নদী যেখানে মা (বই রিভিউ)

ডাক্তার মফিজুল ইসলাম মান্টু পেশায় চিকিৎসক। কর্মসূত্রে বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছেন ইরানে। ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। তবুও ভুলে যাননি নিজের নদী মাতৃক দেশ বাংলাদেশকে। ঠিক যেভাবে মাকে হৃদয়ে রেখেছেন। ঠিক একইভাবে দেশকেও তিনি রেখেছেন হৃদয়ে। কুসংস্কারে বিরুদ্ধে, শান্তির পক্ষে এবং অতি অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশের জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করছেন জারা। তাদের উতসর্গ করেছেন তার এই কাব্যগ্রন্থটি। তার উদার মানসিকতার ছবি ধরা দেয় এই কাব্যগ্রন্থের কবিতায়। নদীর পাড়ের এক সবুজ গাঁয়ের মেয়ে ছিলেন তার মা। আজ মা নেই। কিন্তু আছে নদীর পাড়ে তার মায়ের গ্রামটি। তাই সেই সবুজ গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটি দেখে তিনি লেখেন ‘নদী যখন নদীর মতন নদীই তখন মা / নদীর পাড়েই জেগে আছে একটি সবুজ গাঁ’ । সেই যুদ্ধ চলছে আজও /ফুলের সুবাস পাওয়ার জন্য/শিশুর অপাপ হাসির জন্য/ মায়ের দুঃখ ভোলার জন্য/ মানুষ হয়ে বাঁচার জন্য। এই লাইন গুলি বলে দেয় একমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতাই আমাদের লক্ষ নয়। এই পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত করে তোলাই আমাদের প্রধান লক্ষ। তাই সেই বিশ্বের জন্য যুদ্ধ যে আজও চলছে তা তার লেখনীই বলে দেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী কবি বঙ্গবন্ধু শীর্ষক কবিতায় যেন বলতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর দেখান পথেই চলার অঙ্গীকারের কথা। এই জীবনে যুদ্ধ করেই বাচতে হয় প্রতিনিয়ত কিংবা মৃত্যুকে নিয়ে উৎসবের কথার মধ্যে তার গভীর ভাবনার পরিচয় পাঠকের সামনে উঠে আসে। আরও ভাল লাগে অনেকটা ছড়ার মত করে ছন্দময় তার ‘চলছে দেশ দেশের মত’ এবং ‘জুতো মোজা চক চক কবিতা পড়ে’। রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি সংস্কৃতিতে বিষ মেশাচ্ছে যেসব মানুষ তাদের প্রতিও কটাক্ষ করে ধরেছেন কলম। কবি রংপুরের মানুষ। এত ব্যস্ততার মাঝেও লালন করে চলেছেন রংপুরের মাটির ভাষা যা আমরা এখানে রাজবংশী বা কামতাপুরি ভাষা বলে জানি। আর এই ভাষাতেই খাদ্যের অপচয় নিয়ে তিনি লিখতে গিয়ে বাঙালির ভাত নিয়ে দুর্বলতা যা তার নিজেরও আছে এইজন্য অবলীলায় লেখেন ‘ বঙ্গবাসী প্রিয় ভাই শোনো কথা/ বঙ্গবাসী প্রিয় বইন কওতো কথা/ ডাকাও মাক। এলায় হামাক ভাত দেও / ওমা হামাক ভাত দেও। আবার তার মহাজনের বাংলা সফর শীর্ষক কবিতায় ‘ বাপই বলে কোন গাঁওত যাইবে/ গাছের সবুজ ধানের ছবি/নদীর জীবন পাখির গান/ স্যাটে গেইলে শুনবার পাইবে’। আবার ‘ এত্ত সাগাই কত্ত আদর/তাও ক্যানেবা ভাবেন পর’। এই পংক্তিগুলি তার প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও সবাইকে নিজের করে নেবার ভাবনাই প্রতিফলিত হয়। আর এই কারনেই হয়ত বইটির শেষে ডঃ নেলসন ম্যান্ডেলাকে মনে করে লিখেছেন ‘সব পাগলই পাগল নয়’ শীর্ষক চমৎকার একটি কবিতা। সবশেষে বলতে হয় রংপুর সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ থেকে প্রকাশিত ডাক্তার মফিজুল ইসলাম মান্টুর ‘ নদীই আমার মা’ এই কাব্যগ্রন্থটি যেন হয়ে উঠেছে নদী মাতৃক দেশে মায়ের স্নেহে মানবিকতার মন্ত্রে মানুষ হওয়া এক কবির আত্মকথা।