এই বকুলবাগানের প্রতিটা লোক প্রায় প্রতিটা লোকের খবর রাখে — মানে এমনিতেই খবর চলে আসে , জায়গাটা এতই ছোটো ।কারো বাড়িতে বিয়ে অন্নপ্রাশন জন্মদিন যাই হোক না কেন বকুলবাগানের একে অপরের নিমন্ত্রিত সবাই জানে। আবার শোকে তাপেও একে অপরের সাথে আছে ।যেন একটি বর্ধিত পরিবার।
আমার বাড়ি পাড়ার শেষ প্রান্তে ।আর ঠিক আগের বাড়িটাই মুখার্জিদের । এখন প্রায় ভগ্ন দশা। পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমি এই বকুল বাগানে বাড়ি করি ঐ মুখার্জিদের জমি কিনে নিয়ে ।অবনী মুখার্জী বাড়ির কর্তা ছিলেন। দীর্ঘদেহি সুপুরুষ —গিলে করা সাদা পাঞ্জাবী ও ধুতিই তাঁর পোষাক। তখন কিন্তু তাদের পড়ন্ত বেলা , কিন্তু বাহ্যিক প্রকাশ ছিল না। মাঝে মাঝেই জমি বিক্রি করতেন সংসারের ব্যায় সামলাতে। অনেক তাঁর আশ্রিত –তা ছাড়া নিজের দশটি সন্তান। তাদের পড়াশোনা গান বাজনার চর্চা আঁকার রঙ তুলি ইত্যাদির খরচ সামাল দিতে তিনি হিমসিম খেতেন —কিন্তু দোল দুর্গোৎসবে লোক লৌকিকতার অন্ত ছিল না। সে সময় তাঁর চালের ব্যাবসাও ভালো চলছিল না। এক খুড়তুতো ভাইকে ম্যানেজার করেছিলেন —সে অবনী মুখার্জিকে পথে বসবার ব্যাবস্থা পাকা করে নিজের আখের গোছাচ্ছিল। স্ত্রী নিরুপমা একেবারের অন্তপুরবাসিনী। তাঁর ঠাকুর ঘর ,ছেলে মেয়েদের খাওয়া দাওয়া ,সংসারের যাবতিয় খুটিনাটি নিয়েই ব্যাস্ত। বাইরের জগৎ তাঁর কাছে পৌঁছায় না –তিনিও সংসারেই সুখি ।
অবনীবাবুর প্রতিটা ছেলে মেয়েই পড়াশোনায় ভালো শুধু ময়নার পড়ার ইচ্ছা একদম নেই — সে খালি রান্না শিখবে মার কাছে ।সারাক্ষন রান্না ঘরে মাকে সাহায্য করছে। দুঃখ অবনীবাবুর ঐ অল্প শিক্ষিত মেয়ের কি করে বিয়ে হবে। অন্যান্য ভাই বোনেরাও তাকে একটু অবহেলার চোখে দেখে কেবল আদিত্য ছাড়া। আদিত্য সদা সর্বদা গানবাজনা নিয়েই থাকে —কথায় কথায় গান বাঁধে ,তাতে সুর দেয় তৎক্ষনাত ।মুখার্জীমশাইএর এই ছেলেটি আত্মভোলা , যেন অন্য জগতে থাকে সব সময় –তাই সংসারী ময়না আগলে রাখে তার ফুলদাকে।
আজ সকালের সাথে বত্রিশ বছর আগের এক সকালের হবহু মিল পাচ্ছি — সেই একই সুরে কান্না সেই একই মহিলা কন্ঠ ।বুকের মধ্যেটা খালি হয়ে গেল — ময়নার গলার স্বর , তবে কি আদিত্য আর নেই ! অসুস্থ ,আজ ছমাস ধরেই সজ্জাশায়ী ।অনুমান ঠিক ই — গেটের কাছে কিছু জনসমাগম হয়েছে –আদিত্য চলে গেছে না ফেরার দেশে ।
বত্রিশ বছর আগে এক সকালে এই হাহাকার শুনেছিলাম ময়নার কন্ঠে ।
বাবা ও বাবা সাড়া দিচ্ছ না কেন — বাবা পড়ে গেছে ,দাদা তাড়াতাড়ি আয় !!
বাবা ও বাবা —-
সেদিন ছুটে গিয়ে দেখেছিলাম বাগানের মোরাম বেছানো রাস্তায় অবনীবাবুর নিথর দেহটা পড়ে আছে —- মাথাটা ময়নার কোলে ,বাড়ির সকলে ভিড় করে আছে — কিন্তু আদিত্য নেই ।কিছুক্ষন পর জানলাম আদিত্য আগেরদিন রাত থেকেই নেই । এবং সেটাই অবনীবাবুর রাগের কারন ছিল সেদিন সকালে । ঘুম থেকে উঠে তিনি জেনেছিলেন আদিত্য আগেরদিন রাতে ফেরেনি —কারন সে একটা জলসায় গান শুনতে গেছে ।রাতে বাড়ির বাইরে থাকাটা যে কোনো বাবা মা মেনে নিতে পারেন না —এবং সেটা নিয়েই রাগারাগি করছিলেন স্ত্রীর সাথে ।তারপর তিনি রাগ করেই বাড়ির থেকে বেরিয়ে পড়েন কিছু না খেয়েই । ময়না পিছন পিছন দৌড়ায় তাঁকে খেয়ে যেতে বলার জন্য— দূর থেকে দেখে হঠাৎ ঐ দীর্ঘদেহী মানুষটা কাটা গাছের মতো হুড়মুড় করে বাগানের রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে । প্রানপনে ছুটেও পৌঁছাতে পারেনি বাবাকে ধরার জন্যএবং মুহুর্তে সব শেষ ।
আজও সেই হাহাকার —-
ফুলদা চলে গেলি — আমার কি হবে !!
সত্যিই তো ময়নার কি হবে ?
ঐ বাড়িতে তো আদিত্য আর ময়না ছাড়া তৃতীয় কেউ থাকে না ! এ প্রশ্ন এখন বকুল বাগানের সকলের মনে।
ময়না অবিবাহিত কিন্তু আদিত্যর বিয়ে একটা হয়ছিল সময় মতো। কিন্তু সেখানে একটা অসত্যর হাত ধরেছিল মুখার্জি বাড়ির সকলেই। যে আদিত্য সর্বদা জলসায় গান শুনে বেড়ায় তাকে গায়ক হিসাবে দেখানো হয়েছিল। গান , সুর, তাল মজ্জাগত হলেও তাকে দিয়ে রোজগার করার মতো কৌশল আদিত্যর জানা ছিল না। তাই যে কেউ যে কোনো স্থানে তাকে গাইতে বললে সে গেয়ে দিত — কিন্তু গানকে কেন্দ্র করে উপার্জন তার ধাতে ছিল না। কখনও তাকে গোল করে ঘিরে বসে আছে বন্ধুরা আদিত্য গাইছে , কখনও চায়ের দোকানে ,কখনও বন্ধুর বিবাহবাসরে — হারহোনিয়াম হাতে পেলে কথা নেই একের পর এক গান গেয়ে যাবে , এবং তা যথার্থ শিল্পীর মতোই। সকলের বাহবা পেয়েই সে খুশি ।নিজেকে ব্যাবসায়িক বুদ্ধিতে মেলে ধরতে সে শিখল না কোনোদিন —তাই তার শিল্পীসত্বা টাকার মুখ দেখালো না কোনোদিনও।
কিন্তু আসল গল্পের শুরু আদিত্যর বিয়ের পর ।ততদিনে আদিত্যর ওপরের তিন দাদা বিয়ে করে পৃথক হয়েছে — বাবার ব্যাবসা বিক্রি হয়ে সে টাকারও ভাগ বাটোয়ারা হয়েছে — মা এখন অসুস্থ হার্টের পেসেন্ট। আদিত্যর পরের তিন ভাই পড়ছে , ছোটো দুবনে ভালো বিয়ে হয়েছে ,ময়নার বিয়ে হয়নি বহু চেষ্টাতেও।
বর্নালীর কিন্তু নিজেই পছন্দ করেছিল আদিত্যকে–তখন আদিত্যর গানের মাধুরী ছিল তার প্রান মন জুড়ে। তার বাবা দাদা তার পছন্দের অনুসারেই এসেছিল বিয়ের কথা বলতে , কিন্তু মুখার্জি বাড়ির বিষয়ি বড় ছেলে তার উপার্যনের কথাটা বেমালুম লুকিয়ে গেছিল । কন্যাপক্ষ এতবড় বাড়ি ,পাড়ায় সুনাম, –আদিত্যর ভোলাভালা চেহারা দেখে আর তলিয়ে খোঁজ নেয়নি। হয়ে গেল তাদের বিয়ে ধুমধাম করেই। কন্যাপক্ষের প্রথম কাজ তাই তাদের আতিশয্য অনেক বেশি এদের তুলনায় ।তত্বতালাস প্রয়োজনের অতিরিক্ত।
আদিত্যর শ্বশুর বাড়ি যত তাদের ঐশ্বর্য দেখায় আদিত্য ভিতরে ভিতরে তত কুঁকড়ে যায়। একদিন সে ময়নাকে বলেই বসল
ময়না বিয়েটা না করলেই মনে হয় ভালো হতো –সবার জন্য ।
কেন রে ফুলদা এইকথা বলছিস ?
আমি কি বর্নালীকে এত সুখ দিতে পারব !
কেন পারবি না এখন তো গানের টিউসানি করে যা পাস সবটা বৌদির হাতে দিবি আর সংসার খরচের টাকা দাদারা তো দিয়েই যাচ্ছে ।এর মধ্যে একটা চাকরি যোগাড় করে নিস।
মাকে আবার আমাদের আলোচনার কথা বলিস না।
না না মাকে বলে কি হবে সংসার তো এখন আমার হাতে।
এভাবেই চলছিল টেনেটুনে আর বর্নালীর সমস্ত আবদার রাখার প্রানপাত চেষ্টা করে যেতে থাকল।আদিত্য একটা ছোটো খাটো কাজ জুটিয়ে ফেলল এর মধ্যে। দাদারা ধীরে ধীরে সংসারে টাকা পাঠানো বন্ধ করল — তাদের সংসার খরচ বেড়েছে এই অজুহাতে ।সংসারের জোয়াল পুরোপুরি আদিত্যর ওপর।
এইভাবে কাটল বছর তিনেক ,ইতিমধ্যে আদিত্য আর বর্ণালীর মাঝে এসেছে একটা ফুটফুটে মেয়ে ।আদিত্যর দায়দায়িত্ব আরও বাড়ল ।বর্ণালীর চাহিদাও বাড়ছে উত্তোরোত্তর। আজ নতুন পর্দা চাই তো কাল রেষ্টুরেন্টে খেতে চলো — একটা রবারের সুতোকে যেন দুই দিক থেকে অনবরত টেনে চলেছে সকলে ।আদিত্য বিদ্ধস্ত ,বিপর্যস্ত।
হঠাৎ একদিন সকালে বকুলবাগানের সকলে লক্ষ্য করল মুখার্জিবাড়ির দরজায় পুলিসের গাড়ি। যথারিতি সকলেই স্তম্ভিত — কি হল ,সবার প্রশ্ন।
জানা গেল আদিত্য অফিসের বেশ কিছু টাকার গোলমাল হয়েছে , যা আদিত্যর দায়িত্বে ছিল ।কয়েকদিন সে অফিস না যাওয়াতে তারা পুলিশের দারস্থ হয়েছে। সেসময় আদিত্য বাড়িতে না থাকায় পুলিশ তাকে থানায় দেখা করতে বলে চলে গেল ।নিরুপমা দেবী বড় ছেলেকে ডেকে পাঠালেন –তাঁর কান্নাকাটি তাকে বাধ্য করল অফিসে গিয়ে ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে ,ম্যানেজার বললেন টাকাটা আপনারা দিয়ে দিন আমি কেশ তুলে নিচ্ছি ।তবে চাকরি আর থাকবে না । দাদা টাকা দিয়ে সে যাত্রায় আদিত্যকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচালো ঠিকই, কিন্তু সংসারটা ধ্বংসের মুখে পড়ল ।
আদিত্য পুরোপুরি বেকার হয়ে গেল । ইদানিং গানের দিকেও ঝোঁক নেই । ক্রমে জানা গেল আদিত্য অনেক লোকের কাছ থেকেই টাকা ধার করত কাউকে ফেরত দিয়েছে ,কাউকে দেয়নি ।সংসার চালাবার টাকা তাকে কেউ হাতে দেয়নি আর উপার্যনের রাস্তাও তাকে কেউ দেখায়নি , সাংসারিক বুদ্ধিহীন আদিত্য ক্রমাগত টাকা ধার করে সংসার চালিয়েছে । ইতি মধ্যে বর্ণালীর বাপের বাড়িতেও এ খবর পৌঁছায়।
তার দাদা ও বাবা সিদ্ধান্ত নেয় তারা মেয়েকে নিজের কাছে রাখবে — বর্ণালী মেয়ে নিয়ে যাবার আগে আদিত্যর সাথে কোনো কথাই বলেনি আর আদিত্যও তার সামনে দাঁড়াতে পারিনি অপরাধ বোধের থেকে।
শুধু ময়না বলেছিল তুমি মার অনুমতি নিয়েছ বৌদি ?
প্রয়োজন বোধ করছি না ।তোমরা সবাই মিলেই আমায় ঠকিয়েছ।
কিন্তু ফুলদা যা করেছে সংসারের জন্য করেছে ।তোমার জন্য ,আমার জন্য ,ছোটো ভাইদের জন্য ,তাকে তুমি এতবড় শাস্তি দিচ্ছ—তার থেকে তার মেয়েকে আলাদা করে !
বাবা হবার যোগ্যতা ওর নেই ।মেয়েকে মানুষ করতে গেলেও টাকার প্রয়োজন —তা কি আছে আদিত্যর?
ওকে একটু সময় দাও –।
আগে নিজের পায়ে দাঁড়াক ,ধার দেনা শোধ করুক—তখন না হয় মেয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখাবে।
এভাবেই সে মুখার্জিবাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে গিয়েছিল সেদিন।
তারপর আর বকুলবাগানের কেউ বর্ণালীকে মুখার্জিবাড়িতে দেখেনি ।মেয়েকেও নিয়ে আসেনি তার বাবার কাছে । ক্রমে নিরুপমা দেবীর মৃত্যু হয়েছে। ছোটো ভাইগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও এইবাড়ি ছেড়েছে তারা ।এই বাড়ি এখন ভাগের মা ,কেউ সংস্কার করতে চায় না ।এক প্রান্তে ময়না আর আদিত্য থাকে —হয়তো ভাইদের দেয়া টাকাতেই সংসার চালায়। কিন্তু বর্নালী আর কোনোদিন খোঁজ নেয়নি , তার মেয়ে শুনেছি বিবাহিত বিদেশে থাকে — সেও তার বাবার খবর রাখেনি ।
সত্যিই কি আদিত্য এতটা দোষ করেছিল যতটা শাস্তি সে পেল সারাজীবন ধরে ।তার পিতৃত্ব কি অবহেলিত হল না ! একটু ভালোবাসা একটু সহানুভূতিও কি মানুষ হিসাবে আর একটা মানুষকে আমরা দিতে পারি না। শুধুই পাওয়া না পাওয়ার মাপকাঠিতে জীবনকে মেপে যেতে হবে ।
কিছুদিন আগে একবার দেখা হয়েছিল —-বলল
পরিমলদা আজ পয়লা বৈশাখ ! আমার মেয়েটার জন্মদিন —
চোখটা টলটলে জলে ভরা —
আর কোনো কথা নেই।
দাহ সৎকারের পর যখন ময়নার সাথে দেখা করে ফিরে আসছি তখন ও বলল—
পরিমলদা ফুলদার মন জুড়ে শেষ পর্যন্ত বর্নালীই ছিল আর মেয়ে। মৃত্যুর আগে কারও নাম করে নি এই আমি এত করেছি সারাজীবন আমাকে পর্যন্ত চিনতে পারছিল না —কেবল মুখে একটা নাম বর্ণালী !বর্ণালী ! এতটা অবহেলা কি ওর প্রাপ্য ছিল ?
বারে বারেই মনে হচ্ছে ময়নার কথাগুলো ।