ভাওয়াইয়া গানের পরানের বন্ধুরা ধরা দিল আশরাফুজ্জামান বাবুর কলমে

পার্থ নিয়োগী : অবিভক্ত উত্তরবাংলার মাটির গান ভাওয়াইয়া। আজও উত্তরের আকাশে বাতাসে শোনা যায় ভাওয়াইয়ার সুর। আর এই সুর মানেনা মানুষের সৃষ্টি কাঁটাতারের বেড়া। তাই আজও দুই বাংলার উত্তরাংশের মেলবন্ধন এর প্রধান মাধ্যম ভাওয়াইয়া গান। আর এই ভাওয়াইয়ার প্রেমে মগ্ন এমন কিছু মানুষ আছেন যারা এই গানের পরানের বন্ধুদের বারবার তুলে আনেন বই এর পাতায়। এমনই একজন ব্যাক্তি হলেন রংপুরের আশরাফুজ্জামান বাবু। আদ্যপ্রান্ত ভাওয়াইয়া সঙ্গীত প্রেমী মানুষটির ভাওয়াইয়া গান নিয়ে আছে একটি জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল। ২০২০ সাল সারা বিশ্বে করোনা অতিমারির ভয়ে গৃহবন্দী। আর এই সময়টাকেই সৃষ্টির কাজে লাগালেন আশরাফুজ্জামান বাবু। ভাওয়াইয়া গানের শিল্পীদের সার্বিক বিবরন বই এর পাতায় লিপিবদ্ধ করার কাজে নেমে গেলেন লকডাউনের সময়ে। চেষ্টা করলেন শিল্পীদের ব্যাক্তিগত বয়স অনুসারে লিপিবদ্ধ করার। যেহেতু ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের অঞ্চল এই উপমহাদেশের অনেকটা অংশ জুড়ে। তারওপর লক ডাউন। তাই ভারত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে গিয়ে শিল্পীদের বয়স অনুসারে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তারপরেও লেখক চেষ্টা করেছেন শিল্পীদের সিনিয়রিটি অনুসারে লিপিবদ্ধ করার কাজে। আর সেখান থেকেই কোভিড কালেই প্রকাশিত হয় ‘ভাওয়াইয়া গানের পরানের বন্ধুরা’ বই এর প্রথম খন্ড। প্রচ্ছদের গাড়িয়াল ভাই এর ছবি রাখার ভাবনাই বলে দেয় লেখকের ভাওয়াইয়া গানের প্রতি গভীরতা। সুন্দর এই প্রচ্ছদ টি একেছেন আলমগীর জুয়েল। ভূমিকায় এই বই নিয়ে বিস্তারিত লিখে লেখক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের ভাবনার কথা। মোট ১১৩ জন ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী ও গবেষক এর বিবরন প্রথম খন্ডে তুলে ধরা হয়েছে। তাদের জন্মদিন থেকে শুরু করে সঙ্গীত জীবনের সাফল্য সবই তুলে ধরার ঐকান্তিক প্রয়াস লক্ষ করা গেছে লেখকের মধ্যে। এমন কি প্রত্যেকের ছবিও সংগ্রহ করেছেন লেখক। এই বইটির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হোল যে মাঝখানের কাঁটাতারের কারনে দুই বাংলার অনেক ভাওয়াইয়া শিল্পীদের আমরা চিনিনা। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের সর্ম্পকে কোন তথ্যও ছিল অজানা। আর সেই অভাবটাই দুর করেছে এই বই। আব্বাসউদ্দিন, সুরেন্দ্রনাথ রায় বসুনিয়া থেকে শুরু করে মহেশচন্দ্র রায়, কছিম উদ্দীন, প্রতিমা বড়ুয়া পান্ডে হয়ে বর্তমান সময়ের কেরামত আলী, পঞ্চানন রায়,ওয়াহিদা রহমান এর কথা সাধ্যমত তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক। মনে রাখতে হবে করোনা অতিমারির লক ডাউনের সময় বাড়িতে বসে লেখক এই বইটির কাজ করেছেন। তাই হয়ত অনেক তথ্য দেবার ইচ্ছে থাকলেও লেখক দিতে পারেননি পরিস্থিতির কারনে। তবে বইটির প্রথম খন্ডের এই সংখ্যায় আমাদের এক বড় পাওনা হোল আমরা এই বই থেকে চিনতে পারলাম আরশাদ আলী নামের এক প্রাক্তন পরিসংখ্যানবিদের ব্যাক্তিগত প্রচেষ্টায় এক গানের সংগ্রহশালার কথা। আরও বিভিন্ন গানের সাথে অনেক জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গানের রেকর্ডও আছে তার এই সংগ্রহশালায়। তাঁর এই সংগ্রহশালা না থাকলে এই ভাওয়াইয়া গানগুলি হয়ত হারিয়ে যেত। ভালো লাগে বইটি থেকে বাংলাদেশ বেতার রংপুর কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক ডঃ মোহাম্মদ হারুন অর রশিদের কথা জানতে পেরে। টাঙ্গাইলের মানুষ হারুন অর রশিদ সাহেব কর্মসূত্রে রংপুরে এসে মজে জান ভাওয়াইয়া গানের প্রেমে। ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের প্রসারের জন্য রংপুর বেতার কেন্দ্র থেকে ‘ গাড়িয়াল বন্ধু’ নামের যুগান্তকারী ভাওয়াইয়া গানের অনুষ্ঠান চালু করেন।আর আজ এই ‘গাড়িয়াল বন্ধু’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরানের ভাওয়াইয়াকে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌচ্ছে দিতে পেরেছেন। এতসুন্দর বই লেখার জন্য আশরাফুজ্জামান বাবুকে কুর্নিশ জানাতে হয় ঠিক তেমনি কুর্নিশ করতে হয় বাংলাদেশ সরকারকেও । কারন আগামী প্রজন্মও যাতে জানতে পারে ভাওয়াইয়া গানের এই পরানের বন্ধুদের কথা। তারজন্য বাংলাদেশ সরকার সেদেশের প্রত্যেকটি জেলা গ্রন্থাগারে এই বইটি রেখেছে।