মানুষদের। তাই পার্থকে introduce করাতে গিয়ে ‘বড়বাবুর ছেলে’ কথাটিতে যদি আপত্তি থাকে তাহলে বলা চলে – পার্থ WBSEDCL- এর কন্ট্রাকচুয়াল কর্মী। কাজ বাড়ি বাড়ি ঘুরে মিটার রীডিং নেওয়া ও ওর হাতের ছোট্ট যন্ত্রের ছোট্ট ছোট্ট নব্ টিপে ছোট ছোট বিল বের করে গেরস্তর হাতে ধরানো।
স্বপ্নটা পার্থ স্কুলবেলা থেকে প্রায়ই দেখত। একটা সাদা টগবগে ঘোড়া। তার পিঠে সওয়ার হয়ে মাটি থেকে অনেক উপর দিয়ে সে উড়ে যাচ্ছে। ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসছে তার চেনা ঘরবাড়ি, মানুষ ও জাগতিক পরিধি। মা তখনো বেঁচে। মায়ের কাছে গিয়ে একদিন তার স্বপ্নের কথা বলছিল পার্থ। মা খুন্তি নাড়তে নাড়তে মন দিয়ে শুনছিলেন। পাশে তার হিসেবি বাবা। গতরাতে আনা গালামাল ফর্দের সাথে মেলাতে মেলাতে চশমার ফাঁক দিয়ে আড়চোখে পার্থর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন – গরিবের ঘোড়া রোগ। পরে সে যখন হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট হল। রাতের স্বপ্ন দিনেও দেখতে লাগল। তবে ঘোড়া নয় বাইক। যে সে বাইক নয়। বুলেট। লাল টুকটুক। যখন যাবে – দাপিয়ে, পাড়া কাঁপিয়ে। তখন সদ্য লঞ্চ হয়েছে ১০০ সিসি সব বাইক। নানা কোম্পানির। নানা রঙের। ইয়ামাহা, হিরো হন্ডা, সুজুকি আরো কত কি। কিন্তু বুলেটের পাশে সবই যো হুজুর টাইপ লাগে। মা বলেছিলেন – বাবা মাধ্যমিকে স্টার পা, আমার জমানো পয়সায় তোকে ‘অন্ডা’ কিনে দেবো। পার্থ স্টার পায় নি। হন্ডাও জোটে নি কপালে। অবশ্য তাতে পার্থর দুঃখ ছিল না কোনও। কারণ লক্ষ্য তো তার হন্ডা নয়, রয়্যাল এনফিল্ড।
বৈদ্যদার দোকানে সেদিন বিশাল শোরগোল। মাকাল জয়দেব কিছু একটা বলছে রসিয়ে রসিয়ে। আর তাকে ঘিরে সকালের চাপায়ীরা। চায়ে তৃপ্ত চুমুক দিচ্ছে আর জমিয়ে স্বাদ নিচ্ছে জয়দেবের গল্পের। সাথে ওর এক্সপ্রেশান ফ্রী। শিলিগুড়ি মোড়ে ওর দোকান। বাইক ও গাড়ির সীট ও তার কভার বানাবার।
বাইকটা আমার দোকানের সামনে রাখা। সাইড স্ট্যান্ড করা। সোজা করে জাস্ট মিডিল্ স্ট্যান্ড করেছি। ওমনি একজন হাঁহাঁ করে ছুটে এল। তাকিয়ে দেখি মিনি পার্থ (মিনি পার্থ বিড়ির আদলে সার্থক নামকরণ বটে)। ইলেকট্রিক অফিসের মিটার রীডার। বলে কি, “কি করে করলে একটু দেখাও দেখি। আমি আর বউ মিলে বহুত চেষ্টা করলাম। কিন্তু মাঝের স্ট্যান্ড দাঁড়াল না।
দমকে দমকে হাসির ফোয়ারা উঠল। জয়দেবের গল্প তখনো শেষ হয়নি।
স্ট্যান্ড থেকে নামালাম। আবার স্ট্যান্ড করার পর নামাতে গেছি সীটের মাপ নেবো বলে, তখন বলে, “একটু দাঁড়াও। দেখে নি। মিডল্ স্ট্যান্ড করে রাখলে গাড়িটাকে কিন্তু ব্যাপক লাগছে।“
বিষয়টি আরও স্পাইসি করে তুলল জয়দেব ওর টিপিক্যাল খিকখিক খিল্লিতে। সাথে যোগ দিল ওর শ্রোতাকুল। বিভিন্ন বয়স, শেপ ও সাইজের। সিরাজ মাস্টার তার চশমার ফাঁক দিয়ে এক কঠোর দৃষ্টিপাত করলেন সেদিকে। অপেক্ষাকৃত প্রবীণদের দল একটু শঙ্কিত হয়ে পড়লেন – সিরাজ সামাজিক অবক্ষয় বা সমাজের লুম্পেনায়ন সম্পর্কে সাত সকালে একটা বক্তিমোই না ঝেড়ে দেয়। আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণ করে সিরাজ শুধু জলদগম্ভীর স্বরে বললেন – বৈদ্য, তোমার দোকানটাকে তো এরা লাফিং ক্লাব বানিয়ে ছেড়ে দিল।
মায়ের মৃত্যুর পর একটু গুটিয়ে গিয়েছিল পার্থ। বাড়িটা আর বাড়ি রইল না। কেমন যেন মেস মেস। সব ছন্নছাড়া। আর সেই মেসে বসবাস দুই যুযুধান পক্ষের – বাপ ও ব্যাটা। বাপের চোখে প্রখর বাস্তব। সবকিছু মেপে নেয় লাভ-ক্ষতির নিক্তিতে। চোখে সিকি-সন্ধানী দৃষ্টি। ছেলের চোখে তখন স্বপ্নের ঘোর। হায়ার সেকেন্ডারিতে অল্পের জন্য থার্ড ডিভিশানের থাবা থেকে বেঁচে কলেজজীবন। স্বভাবতই পাস কোর্সে বি এ। ওখানেই আলাপ মায়ার সাথে। ক্রমশঃ ক্ষীয়মান তার দৃষ্টিতে পৃথিবী ঝাপসা। বারো ক্লাসের পরীক্ষা পাস করেছে রাইটার নিয়ে। ওর বাড়ি কলেজ থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। কোনদিন ভাই বা বোন ওকে কলেজে দিয়ে যেত। কলেজ শেষে আবার আসত নিতে। কলেজে যতক্ষণ থাকত, যতক্ষণ এ ক্লাস থেকে ও ক্লাসে ঘুরতো, সাথে থাকত ওর বান্ধবীরা। ভালবাসার হাত বাড়িয়ে। আর সেই হাত ধরতে কোন সংকোচ ছিল না মায়ার। ব্যাপারটার মধ্যে কোন জটিলতা ছিল না। আমি দেখতে পাই না। তোমরা পাও। তাই তোমাদের দায়িত্ব তোমাদের চোখ দিয়ে আমায় দেখানো। তাই এতে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা ইগোর কোন জায়গাই নেই।
প্রথম প্রথম কলেজে কমই যেত পার্থ। মন বসত না। স্কুলের বন্ধুরা কলেজে এসে কেমন ছাড়া ছাড়া। ঠিক জমত না। মনে হত সারা শহর টইটই করে বেড়ায়। স্বপ্নের লাল টুকটুক বুলেটের সাধ তখনো ছিল। কিন্তু সাধ্য নয়। তাই ক্লাস নাইনে পাওয়া ওর রংচটা লাল বি এস এ এস এল আর – ই ছিল ওর সাথী। সদ্য কৈশোর পেরনো ওর সমস্ত জোশ নিংড়ে ও চাকায় তুফান তুলত। ওর ক্ষীণকটিতে সাপটে গোঁজা শার্ট নৌকার পালের মত ফুলে ফুলে উঠত। আর কানের পাশ ঘেঁষে বাতাসের সাঁইসাঁই ওকে উদ্দাম করে তুলত। ক্লাস কেটে চ’রে বেড়াতো গোটা শহরতলি। আব্দুলঘাটা থেকে কাশিবাটি। নদীর ঘাটে বসে নদীর কলকল শুনতে শুনতে, সিগারেট টানতে টানতে মনে হত সিগারেটের মতই ফুরিয়ে যাবে ও। ওর একাকীত্ব। ওর ভালোলাগা। ওর স্বপ্ন, সাধও ওর সাথে ছাই হয় যাবে। দমকা হাওয়ায় নদীর ওপারের শ্মশান থেকে ভেসে আসতো চোখ- জ্বলুনি ধোঁয়া। সাথে মাংস পোড়া গন্ধ। ওখানে দাহ করেছিল ওর মাকে। তাও প্রায় দু’বছর হতে চলল।
মায়ার সাথে পার্থর প্রথম আলাপ যথেষ্ট বিড়ম্বনার। ওদের কলেজের ক্যান্টিন থেকে লাইব্রেরী যাবার যে করিডোর তা ‘L’ প্যাটার্নের। আর ঐ L – এর শার্প বেন্ডে মুখোমুখি হয়ে অনেক কষ্টে হেড অন কলিশান এড়িয়েছিল। কি রকম ক্যালাস !
মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল – কিভাবে হাঁটো ! কানা নাকি?
মেয়েটি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওর পেছনেই যে ছোটখাট, গোলগাল, তুলতুলে মেয়েটি ছিল, সে তেড়ে এল। কন্ঠে খরখরে নারীবাদী খ্যাংরাকাঠি শব্দপ্রবাহ। ভদ্রভাবে কথা বলতে জানোনা? অসভ্য! ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই ঝামেলা সামলে দিয়েছিল চিংড়ি – ওদের ক্লাস রিপ্রেসেন্টেটিভ। ওদের থেকে একটু নিরাপদ দূরত্বে এসে বলেছিল – শালা ঢ্যামনা! দুটো এক্সট্রা চোখ লাগিয়ে রেখেছে। দেখতে পাস না মেয়েটা অন্ধ? চিংড়ি হয়তো আরো কিছু বলত। কিন্তু পার্থর ন্যাতানো পাপড়ের মতো এক্সপ্রেশান দেখে থেমে গিয়েছিল। পার্থর মনে অপরাধবোধ ও একটা গ্লানি কাজ করছিল। কে জানে চশমার পেছনে দৃষ্টি ঝাপসা হয়েছিল কিনা বেচারি মেয়েটির জন্য। সেদিন প্রাপ্তিযোগ ছিল চিংড়ির। বাপির দোকানের দুটো রসুনের শিঙাড়া আর দু’দুটো সিগারেট।
সেই কলিশানের পর থেকেই কলেজে আনাগোনা বাড়ল পার্থর। মায়ার টান! কি করে যেন ক’দিন পর ওদের একসাথে দেখা যেতে লাগল কলেজ ক্যাম্পাসে। একজন প্রায় অন্ধ। আর একজনের চোখে আতসকাচের মত পুরু লেন্স। ক্লাস কেটে শুরু হল শহর পরিক্রমা। এবার একা নয়। দোকা। সাথী সেই রঙচটা লাল সাইকেল। চালক পার্থ। ক্যারিয়ারে মায়া। একজন দেখে চোখ দিয়ে। আর একজন ছুঁয়ে। এখন পার্থ ভাবলে অবাক হয়। কতটা বিশ্বাস থাকলে এভাবে অন্যের হাতে অন্ধের মত ( মত কেন অন্ধই তো) নিজেকে সমর্পণ করা যায়। এভাবেই হঠাৎ সেকেন্ড ইয়ারের শেষের দিকে ওদের বিয়ে। ওর ত্যাজ্যপুত্র হয়ে যাওয়া। চিলতে একটা ঘরে ওদের অপটু সংসার। ট্যুইশান – দিনরাত। স্বপ্ন দেখার ফুরসত কই? বছর কয়েক বাদে যখন দম ফেলবার ফুরসত পেল, তখন সবকিছু ছকে বাঁধা পড়ে গেছে। একবার মায়া বলেছিল – একটা স্কুটার নিয়ে নাও না। সাইকেল করে এত দূরে দূরে টিউশানি। ও বলেছিল – ধুস্! আমি পংক্ষিরাজ কিনব। পেছনে বসবে তুমি। আমরা মস্ত্ উড়বো। পয়সা জমাচ্ছি। এর প্রায় বছর খানেক বাদে ওকে নিয়ে গিয়েছিল বুলেটের শোরুমে। ভেতরে ঢুকেছিল ওয়াচম্যানের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি উপেক্ষা করেই। মায়া তখন পুরোপুরি অন্ধ।
ম্যাডাম, লাল রঙটা দেখতে পারেন। নতুন। চেরী ফিনিশ।
সেলসম্যান পেছন ছাড়ে না। ছাড়ল যখন বুঝল মায়া অন্ধ। ব্ল্যাক আর চেরী কালার ওর কাছে সমান ব্ল্যাক। পার্থর বুকটা ভরে উঠল যখন মায়া ওর চাইল্ডহুড ক্রাশের গায়ে হাত বুলিয় বলল – বাহ! বেশ দমদার মনে হচ্ছে। সীটে হাত বুলিয়ে বলল – তিনজন আটবে তো?
বছর ঘুরতেই ওদের অভাবের সংসারে এল বাবু। পরের পরের বছরই দু বছরের বাচ্চা ফেলে মায়া হাওয়া। দিন চারেকের জ্বরে। ডাক্তার বলেছিলেন – এনসেফেলাইটিস। পার্থ বিমূঢ়। ঘোরের মধ্যে কেটে গেল কয়দিন। মায়ার
বাড়ির লোক ও তার বাবার যাতায়াত শুরু হল। অবশ্য শুরুর থেকেই ওদের সাথে ছিল রুমা- মায়ার তিন বছরের ছোট বোন। পার্থর তখন নাজেহাল অবস্থা। একদিকে ওর ক্রমবর্ধমান টিউশানি। আর আরেকদিকে দুই বছরের বাচ্চার দেখ্রেখ্। অনেকটাই সামলে দিয়েছিল রুমা। ও এসে সারাদিন থাকত। বাবুকে কোলে কোলে রাখত। এভাবেই বাবুকে কোলে রাখতে রাখতে ওর অজান্তেই রুমা কবে যেন বাবুর মা হয়ে গেল। একদির পার্থর পাওয়ার গ্লাসের দিকে চোখ রেখে রুমা অকপট বলেছিল – পার্থদা, আমায় বিয়ে করবে? ক’দিন দোটানায় থেকে পার্থ রাজি হয়ে গেল। এখন ভাবে ভুল করেনি। এখন ওরা সুখী পরিবার। সচ্ছলতাও এসেছে খানিকটা। ওর কালো বুলেটের ট্যাঙ্কের ওপর বাবু আর পিলিয়নে রুমাকে বসিয়ে ছুটির দিন বিকেলে হাওয়া খেতে বেরোয়। তবে আফশোস একটাই। মায়াকে চড়ানো হল না ওর সাধের পংক্ষিরাজে। মায়ার কথা ভেবেই ও কালো বুলেট নিয়েছে। মায়ার কাছে সব রঙই তো কালো। পংক্ষিরাজের সে স্বপ্নটা সে স্কুল লাইফে দেখত, সেটা এখনো দেখে। কিন্তু উইথ সাম্ অ্যাডিশান অ্যান্ড অলটারেশান। দেখে ওর সাধের পংক্ষিরাজের পিঠে উড়ে যাচ্ছে ও, মায়া, রুমা। আর বাবু পংক্ষিরাজের গলা ধরে হাসিমুখে ঝুলে আছে। এই বাবু বুঝি পড়ে গেল। ঘুম ভেঙে ঘেমে নেয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসে পার্থ। ভাবে একটা ন্যানো হলে মন্দ হত না।
………..অনির্বাণ ঘোষ