মা দুর্গা প্রায় ঘন্টা খানেক আগেই পৌছে গেছেন তাঁর স্বামীর বাড়ি, কৈলাসে।আজ মায়ের আরেক রুপ। তাঁর ছেলে মেয়েরা মায়ের সাথে কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না। কারণ ভীষণ মন খারাপ মায়ের। বাবাবাড়ী থেকে ফিরে প্রতিবারই মন খারাপ থাকে কিছুসময় তাঁর, কিন্তু আজকের পরিস্থিতি কিছুটা থমথমে। কাপড়চোপড়ও বদল করেননি। সেই যে বসে আছেন, আছেনই। কথাবার্তা বন্ধ। চোখের তারায় কষ্টের রেখা আর ক্ষোভের আগুন দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। এ কদিনের অগোছালো সংসার পরিপাটি করারও কোন তাড়া নেই। কি এক বিমর্ষতা আর অস্ফুট দুঃখের জ্বালায় মুখখানা তপ্ত শিখার মতো জ্বলেই যাচ্ছে। প্রিয় পুত্র গনেশের ক্ষুধার বিষয়েও আজ মা নির্লিপ্ত। দিদিরা যা পারছেন করছেন কোনমতে। সকলেই বাবা ভোলানাথ এর অপেক্ষায় অস্থির। বাবা বাড়ি নেই, কোথায় আছেন কেউ বলতে পারছেন না। অবশ্য বাবার এমনই ধারা। কখন কোথায় থাকেন, বলা মুশকিল। তবে আজ বাড়ি ফিরবেন তা যত বেলাই হউক। আজ যে তার সকল শক্তির কেন্দ্রবিন্দু, তার প্রাণের(!) স্পন্দন দেবী দুর্গা বাড়ি ফিরবেন, সে তার অজানা নয়। কিন্তু কখন ফিরবেন সেটাই ভাবনার বিষয়। লক্ষী দেবী, সরস্বতী দেবী, কার্তিক দেব সহ সব ভাই বোনদেরই এক চিন্তা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাবার ফেরা জরুরি। মা কে সামলানো বাবা ছাড়া আর কে পারবে? এসব ভাবনা আর টালমাটাল অবস্থায় কেটে গেল আরও বেশ কয়েক ঘন্টা। হঠাৎই নন্দীর গলার আওয়াজে বোঝা গেল বাবা ভোলানাথ ফিরে আসছেন। বাবা আসতেই দরজায় এগিয়ে গেলেন কার্তিক, “বাবা তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে যাও, আজ খবর খারাপ, যাও যাও দেরি করো না।” ওবাব্বা, কেন রে? মামাবাড়ি ঘুরে এলি, কত আনন্দ করেছিস নিশ্চয়ই, তোদের মায়ের তো আরও আনন্দ ছিল, বাবা বাড়ি গেছেন বলে কথা! ঘটনা কি?” ঘটনা বলার সময় নেই, তুমি মায়ের কাছে যাও তো! ভোলানাথ ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলেন প্রিয়তমা স্ত্রীর ঘরে। ” কি গো, বাবা বাড়ি থেকে কি নিয়ে এলে আমার জন্য? মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন?” বার কয়েক ডাকাডাকির পরে মা দুর্গা গনগনে দৃষ্টি মেলে চাইলেন। সে দৃষ্টি দেখে তো ভোলানাথের ত্রাহিত্রাহি অবস্থা। ভীত কন্ঠে জানতে চাইলেন, কি হয়েছে বলবে তো! এবার মা দুর্গা গমগমে কন্ঠে জানতে চাইলেন, আচ্ছা বলো তো আমার – আমাদের মোট কয় সন্তান? ভোলানাথ এবার দিব্যচোখ মেলে ঘটনা বুঝে, হেসে জবাব দিলেন, ও কিগো আমি কেন,তুমি মা, তোমর চেয়ে এর উত্তর আর ভালো কে দিতে পারে? এবার গর্জন উঠলো দেবীর কন্ঠে, জানো তো তোমার ইচ্ছা ছাড়া আমি কিছুই করিনা, আসলে তুমি আর আমি মিলেই সম্পূর্ণ হই। তোমার জ্ঞান,আমার শক্তি,ধৈর্য, ভালোবাসা দিয়েই এ জগৎ সংসার সৃষ্টি, সৃষ্টি এই কোটি কোটি সন্তানদের পৃথিবী পরিক্রমণ। তুমি চাও বলেই পৃথিবীকে সাজানো হলো নানা বর্নের, নানা চিন্তার, বিশ্বাসের মানুষ দিয়ে, যারা আমাদেরই সন্তান। কিন্তু আমরা কি সত্যি পেরেছি এদের অন্তরে-বাইরে সত্যিকার মানুষ হিসাবেই সৃষ্টি করতে? এরা মানুষ, অথচ মানবতার ধারধারে না, এদের শ্রদ্ধাবোধ কুয়োর চারদেয়ালে আটকে পরা, এদের বিবেক বধির, তবে এদের অফুরন্ত সম্ভাবনা দিয়ে সৃষ্টি করার অর্থ কি? এর চেয়ে কীটপতঙ্গ দিয়ে পৃথিবী সাজালেই কি ভালো হতো না? তোমার জ্ঞান এ বিষয়টা ভাবলো না কেন? জিজ্ঞেস করছিলে বাবা বাড়ি থেকে তোমার জন্য কি এনেছি, জানতে চাও কি এনেছি? ” ভোলানাথ আর রসিকতায় গেলেন না। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে তিনি নিশ্চুপ হয়ে রইলেন। উত্তর না পেয়ে এবার দেবী নিজেই বলে উঠলেন, মনে পড়ে সেই মহিষাসুরবোধ যুদ্ধের কথা? দেখি আমিও আমার ধৈর্য এর শেষ সীমা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।” এবার ভোলানাথ কাতর কন্ঠে জানতে চাইলেন, তারপর? মা দুর্গা দৃঢ় কন্ঠে এক বিচিত্র হাসির রেখা ঠোঁটে নিয়ে আনমনে শুধু বলে উঠলেন” গর্জো গর্জো ক্ষণং মূঢ়,যাবৎ……”কেন বললেন, কাকে বললেন সে ভোলানাথের দিব্যচোখেও ধরা পড়লো না। নাহ, এবারকার ভ্রমণ এমন হবে জানলে ভোলানাথ কি আর এই সংকটে পড়তেন! কেন যে তাঁর দিব্যচক্ষু বন্ধ রেখেছিলেন, এ ভাবনাতেই নাজেহাল দশার সূচনা হলো। কিছু একটা তো করতেই হবে এখন। কি করবেন সেই চিন্তা নিয়েই আবার গৃহ ত্যাগী হতে হবে তাঁকে। না আর ভালো বোধ করছেন না, প্রলয় নৃত্যের মহরা কি শুরু করবেন,ভীষণ উদবিগ্ন হৃদয়ে নন্দী, ভিরিংগি কে নিয়ে আবারও পথে নামলেন ভোলানাথ। পরের ঘটনার জন্য পাঠক কে অপেক্ষা করতে হবে…