উত্তরবঙ্গে আলোড়ন ফেলতে রাজ্যসভায় যাক রবি

আওয়াজ ওঠছে এবারে তবে রাজ্যসভায় পাঠানো হোক রবীন্দ্রনাথ ঘোষকে। রাজনীতির সূচনালগ্ন থেকে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি রাজ্যের সাবেক মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষের আনুগত্য অগাধ। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা লগ্নে উত্তরবঙ্গের কংগ্রেস নেতারা যখন মমতার সাথে আয়ারাম গয়ারাম সম্পর্ক রাখছিলেন তখন মমতার নেতৃত্বে অবিচল ভরসা ছিল রবি ঘোষের। সেই সময়ের তরতাজা যুবক রবির নেতৃত্বে আস্থা রেখেছিলেন মমতাও। অতএব ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময় দলের কোষাধ্যক্ষ করা হয় তাঁকে। দলের প্রতিষ্ঠা থেকে টানা ২২ বছর জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন রবি ঘোষ। শুন্য থেকে শুরু করে কোচবিহারে তৃণমূল কংগ্রেসকে মহীরুহ করার পিছনে রবীন্দ্রনাথ ঘোষের অবদান অস্বীকার করতে পারেন না তাঁর বিরোধীরাও।

বলা হয় ২০১৯ সালে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জন্য লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী পরাজিত হয় কোচবিহারে। এরপরেই দলনেত্রীর নির্দেশে জেলা সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি এবং দলের অনুগত সৈনিক হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে নাটাবাড়ি কেন্দ্র থেকে পরাজিত হন তিনি।

এদিকে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে ভালো ফল করেছে বিজেপি। ২০২৪ সালের লোকসভাকে লক্ষ্য রেখে কোচবিহারের বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামানিককে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করা হচ্ছে বলে খবর। এই পরিস্থিতিতে উত্তরে শক্ত হাতে তৃণমূলের রাশ ধরতে রাজ্যসভায় তাকে পাঠানো প্রয়োজন বলে রাজনৈতিক মহলের অনেকেই মনে করছেন। আর রবীন্দ্রনাথ ঘোষকে রাজ্যসভায় প্রেরণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরোনো বিশ্বস্ত এক সহযোদ্ধাকে একপ্রকার যোগ্য সম্মান প্রদর্শনই করাই হবে অনেকের বিশ্বাস। প্রাজ্ঞ এই নেতার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উত্তরবঙ্গে হারানো জমি উদ্ধার পুনরুদ্ধার করাও সম্ভব হবে তৃণমূলের বলে রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের মত। দলের দুটি রাজ্যসভার আসন ফাঁকা থাকায় তাঁর একটিতে উত্তরের সমতলের প্রতিনিধি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ মনোনীত হলে সেই সিদ্ধান্ত একইসঙ্গে হবে রাজনৈতিক বিচক্ষণতারও।

একসময় একান্ত সাক্ষাৎ-এ রবি বলেছেন,  এখন এই সময়ে কোচবিহারের প্রতিটি প্রান্তে ঘাস ফুলের পতাকা উড়ছে। কিন্তু তৃনমূলের প্রতিষ্ঠালগ্নে তা কল্পনাই করা যেত না। ১৯৯৮ সালে ঘাস ফুল প্রতীক চেনাতে জেলার বুথে বুথে নিজের একটি মোটরবাইকে চেপে চষে বেড়াতেন তিনি। আর সেজন্য তাঁকে মুল্যও চোকাতে হয়েছে প্রচুর।

১৯৮২ সালে ডাউয়াগুড়িতে তাঁর বাড়ি আক্রমণ করে দুষ্কৃতির। বাম দুষ্কৃতিদের প্রচন্ড আঘাতে তাঁর ভাই ময়না ঘোষ গুরুতর অসুস্থ হয়। পরবর্তীতে তিনি অকালে মারা যান। টানা পাঁচ বছর সামাজিক ভাবে বয়কট করে রাখা হয় তাঁর পরিবারকে । রাজনৈতিক কারনে শতাধিক মামলা করা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। একাধিকবার জেলেও যেতে হয়। রাজনৈতিক অত্যাচারে গ্রামের বাড়ি ছাড়তে একপ্রকার বাধ্য হন। শ্বশুরের দান করা শহরের এক চিলতে জমিতে টিনের ঘর তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করেন। এখন সেখানেই তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। দিনহাটায় আবুতারায় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়। সুটকাবাড়িতে প্রচারে গিয়ে আক্রমনের শিকার হন। ড্রেনের মধ্যে আত্মগোপন করে নিজেকে কোনক্রমে রক্ষা করেন। পরে পুলিশ গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে আনে। এত অত্যাচারের পরেও বামেদের কাছে মাথা নত করেন নি তিনি। শত বাধা অতিক্রম করেও  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দলের কাজ করে গিয়েছেন।

বামেদের প্রবল বাধা সত্ত্বেও ২০০৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের প্রতীকে অনেক জায়গায় প্রার্থী দাঁড় করান তিনি। আর ২০০৮ সালে একাধিক জায়গায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীরা জয়ী হয়। ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে অল্প ব্যবধানে তৃণমূল প্রার্থী বামেদের কাছে পরাজিত হয়। ২০১১ সালে কংগ্রেসের সাথে জোট করে বিধানসভায় লড়াই করে জেলায় ৯টির মধ্যে ৫ টি আসনে জেতে তৃণমূল ও কংগ্রেস জোট। সিতাই ছাড়া বাকি চারটি আসনে তৃণমূল প্রার্থীরা জয়ী হন। সেবারেই প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হন রবিবাবুও। এরপরে ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে অভাবনীয় ফল করে তৃণমূল। বামেদের হাত থেকে জেলা পরিষদ ছিনিয়ে নেয় তারা। জেলার ৩৩টি জেলা পরিষদ আসনে ২৭টিতে তৃণমূল জয়ী হয়। ১২টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে ১০টি তৃণমূলের দখলে যায়। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয় তৃণমূল কংগ্রেস। কোচবিহার লোকসভা আসনে রবীন্দ্রনাথ ঘোষের নেতৃত্বে সেই প্রথম কোন অবামপন্থী প্রার্থী জয়ী হয়। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে জেলায় তৃণমূলের ফল দেখে সবাই চমকে উঠে। একদা বাম দুর্গ এই জেলায় ৯টি আসনের মধ্যে ৮টিতে তৃণমূল জয়ী হয়। আর পুরষ্কার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঘোষকে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর দায়িত্ব দেন মুখ্যমন্ত্রী।

পরের বছর ২০১৭ সালে কোচবিহারের সাংসদ রেনুকা সিনহার অকাল প্রয়ান ঘটে। সেই বছরেই লোকসভা উপনির্বাচনে রেকর্ড ভোটে জয়ী হয় তৃণমূল প্রার্থী। তবে এই সময়ে জেলায় বিরোধী হিসেবে উঠে আসতে থাকে বিজেপি। লোকসভা উপনির্বাচনে তা প্রকাশ্যে আসে। ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনে রবীর দাপটে ছত্রখান হয়ে যায় বিরোধীরা। জেলাপরিষদে ৩৩টি আসনের মধ্যে ৩২টি তৃণমূল জয়ী হয়। ওই একটি আসনে নির্দল জয়ী হয়ে পরে তৃণমুলেই যোগদান করে। জেলার ১২টি পঞ্চায়েত সমিতিতেই ক্ষমতা দখল করে তৃণমূল। কিন্তু ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পরাজিত হয়। প্রায় ৫৪ হাজার ভোটে দলের প্রার্থীর পরাজয়ের জন্য অন্তর্ঘাতকেই বিভিন্ন মহলে দায়ী করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঘোষকেই কোনঠাসা করতে তাঁর বিরোধী লবি ষড়যন্ত্র করে বলে রবী অনুগামীরা অভিযোগ করে।

লোকসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পরেই রবিবাবুর উপর প্রথমবার আর শেষবারের জন্য কিছুটা বিরূপ হন দলনেত্রী। পরাজয়ের দায়িত্ব স্বীকার করে জেলা সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। আর ২০২১ নির্বাচনে জেলায় অপ্রত্যাশিত ভাবে খারাপ ফল হয় তৃণমূল কংগ্রেসের। শুধু মাত্র সিতাই ও মেখলিগঞ্জে রবিবাবুর অনুগামী বলে কথিত দুই প্রার্থী জয়ী হন। ৯টি আসনে ৭টি পরাজিত হয় তৃণমূল। এমনকি লোকসভায় এগিয়ে থাকা সিটেও। রবীন্দ্রনাথ ঘোষও নিজেও পরাজিত হন নাটাবাড়ি কেন্দ্রে।

আসলে রবিহীন দিশাহারা কোচবিহার জেলা নেতৃত্ব বিজেপির সাথে স্নায়ুর যুদ্ধে পেরে না উঠাতেই তৃণমূলের খারাপ ফল হয় বলে দলের অনেকের বিশ্বাস। তাদের বক্তব্য, রাজনৈতিক যুদ্ধের ময়দানে বুক চিতিয়ে লড়াই দিতে হয় সেনাপতিকে। তবেই উজ্জ্বীবিত থাকে দলের কর্মীরা। সেই উদ্দীপনার অভাবেই সংগঠন থাকা সত্ত্বেও জেলায় ভালো ফল হয়নি তৃণমূলের।

রবি অনুগামীরা এবিষয়ে নেতার প্রাজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে অল্প ব্যবধানে পরাজিত হয় তৃণমূল কংগ্রেস। দিনহাটা মহকুমা ছাড়া বাকি সব জায়গায় এগিয়ে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। হারলেও মুষড়ে পড়েন নি তিনি। বরং সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ২০১৪ সালের লোকসভার পরিকল্পনা করেন। ২০১১ সাল থেকে দিনহাটা বিধানসভাতে সকাল থেকে রাত অবধি পরিশ্রম করেন। দিনহাটার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তৃণমূলের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সক্ষম হন। তা করতে গিয়ে বামেদের একদম শূল দৃষ্টিতে পড়েন তিনি। আবুতারায় প্রাণঘাতী হামলা হয় তাঁর উপরে। তবুও দমে না গিয়ে জোরকদমে প্রচার চালাতে থাকেন। বামেদের দল ভাঙ্গিয়ে সিতাই এলাকায় বর্তমান বিধায়ক জগদীশ বসুনীয়াকে দলে টেনে নেন। ২০১৩ সালে বামেদের দুর্গ দিনহাটা ভেঙ্গে তছনছ করে দেন তিনি। এই মহকুমায় ৮টি জেলা পরিষদে সব কটিতেই জয়ী হয় তৃণমূল। তিনটে পঞ্চায়েত সমিতিও দখল নেয় তৃণমূল। পরবর্তীতে লোকসভাতেও আর দাঁত ফোটাতে পারেনি বামেরা।

এইমুহূর্তে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ভালো ফল করে পৃথক রাজ্যের দাবিকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে বলে অভিযোগ। ২০২৪ লোকসভাকে পাখির চোখ করে উত্তরবঙ্গের সব আসনে জেতার পরিকল্পনা করছেন তারা। সেইজন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় নিশীথ প্রামানিকের অন্তর্ভুক্তি করতে চাইছে বিজেপি। আর বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূলের প্রয়োজন অভিজ্ঞ অনুগত নেতৃত্বের। আর সেই বিকল্পের সেরা ঘোড়া নিঃসন্দেহে রবি ঘোষ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে উত্তরবঙ্গে উন্নয়নের কান্ডারী ছিলেন রবিবাবু। সেই উন্নয়নের গাঁথা আর দাবি দিল্লীতে তুলে ধরতে রাজ্যসভায় রবিকে পাঠালে বঙ্গ বিচ্ছেদ যেমন আটকানো যাবে তেমনি এলাকায় শক্তিশালী হবে তৃণমূলের সংগঠন বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছে।   

তৃতীয়  দফায় রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এলেও আজও শিলিগুড়ি পৌরসভা অধরা। এবারে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেবকে সেনাপতি করে শিলিগুড়ি পুরসভায় ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে তৃণমূল কংগ্রেস। পাহাড়েও নিজেদের সংগঠন গোছাতে প্রাক্তন বাম বিধায়ক শান্তা ছেত্রীকে রাজ্যসভার সাংসদ করে পাঠানো হয়েছে দিল্লিতে। উত্তরবঙ্গে বিজেপি যেভাবে নিশিথ  প্রামানিক, জন বারলা-দের সামনের সারিতে নিয়ে আসছে তাতে বিজেপিকে টক্কর দেওয়ার জন্য রবিবাবুই হতে পারেন তৃণমূলের মুখ। আর রাজ্যের সাবেক মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষকে রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য করে পাঠালে তাঁর দলের প্রতি আনুগত্য তথা ত্যাগের প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শনও হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। পূরণ হতে পারে উত্তরবঙ্গে ফের ক্ষমতায় আসার তৃণমূলের স্বপ্ন।