সেই সাধের ছাদটা

তুহিনের সাথে আমার যখন বিয়ে ঠিক করেন আমার বাবা, তখনই আমার এ বিয়েতে আপত্তি ছিল | কারণ, তুহিন আর আমি স্বভাবে, চরিত্রে, মানসিকতায় সম্পূর্ণ বিপরীত | তুহিনের বেশ বড়ো প্রমোটিংয়ের ব্যবসা, এলাকায় যথেষ্ট প্রতিপত্তি, সাথে অনেক অর্থ | আমার বাবার একসময়ের বন্ধু ছিলেন তুহিনের বাবা | কিন্তু বেশ অনেকদিন হয়েছে তিনি গত হয়েছেন | কিন্তু তুহিনের পরিবারের সাথে আমার বাবার বেশ সুসম্পর্ক ছিল |

সেই সুসম্পর্কের সূত্র ধরেই আমার বাবা তুহিনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেন | আমি তখন সদ্য স্কুলে চাকরি পেয়েছি | চাকরির সাথে বিভিন্ন নৃত্যনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি | আমার জীবনের একটা বড়ো অংশ ছিল নাচ | আমার শান্ত জীবনের ঘেরাটোপে আমি খুব সুখী ছিলাম | কিন্তু তুহিন আমাকে বিয়ে করার প্রথম শর্ত দিয়েছিলো, “নাচ ছাড়তে হবে তোমাকে | “

আমি আঁতকে উঠেছিলাম তুহিনের শর্তে | বাড়িতে ফিরে মাকে বলেছিলাম, “এখানে আমার বিয়ে দিও না মা, আমি মরে যাবো | “

বাবা শোনেননি আমার কথা | আমার মতো একটি শান্ত, চুপচাপ থাকা মেয়েকে তুলে দিলেন তুহিনের মতো উড়নচন্ডী, একগুঁয়ে, জেদী, বদমেজাজি একটি ছেলের হাতে |

বড়োলোক স্বামী কপালে জুটলে মেয়েদের যেমন সুখ আসে, আমার জীবনেও সেরকম সুখ এলো | বাড়িতে তিনটে কাজের লোক, আলমারি ভর্তি শাড়ী, লকার ভর্তি গয়না,বরের দেওয়া আমার জন্য নিজস্ব গাড়ি….. সব আছে আমার | নেই শুধু প্রাণ খুলে বাঁচার স্বাধীনতা |

তুহিন যেভাবে জীবনটাকে চালাতে বলে, আমি ঠিক সে ভাবেই নিজের জীবনে বেঁচে থাকি | দামী শাড়ী পরলে সন্তর্পনে পরতে হয়, যদি শাড়িটা ছিঁড়ে যায় বা কাদা লেগে যায়, তবে তো তুহিনের তির্যক, তীক্ষ্ণ ভাষার তীর থেকে আমার আত্মসম্মানকে কোনোভাবেই বাঁচানো যাবে না | ওর পছন্দের শাড়ী, ওর পছন্দের গয়না, ওর পছন্দের বেড়ানোর জায়গা, ওর পছন্দ মতো সিনেমা, ওর পছন্দ মতো গান…. সব ওর পছন্দ মতো, আমি ওর পছন্দে আড়াল হয়ে যেতে থাকলাম একটু একটু করে |

এরই মধ্যে গুনগুন এলো আমার জীবনে | বিয়ের আগে তুহিনের যে চরিত্রটার পরিচয় পেয়েছিলাম না, বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই সে পরিচয়ও পেয়ে গেলাম | আমাকেও তুহিনের জেদের সামনে বেশ কিছু বার মদ্যপ হতে হয়েছে |

আমার মা আমার করুণ অবস্থা দেখে বাবাকে বলেছিলো একবার, “তুহিনকে একটু বোলো না গো, মনাকে যেন এসব খেতে জোরাজুরি না করে!! “

আমার বাবা একগাল হেসে বলেছিলেন, ” এখন এসব স্টেটাস, মাঝে মধ্যে একটু আধটু খেলে কিছু হয় না | “

আমি বুঝেছিলাম, সিংহের থাবা থেকে হরিনের মুক্তি নেই | কিন্তু আমি যখন আরেকটি হরিনের জননী হলাম, তখন একটু চোয়াল শক্ত করার চেষ্টা করলাম | শুরু হোলো অত্যাচার | তুহিনের মা নিশ্চুপ, নীরব | আমি বুঝতে পারছিলাম না, উঁনার ছেলের প্রতি সমর্থন আছে, নাকি উঁনি ছেলেকে ভয় পান |

গুনগুন যখন একটু বড়ো হওয়ার পথে, তখন বাবা সম্পর্কে মনের মধ্যে ভয় পুষতে শুরু করলো ও | আমি যতক্ষণ স্কুলে থাকি, ততক্ষন আয়া, ঠাকুমা, বাবা কারোর কাছেই নিরাপত্তা পায় না গুনগুন | আমার ওইটুকু মেয়ে যেন ভয়ের অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকলো | আমি তবুও সংসার করার চেষ্টা করে গিয়েছি | কারণ, আমার মাথার উপর বাবা নামক ছাদটি বহুদিন আগেই কেড়ে নিয়েছিলেন আমার বাবা |

কিন্তু শেষ রক্ষা হোলো না আমার চেষ্টার | একদিন গুনগুন আমার নাচের ঘুঙুরগুলো পায়ে পরে নাচ করছিলো আপন মনে | তুহিন সেটা মানতে পারেনি | ওই টুকু মেয়ের গায়েই হাত তুলে দিয়েছিলো |

আমি আর অপেক্ষায় থাকিনি নিজের ধৈর্য্য পরীক্ষার | সেদিনই গুনগুনকে নিয়ে স্বামীর ছাদ পরিত্যাগ করেছিলাম | আমার বাবা আমাকে জায়গা দেননি তাঁর ঘরে, তাঁর মতে তাঁর জামাইয়ের কোনো দোষ নেই | আমিই নাকি মানিয়ে চলতে পারিনা | নিশ্চিত নিরাপত্তা পেতে গেলে নাকি জীবনের সাথে এটুকু মানিয়ে চলতেই হয়!!

আমি কিছু প্রতিবাদ করিনি আমার বাবার | পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে মেনে চলা পুরুষ এর চেয়ে যে বেশি কিছু ভাবতে পারবেন না, সেটা আমার জানা হয়ে গিয়েছিলো | তাই, কিছু ঘন্টার জন্য গুনগুনকে মায়ের কাছে রেখে ভাড়াবাড়ি খুঁজতে বেরোলাম | আমার সঙ্গে অবশ্য একজন পুরুষকে পেয়েছি আমি,, সে আমার থেকে তিন বছরের ছোটো, আমার ছোটো ভাই |

ভাড়াবাড়ি ঠিক করে সেদিনই মেয়েকে নিয়ে নিজের একটা আস্তানা তৈরী করি, যদিও সেটা পাকাপাকি কিছু ছিল না |

গুনগুন বলেছিলো, “মাম্মাম, এটা কি আমাদের বাড়ি?? “

আমি গুনগুনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “না মাম্মাম, এটা আমাদের ভাড়াবাড়ি | আর কিছু দিনের অপেক্ষা,, তারপরেই আমাদের একটা নিজেদের ছাদ হবে | “

গুনগুনকে বললাম বটে, তবে সেই সাধের ছাদের অপেক্ষার অবসান কবে হবে জানতাম না আমি | শুধু গুনগুনের মন আর আত্মবিশ্বাসকে আরও বেশি প্রাণবন্ত করতে ওকে নাচের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাম | নাচের তালের মূর্ছনায় যখন আমার শরীরটাও তাল দিতে শুরু করলো, তখন বুঝলাম, আমার ভালো থাকার এখনও কিছু বাকি আছে |

তাই নিজেকে ফিরে পেতে মেয়ের নাচের সঙ্গী হলাম, ভর্তি হলাম আমিও | আমাদের সুখের দিন আসতে শুরু করলো | আমার মেয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভীত সত্ত্বাটা আস্তে আস্তে মেয়ের কাছ থেকে দূরে যেতে থাকলো |

আমাদের জীবনে সুখের অপেক্ষার ব্যবধান একটু একটু করে হ্রাস হচ্ছে | অপেক্ষা শুধু এখন নিজেদের একটা সাধের ছাদের | গুনগুন আমাকে প্রায়শই বলে, “মাম্মাম, আমাদের নিজেদের ছাদ কবে হবে?? “

স্বামীর ছাদ, বাবার ছাদের তল থেকে বেরিয়ে এসেছি পাঁচ বছর হয়ে গেছে | আলাদা জীবন শুরু করার পরে আমার সাথে আমার মা, ভাই দেখা করতে আসতো, কিন্তু হালে এখন আমার বাবাও আসেন | ফিরতে বলেন তাঁর ছাদের তলায় |

কিন্তু আমি ফিরিনি | বরং, নিজের ছাদের ব্যবস্থা করেছি আমি | বিগত কয়েক বছরের সঞ্চয়, আর ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে আমার আর গুনগুনের মাথার উপর ছাদ কিনেছি আমি | অনেক উপেক্ষাকে পিছনে ফেলতে পেরেছি শুধু মাত্র সামনে অপেক্ষার আহ্বান ছিল বলে |

আজকাল তুহিনও আসে মাঝে মধ্যে গুনগুনের সাথে দেখা করতে | কিন্তু ব্যস ওইটুকুই ওর পরিসীমা | আমার আর গুনগুনের ভালোবাসার ছাদের নিচে তুহিনের আর কোনো জায়গা নেই | আমাদের সাধের ছাদ আমাদের মা মেয়েকে ভালোবাসার আর ভালো থাকার সম্ভ্রম নিয়ে বাঁচতে শিখিয়েছে | সেই শিক্ষায় আর কাউকে হস্তগত করতে দেবো না আমরা |