সৌদামিনী

গল্পটি একশো বছরেরও আগের ঘটনা অবলম্বন করে লেখা।

সৌদামিনী সবে সিঁথির সিঁদুর হারিয়ে বিধবা হয়েছে। কিবা বয়স তার কুড়ি বছর হবে। তার স্বামী মুরালিনাথ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে ভুগে ভুগে শেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। কবিরাজ, বদ্যির ওষুধ বিফলে গেল। সৌদামিনীর কপাল তো সারা জীবনের জন্য পুড়ল। এই কাঁচা বয়সে বিধবা হওয়ার যে কি জ্বালা। একে তো আমিষ খাবারের তার পাঠ চুকল। একাদশীতে পুরো নির্জলা উপোষ থাকতে হয়। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসে। তবুও এক ফোঁটা জল খাওয়ার তার হুকুম নেই। একবার সৌদামিনী  একাদশীর দিন তৃষ্ণার চোটে জল খেতে গিয়েছিল। তখন শাশুড়ী মা তেড়ে এসে তার হাতের জলের ঘটিটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে বললেন, “রাক্ষসী, আমার ছেলেকে খেয়েছিস, এখন একাদশীর দিন জল খেয়ে সংসারের অমঙ্গল ডেকে আনছিস।” এইরমক খুটিনাটি ভুল করলেই শাশুড়ী মায়ের গঞ্জনা শুনতে শুনতে চোখের জল বেরোতে বেরোতে তা শুকিয়ে এক সময় শুকিয়ে যেত।

সৌদামিনীর পরিবারে তার বিধবা  শাশুড়ী মা ও এক বিবাহযোগ্য দেওর আছে। দেওয়রটি সৌদামিনীর থেকে বয়সে কিছুটা বড়। সৌদামিনী নিঃসন্তান। চোদ্দ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়ে ছিল। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই তার স্বামী মুরালিনাথ অসুখে পড়ে। দাম্পত্য জীবনের সুখটা কদিনই বা সৌদামিনী পেয়েছে। এখন তার ভরা যৌবন।তার ওপর সুন্দরী। এক ঢাল কালো চুল সৌন্দর্যটা আটকানোর জন্য ছোটো করে যতই ছেঁটে দেওয়া হোক,যতই সাদা  থান পরুক, শরীরের চারদিক দিয়ে যেন যৌবনের সৌন্দর্য  উঁকি মারে। তখনকার দিনে ব্লাউজ পরার চল ছিল না। অনাবৃত শরীর পুরোটাই  সাদা থানে ঢাকা থাকত।  তার মধ্য দিয়ে শরীরে ফুটে ওঠা যৌবন কে  ভিতরে আটকানোর চেষ্টা করলেও,সেটা আটকে রাখা কি যায়?

একদিন সৌদামিনী বাড়িই পুকুরে স্নান সেরে ঘড়ায় জল নিয়ে বাড়ির দিকে আসছিল। হঠাৎ তার দেওর উমানাথের দিকে ঘাটের ওপর বসার জায়গায় চোখ পরে যায়। গামছাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে সলজ্জ ভাবে মাথায় ঘোমটা দিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে হেঁটে চলে আসতে থাকে। দেওর উমানাথ সৌদামিনী কে হঠাৎ ডেকে বলল, বৌঠান শোনো, “তোমার খুব কষ্ট না, একাদশীর দিন মা তোমার সঙ্গে যা ব্যবহার করল, মায়ের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি। চোখটা উমানাথের সৌদামিনীর মুখের দিকে সোজাসুজি ছিল না।কিঞ্চিত নিচে সৌদামিনীর বক্ষের দিকে  তীক্ষ্ণ কামাতুর দৃষ্টি। সৌদামিনী মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি  চলে গেল।

দেওয়ের ঐ দৃষ্টিটার অর্থ সৌদামিনী বুঝতে পেরেছে।  সেই কারণে সে তাকে সর্বদা এড়িয়ে এড়িয়ে চলতে থাকে। খাবার পরিবেশন করেই সেখান থেকে সরে যায়। এই নিয়ে শাশুড়ী মার কাছে তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। “দেওর খাচ্ছে,আবাগীর বেটি  একটু পাখার বাতাস করতে হয়, সেটা জানে না।”

এদিকে উমানাথ ছায়ার মত সৌদামিনীর পিছনে পড়ে থাকে, তার মার অনুপস্থিতিতে। উমানাথ একদিন বলল, “বৌদি একাদশীতে তোমাকে এত কষ্ট করে উপোষ করতে হবে না, মাকে লুকিয়ে তোমাকে আমি ফল মিষ্টি খাওয়াব।” সৌদামিনী উমানাথের কু উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বলল, “তার দরকার হবি নি ঠাকুর পো। আপনি এখন যান আমাকে কাজ করতে দিন।” উমানাথ রেগে চলে গেল।

একদিন সৌদামিনী ভর দুপুরবেলায় পুকুর ঘাটে বাসন মাজতে গেছে। বেশ মন দিয়ে বাসন মাজছে। বক্ষের কাপড়টা কিঞ্চিত সরে গেছে। সে খেয়াল করেনি। উমানাথও ঐ সময় অছিলা করে পুকুরে মাছ ধরতে এসছে। সৌদামিনী মন দিয়ে বাসনই মেজে যাচ্ছে,উমানাথকে খেয়াল করে নি। এদিকে সৌদামিনীকে দেখে উমানাথের শরীরে কামনার লিপ্সা জেগে উঠল। সে সৌদামিনীকে পিছন থেকে জাপটে ধরল। সৌদামিনী কিছুতেই ওকে ছাড়াতে পারল না। অনুনয় করে বলতে  লাগল, “ছাড়ুন আমায়, নোকে দেখলে সববনাশ হয়ে যাবে,আমাকে কলঙ্কিনী বলবে।” অঝোরে কাঁদতে লাগল। উমানাথ সৌদামিনীকে আস্তে করে উঠিয়ে বলল, “কেউ নেই এখানে বৌঠান, কোনোদিনও দাদা তোমাকে যৌবনের সুখ দিতে পারি নি। আমি তোমাকে সব দিয়ে ভরিয়ে দেব।” সৌদামিনীর চোখে মুখে বক্ষে চুম্বন করতে লাগল। সৌদামিনীর শরীরটাকে নিজের শরীরের সাথে একাত্ম করল।  সৌদামিনীর প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নিমেষের মধ্যে কে যেন কেড়ে নিল। সে স্থবিরের মত চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। যৌবনের সুপ্ত  কামনা, বাসনাগুলো একএক করে বেরিয়ে আসছে। উমানাথ যেন সেগুলোকে নিমিষের মধ্যে পূরণ করছে। এক অসহায় যুবতী বিধবার সুপ্ত কামকে পরিতৃপ্ত করছে  এক কামলোভী পুরুষ তার বেছানো মায়াজালে। সেই মায়াজাল থেকে সৌদামিনী  কিছুতেই বেরোতে পারল না। শাশুড়ী মার অলক্ষ্যে তাদের গভীর মেলামেশা চলতে লাগল।

এদিকে উমানাথের বিয়ের ঠিক হয়েছে। মস্ত বড়লোকের একমাত্র মেয়ে সুচেতনা। চোদ্দ বছর বয়স। মিষ্টি দেখতে। বিয়েও ধুমধাম করে হয়ে গেল। সৌদামিনীর বিয়েটা মেনে নিতে ভিতর থেকে খুব কষ্ট হচ্ছিল,কারণ  উমানাথের সঙ্গে তার সম্পর্কটা পাপের জানা সত্ত্বেও কামনা তৃপ্তির ঊর্ধ্বেও উমানাথকে সে মন দিয়ে বসেছিল, হয়ত সুন্দরী বউ পেয়ে তার বৌঠানকে ভুলে যাবে এইভেবে।   সত্যিই উমানাথ সুচেতনাকে পেয়ে    সৌদামিনীকে ভুলে গেল।  সৌদামিনী প্রতিটা রাত কামনার আগুনে ছটছট করত। একদিন সে উমানাথ কে বলল, “ঠাকুর পো বউ পেয়ে আমাকে ভুলে গেলে। তবে কেন আমাকে সেদিন কামনার মোহে জড়িয়ে ছিলে?  আমি যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি তো বেশ ছিলাম।” কেন আমাকে তুমি পাপের পথে নামালে?”উমানাথ বলল, “সে দিন ভুলে যাওয়াই ভালো। দুজনেই সেদিন কামনার আগুনে মেতে ছিলাম বৌঠান।  এখন আমার সংসার হয়েছে। আমাকে দয়া করে সংসার করতে দাও।”  সৌদামিনী বলল,  শুধু কামনার আগুন? আমি কি নিয়ে থাকব বলতে পার?”  স্বার্থপর, কামলোভী উমানাথের কাছ থেকে এই কথার কোনো উত্তর সে পাই নি। সেদিন সৌদামিনীর দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরেছিল। এক অতৃপ্ত যুবতী বিধবা আস্তে আস্তে  নিজের কামনা কে আবার দমন করতে লাগল। মুহূর্তের একতরফা ভালোবাসাকে ছিন্ন করে দিল।

অনেক বছর কেটে গেল। শাশুড়ী মা গত হয়েছেন। পুরো সংসারের দায়িত্ব সৌদামিনীর ওপর পড়েছে।উমানাথের কাছে সেই অধিকারটা সে পেয়েছে নিজের যোগ্যতা বলে।সে এখন বাড়ির কর্তী। তার কথায় পুরো সংসার চলে।  সুচেতনা বড় জা কে শাশুড়ী মার মত সমীহ করে। সুচেতনার দুটি ছেলে মেয়ে জেঠিমা অন্তপ্রাণ। যত আবদার তাদের সৌদামিনী মেটায়। ওরাই এখন ওর বেঁচে থাকার প্রেরণা। আসলে  সৌদামিনীর মত নারীরা সব কিছুকেই জয় করতে পারে। আর উমানাথের মত পুরুষরা শুধু তাদের কাম পরিতৃপ্ত করার জন্য সুযোগের সদ্ব্যবহার করে।

………………….তনুচ্ছায়া মুখার্জী-