কথায় আছে ভাগ্য সাহসীদের সঙ্গ দেয়। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হওয়া নিশীথ প্রামাণিকের জীবনগাঁথার ছত্রে ছত্রে তা মিলে যায়। বিগত লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে এই রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের ঘর ভাঙ্গাতে তৎপর ছিল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সেইসময় কোচবিহার জেলার তৃণমূলের এক প্রবীন বিক্ষুব্ধ নেতার মাধ্যমে বেশ কয়েকজন যুবনেতা বিজেপির সাথে তলে তলে যোগাযোগ রাখছিল বলে খবর ছড়ায়। কথিত, সেইসময় দিল্লীতে অমিত শাহের সাথে নাকি গোপনে বৈঠকও সারেন এঁদের অনেকেই। বিজেপি নাকি সেইসময় তৃণমূলের এক রাজবংশী যুবনেতাকে কোচবিহারে পদ্ম প্রতীকে নির্বাচনে লড়াই করার প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু শেষমুহুর্তে ওই নেতা পিছিয়ে আসায় প্রস্তাব যায় ডাকাবুকো নিশীথের কাছে। তৃণমূল কংগ্রেস থেকে বহিস্কৃত এবং প্রকৃতই কোণঠাসা হয়ে থাকা অবস্হায় সেই প্রস্তাব একরকম নাকি লুফেই নেন নিশীথ। সম্ভবতঃ তার চাইতে দামী কোনও বিকল্পও তাঁর ছিলনা। আর নির্বাচনে দাঁড়িয়ে অলআউট খেলে তৃণমূলের তৎকালীন গড়ে জোড়াফুল প্রার্থী পরেশ অধিকারীকে পরাজিত করেন তিনি। সেই যাত্রাপথ ধরেই এবারে তিনি হলেন দেশের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। ভেটাগুড়ির ‘বিট্টু’ থেকে অমিত শাহের ডেপুটি হওয়ায় রাজনীতির অলিন্দে “নিশীথ” নামক নতুন নক্ষত্রের জন্ম নিল নাকি ধূমকেতুর মতই ভবিষ্যতের গর্ভে মিলিয়ে যাবেন বিতর্কিত এই নেতা? কোচবিহারের সাংসদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে সেই আলোচনা চলছে জোরকদমে।
২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভেটাগুড়িতে বামেদের উৎখাত করতে নেতৃত্ব দেয় নিশীথ প্রামাণিক। তরতাজা যুবক নিশীথ তখন তৃণমূলের ঝাণ্ডার তলায়। ভোটে জিতে উপপ্রধানও হন নিশীথ প্রামাণিক। রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খার কারণেই নাকি নিশীথের সাথে স্থানীয় নেতৃত্বের সংঘাত শুরু হয়। সেইসময় কোচবিহারের তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। কথিত, রবিপন্থীদের সাথে একা পেরে না ওঠে রবির বিরোধী গোষ্ঠীর তৃণমূল যুব নেতা প্রয়াত রানা বোসের শিবিরে নাম লেখায় নিশীথ। রানা বোসের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই কোচবিহারে পরিচিতি বাড়তে থাকে নিশীথের। রানা বোসের অকাল প্রয়াণে যুব সংগঠনের রাশ নিজের হাতে নেওয়ার চেষ্টা চালান নিশীথ প্রামাণিক। সম্ভবত সেইসময় তাকে অনেকটাই সুযোগ দেন অভিষেক ব্যানার্জী। আর এরপরেই কোচবিহারের তৃণমূলের যুব-মাদার সংঘর্ষ নিত্য দিনের বিষয় হয়ে উঠে। সেই বিরোধই চরমে উঠে ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে।
অনেক জায়গায় টিকিট না পেয়ে নিশীথপন্থীরা পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ছাড়াই লড়াই করে। তখন যুবদের মুখে ছিল স্লোগান “জো জিতা ওহি সিকান্দার”। ফলস্বরূপ বোমা বারুদের গন্ধে একপ্রকার নাকি রণক্ষেত্রে পরিণত হয় কোচবিহার। দিনহাটায় মাদারের আবু হক নামে এক তৃণমূল কর্মী খুন হন। সেই মামলায় প্রধান অভিযুক্ত হন বর্তমানের কোচবিহারের সাংসদ। তবে নির্বাচনে একাধিক গ্রাম পঞ্চায়েত ও দিনহাটা-১ পঞ্চায়েত সমিতি দখল করে নিশীথ অনুগামীরা। নিশীথের দাপটে আকাশে অনেকটাই ঢাকা পরে ‘রবি’র কিরণ। ভোটের কিছুদিন পরেই কোলকাতায় যুবনেতা অভিষেকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন পালনের জন্য ১০০ কেজি ওজনের কেক উপহার দেন নিশীথ। ভেটাগুড়িতে ধুমধাম করে বলিউড শিল্পী এনে গণেশ পুজাও করেন। এদিকে কিছুতেই তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষে লাগাম পড়ানো যাচ্ছিল না। তিতিবিরক্ত দলের শীর্ষনেতৃত্ব অতএব নিশীথকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালীন যুব তৃণমূলের সভাপতি তথা বর্তমানে কোচবিহার জেলা সভাপতি পার্থপ্রতীম রায় ফেসবুকে রীতিমত পোষ্ট করে নিশীথকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সেই রাতেই কোচবিহার ছেড়ে একপ্রকার অজ্ঞাতবাসে যাত্রা করেন তিনি। এরপরে বিজেপির লোকসভায় প্রার্থী হয়ে প্রকাশ্যে কোচবিহারে ফেরেন নিশীথ। নির্বাচনের সময় এক জনপ্রিয় বাংলা খবরের চ্যানেলে রবিবাবুর সাথে নিশীথ প্রামাণিকের তরজা ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠে সভা। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। নিশীথ প্রামানিকের সমর্থনে কোচবিহারে প্রচারে আসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, খুলে যায় নিশীথের জোরদার দিল্লি লবি। নির্বাচনে জয়ী হন নিশীথবাবু। আর তখন থেকেই প্রধানমন্ত্রীর সুনজরে এই তরুণ নেতা। অন্যদিকে লোকসভায় তৃণমূল পরাজিত হতেই কোচবিহারে ‘রবি’র দাপট অস্তাচলে যেতে থাকে। হারান ২২ বছরের পুরনো জেলা সভাপতির পদ।
এদিকে এবারে আবার বিধানসভা নির্বাচনেও দিনহাটায় বিজেপি প্রার্থী করে নিশীথ প্রামাণিককে। স্বল্প ভোটে হলেও জয়ী হয়ে নিজের মানরক্ষা করেন তিনি। বিধানসভায় জয়ী হয়েও পরে দলের নির্দেশে বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি আর এবারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় রদবদলে নিজের জায়গা করে নেন তিনি। এক গ্রাম্য যুবকের এটি এককথায় এক স্বপ্নের উত্থান।
শুরু থেকেই নিশীথ প্রামাণিককে ঘিরে অরাজনৈতিক বির্তকও কিন্তু কম তৈরি হয়নি। রাজনীতি জড়ানোর আগে আলিপুরদুয়ারের বীরপাড়ায় সোনার দোকানে চুরির ঘটনায় নাম জড়ায় তাঁর। সেই ঘটনায় সম্প্রতি আরও এক অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে রাজ্য পুলিশ। সেই মামলা চলছে আজও। তৃণমুল কর্মী আবু হক হত্যার প্রধান আসামীও নাকি তিনি। কথিত খুন, চুরি, বেআইনী অস্ত্র রাখা সহ একাধিক মামলা রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ভেটাগুড়িতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে গণেশ পুজো করেন তিনি। সেই পুজোর অনুষ্ঠানে টলিউড, বলিউডের একাধিক শিল্পী এসেছিলেন। তার ঘোষিত সম্পত্তির পরিমাণই নাকি এখন ছাড়িয়েছে কোটি টাকা। পেশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে পেশাদার জীবন শুরু করা নিশীথ এত টাকা খরচ করে কিভাবে গণেশ পুজো করেছিলেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নিশীথ প্রামাণিকের ব্যবহৃত একাধিক দামী গাড়ি সহ বৈভবময় জীবনযাপনের টাকার উৎস নিয়ে বার বার প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। নিশীথ প্রামাণিকের মন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে রাজ্যের শাসক দল। তাদের বক্তব্য, লোকসভা নির্বাচনে হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এখন লোকসভার ওয়েবসাইটে তাঁর যোগ্যতা বিসিএ দেওয়া। কবে কিভাবে অর্জন করলেন তিনি তাঁর এই অতিরিক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা? আবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর আদিবাড়ী বাংলাদেশে কিনা সেই নিয়েও চাঞ্চল্যকর বিতর্ক শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের গাইবান্ধ্যায় পলাশবাড়ীতে নিশীথ প্রামাণিকের আদিবাড়ী বলে সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি পোস্টকে ঘিরে রীতিমত শোরগোল পরে গিয়েছে। তিনি নিজে দাবী না করলেও তাঁর রাজবংশী পরিচয় নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। মন্ত্রীত্ব প্রাপ্তির সময়েও একাধিক ন্যাশানাল মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করেছে তাঁর রাজবংশী জনজাতির প্রতিনিধিত্ব করার পরিচয়।
পাশাপাশি নিশীথ প্রামাণিকের জনসংযোগ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিজেপির অন্দরেই অনেকের দাবী এলাকায় সাংসদের দেখাই পাওয়াই ভার। তিনি সবসময় দিল্লির অলিন্দ মুখী। জরুরি প্রয়োজনেও তারসাথে যোগাযোগ করা বেশ মুশকিল। জনসংযোগের অভাবেই বিগত লোকসভায় সংখ্যার বিচারে নাকি অনেকটা এগিয়ে থাকা দিনহাটার বিধানসভা নির্বাচনে কোনক্রমে জয় হাসিল করতে সম্ভব হয়েছে বিজেপি। অথচ সেইসময় পিছিয়ে থাকা শিতলখুচি কেন্দ্রেও এসেছে অনায়াসে জয়। মন্ত্রী হওয়ার পরে জনগণের নাকি আরোও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে পারেন নিশীথ প্রামাণিক, অনেকের আশঙ্কা এখন সেটাই।
মোদ্দাকথা, লোকসভা নির্বাচনে নিশীথ প্রামাণিকের সাফল্য চোখ ধাঁধিয়েছে সবার। এমনকি খোদ মোদি-শা জুটিরও। এসেছে মন্ত্রীত্বের পুরষ্কার। তরুণতুর্কী এই নেতার হাতে দোদন্ডপ্রতাপ রবীন্দ্রনাথ ঘোষের প্রার্থীর পরাজয়ের পর থেকেই অনেকে নিশীথকে রাজনৈতিক লম্বা রেসের ঘোড়া বলে ভাবতে করতে শুরু করেছিলেন। একইসাথে আবার আশঙ্কাও, ধূমকেতুর মতই মিলিয়ে যাবেনাতো তাঁর এই উত্থান? রাজ্যের শাসকদল যেভাবে নিশীথ প্রামাণিকের অপরাধ জগতের সাথে যোগাযোগ সহ তাঁর নাগরিকত্ব ইস্যুতে আন্দোলন জোরদার করছে তাতে সেই সাঁড়াশির চাপ আলগা করা নিশীথের পক্ষে অতটা সহজ হবেনা বলেই মনে করছে তথ্যভিজ্ঞ মহল। আপততঃ এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য সরকারি ও সাংবিধানিক অনেক রক্ষাকবচ কাজ করলেও ভবিষ্যতে এই চ্যালেঞ্জ তাঁকে কড়া ট্যাকেল দেবে অবশ্যই। কেননা, ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরতে না পারলে কিংবা নিশীথ প্রামাণিক নিজে জিততে না পারলে রাজ্যের শাসকদলের সাথে তাঁর লড়াই যে অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়বে তা বলাই বাহুল্য। তিনি কি তখন আবার হবেন দলবদলু!
বিবিধ অভিযোগ-অপরাধযোগের বাধা কাটিয়ে আপাততঃ রাজনীতির লম্বা দৌড়ে নিশীথ কতটা পথ দৌড়তে পারবেন, কতটা জমিতে সুফসল ফলাতে পারবেন, সেসবই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। তিনি “নক্ষত্র” নাকি নিছকই এক ধূমকেতু, সেটি প্রমাণ করার দায়ভার একান্তই এখন তাঁর।