বাইরের বিকেল

সকাল থেকে এমনিতেই মুড অফ ছিল। কাল সরস্বতী পুজো, অথচ বৃষ্টির সদয় দৃষ্টির কারণে কোনো কাজই গুছিয়ে আনা হয়নি। কালকের দিনটা নিয়ে সেই ছোট থেকেই উৎসাহিত থাকি, আর এবারেও তার ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু কথায় আছে ‘কপালের নাম কপালের নাম গোপাল’।

     যাইহোক, বিকেলের দিকে যা থাকে কপালে বলে বেরিয়ে পরি। মা-কাকি দের বাজারে পাঠিয়ে, ভাই-আমি ভেনাস মোরের দিকে যাই মায়ের মূর্তির খোঁজে। বৃষ্টিতে ঠান্ডার ঠেলা উপভোগ করতে করতে শিলিগুড়ি হাসপাতালের রোডে এসে দাঁড়াই। দেখি, তখনও থাকি থাকি মূর্তি সাজানো রয়েছে রাস্তার পাশে।

       দেখে কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম, এতক্ষণে মূর্তির সংখ্যা অনেকটাই কমে আসার কথা। পছন্দসই মূর্তি বোধহয় পাবনা এই ভাবনা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। তো কিছুটা আনন্দ নিয়েই অস্থায়ী দোকান গুলোর দিকে এগিয়ে যাই। যখন চাহিদার বাইরে কোনো কিছু পাওয়া যায়, মানুষের মন তখন আরও অধিক চায়। আমাদের ব্যবহারও অনেকটা ওমন হয়ে ওঠে, আমরা ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না কোন মূর্তিটা নেব।

        এমনই এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ভাই দোনামনা করছিল। হঠাৎ দোকানের লোকটি ভাইয়ের উপর তেরে আসে এবং গজগজ করতে থাকে। তখন আমার একটা কল আসায় আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। চেচামেচি শুনে কলটি কেটে দোকানের সামনে এসে দাঁড়াই। লোকটি তখনও গজগজ করছিল। আমি কিছুটা দৃঢ়তার সাথে লোকটিকে থামিয়ে ভাইকে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে। ভাই বলে, ‘আমি দুটো মূর্তির মধ্যে ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না কোনটা নেব’, তারপর সামনে একটি মূর্তি দেখিয়ে বলে, ‘যখন উনি ভেতরের মূর্তিটা বেধে তুলেছিল তখন আমি এই মূর্তিটা নেব বলি, আর তা শুনেই উনি তেড়ে আসেন’।

        শুনে আমার একটু রাগই হয়,লোকটিকে একবার দেখে খানিকটা ছিটগ্রস্ত বলে মনে হয়নি এমনও নয়। আমি তখন তাকে একটু কড়া করেই কথা শোনাই। তাতে লোকটি আমর চড়াও হয়, এতে আমার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। আমিও প্রতিত্তোরে, আচ্ছা করে লোকটির উপর চড়াও হবার উদ্দ্যোগ নিতে যাব এমন সময়, পেছন থেকে একটি ছেলে আমার হাত আটকে ধরে। ছেলেটি আমায় ধাতস্ত করে, পাশে ওর দোকানের সামনে নিয়ে আসে। আমি সাথে ভাইকেও সরিয়ে নেই। ছেলেটির নাম চিনু, আর ওই লোকটি ওর পিসে হয়।

          চিনু জানায়, কাল তারা ধূপগুড়ি এসেছে, গতকাল কিছুটা বিক্রি হলেও আজ সকাল থেকে বৃষ্টির কারণে মূর্তি তেমন একটা বিক্রি হয় নি। তাঁরা যে টাকা দিয়ে মূর্তি কিনে এনেছিল সেই টাকাই নাকি এখনও উঠে আসেনি। কাল সকালের আগে যদি মূর্তিগুলো না বিক্রি হয় তাহলে, তাদের মূর্তি গুলে এখনাই ফেলে যেতে হবে। কারণ এগুলো ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভাড়া পোশাবে না। আর বাজারের যা অবস্থা তাতে লাভ তো দূরে থাক, এখন তাদের টাকাই ডুবতে বসেছে।

          এমনিতেই লকডাউনে সবার অবস্থা তথইবচ। তাই পুজোর আগে কিছুটা টাকা ধার করে ওরা, সবার সাথে ভিরে মূর্তি বেঁচেতে শিলিগুড়িতে এসেছে। কিন্তু এই অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির কারণে সবার মাথায় হাত পড়ছে। এই অবস্থায় বাড়ি ফিরে কি মুখ দেখাবে তা ভেবে পাচ্ছে না। এই অবস্থায় ভাই এসে এভাবে দোকানের সামনে এটা ওটা করতে থাকায়, তিনি মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। এই কারণে সে অনেকবার ক্ষমা চায় আমার কাছে। আমি প্রত্যুত্তরে কি বলব, বা মিথ্যে সান্ত্বনা দেব কি না বুঝে উঠতে পারিনি।

         তারপর আর সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াইনি বা বলা ভাল দাঁড়ায়ে থাকতে পারিনি। ছেলেটিকে ডেকে সেই বাধা মূর্তিটাই তুলে দিতে বলি, আর তার প্রাপ্য তাকে বুঝিয়ে দিয়ে রওনা দেই। নাহ এইবার আর দড়দাম করতে পারিনি। যাওয়ার সময় দেখেছিলাম, সেইগ্রস্ত লোকটি কেমন শান্তভাবে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে।

বাড়ি ফেরার সময় একটা ভাবনা ঘুরেফিরে মাথায় আসছিল। সব বৃষ্টি সবার জন্য সুখকর হয়না, চোখের জল যখন রাস্তার বৃষ্টির জলে গিয়ে মেশে তখন তাদের আর কোনো আলাদা পরিচয় থাকেনা।