সেই মহালয়া আজও…

বুড়ির পাট থেকে ফিরতি পথ ধরতেই দুদ্দাড় ছুটে বেরিয়ে গেল মা সন্তোষী নামের বাসটি। ভাগ্যিস লাফিয়ে রাস্তার ধারে চলে গিয়েছিলাম! না হলে বোধহয় বিপদ একটা হতই।

উঠেছি সেই ভোরবেলায়। উঠোনে থাকা শিউলি গাছের তলা তখন সাদা ফুলে ঢাকা। ঝেঁপে ফুল এসেছে এবার। শিউলির মো মো গন্ধে আর ভোরের হালকা ঠান্ডায় কেমন একটা নেশা লাগছিল। হাতে তখনও গত রাতের মাংসের সুবাস। বৈষ্ণব বাড়ি বলে মাংস রান্নার ব্যাপার কম আমাদের। যেদিন হত সেদিন বেশ সাজো সাজো রব পড়ে যেত। রান্নাঘর থেকে অনেকটা দূরে আমাদের শোওয়ার ঘরের বারান্দায় মা আর বড়কাকিমা মাংস রাঁধতেন। ঘরে বসে প্রেসার কুকারের সিটি গুণতাম। একসঙ্গে সবাই খেতে বসা হত। প্রিয়তম ছিল ঝোলের আলু। কী স্বাদ! কী স্বাদ! বছরে আর কোনও দিন হোক না হোক, মহালয়ার রাতে মাংস হতই। ঠাকুমা আর বাবার বিধবা পিসিমা শুধু নাকে আঁচল চাপা দিয়ে সেই দূরে বসে থাকতেন!

গতকাল মহালয়ার রাতেও মাংস রান্না হয়েছে। জিভে লেগে থাকা তার সেই স্বাদ আর শিউলির গন্ধে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র উদাত্ত পাঠ করে চলেছেন। গাইছেন দ্বিজেন, হেমন্ত, শ্যামল, সন্ধ্যা, আরতি…। বড়কাকার ঘরের ফিলিপস ট্রানজিস্টর থেকে সেই পাঠ আর গানে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি কৈলাশ থেকে উমা নেমে আসছেন মহাদেবের কাছে বিদায় নিয়ে। তাঁকে এগিয়ে দিচ্ছেন নন্দী আর ভৃঙ্গি। মায়ের আঁচল ধরে আছেন লাজুক সরস্বতী। লক্ষ্মী আর গণেশ আগে আগে। লক্ষ্মী চপলা। গণেশ বলশালী। তীর ধনুক নিয়ে কার্তিক চারদিকে নজর রাখতে রাখতে চলেছেন। দেব সেনাপতি তিনি, তাঁর কেতাই আলাদা। মা আসছেন আবাহনে, আগমনী গানে…আসছেন মর্ত্যে, নিজের বাড়িতে!

পিসতুতো ভাই বাপ্পা ডেকে বলল, ‘চল…এবার বেরিয়ে আসি, রোদ উঠে যাবে এরপর।’ গত পরশু ওরা অসম থেকে এসেছে। পিসি আর তিন ভাই। আমরাও এসেছি ফালাকাটা থেকে। জলপাইগুড়ি থেকে এসেছে সেজ কাকিমার ভাই রাজু। দিনহাটার বাড়ি ভর্তি লোক। বছরে এই একবার সবাই এক হই। আমাদের সারাদিন খেলা। হৈ চৈ। শেষ মুহূর্তে প্রতিমা তৈরি দেখতে ছোটা। দৌড়ে যাওয়া থানা পাড়া, গোধূলি বাজার, ডাকবাংলো পাড়ার প্যান্ডেল দেখতে এবেলা ওবেলা। দুপুরে বড়রা বিশ্রাম নিলে, নজরের চোখ একটু ঢিলে হলে, দে দৌড় দে দৌড় মহামায়া পাট বা কলেজ পাড়ার প্যান্ডেল দেখতে। শহীদ কর্ণারের কাছের মাইকের দোকানে অমিতাভ বচ্চন তখন গেয়ে ওঠেন, ‘মেরে অঙ্গন মে তুমাহারা কেয়া কাম হ্যায়?’ আর টিটবিট দোকানের প্রতিবিম্ব খেলা করে ফুলদিঘির জলে!

রাজু, বাপ্পা, আমি, মধু, ভজন, বাবুন হেঁটে হেঁটে চলে এসেছি বুড়ির পাট অবধি। আমাদের ছোট ছোট পায়ে বুড়ির পাট মানে ভেটাগুড়ি প্রায়। কলেজ হল্টের রেললাইনের পাশ থেকে জোগাড় করেছি কাশ ফুল। নীল আকাশে সূর্য তখন উঠি উঠি। আমাদের মতো আরও কত মানুষ দলে দলে রাস্তায় তখন। মহালয়ার সকাল মানেই দিনহাটায় এক অদ্ভুত আনন্দ। তখনও রেডিও থেকে ভেসে আসছে মহালয়ার পাঠ আর গান। আমরা ধরেছি ফিরতি পথ। ঠিক তখনই দুদ্দাড় মা সন্তোষী বাস!!

এক্সচেঞ্জ মোড়ের কাছে আসতেই দেখি হাসপাতালের সামনে ভিড়। দলে দলে মানুষ। বিষন্ন চেহারা। কেউ কেউ কাঁদছেন। খানিক আগে এক খুনি বাস পিষে ফেলেছে শিক্ষক হরতোষ চক্রবর্তীকে। দিনহাটা হাই স্কুলের এই শিক্ষককে চেনেন না এমন বোধহয় কেউ ছিলেন না সেসময়। তরুণ সুদর্শন জনপ্রিয় মানুষটিকে ভালবাসতেন সব্বাই। আমিও চিনতাম অন্য স্কুল বা অন্য জায়গার বাসিন্দা হয়েও।

বোধনের আলো নিভে গেল মুহূর্তে। সারা শহর স্তব্ধ। প্রাথমিক উত্তেজনায় খানিকটা বিশৃঙ্খলা হলেও, শোক গ্রাস করেছিল কমবেশি সবাইকে। ক্রমশ বিমর্ষ হল দিনহাটা, যেন কাঁদতে লাগল শহর….

পরদিন সকালে শিউলি ঝরে পড়ল আবার। অঞ্জলি দিলাম সে ফুলে আমাকে না চেনা সেই স্যারকে।

মহালয়া এলে আজও প্রণতি দিই।
হরতোষ স্যারের সঙ্গে আরও কিছু নাম যোগ হয়েছে কেবল!

বাকি সব একই আছে….

……শৌভিক রায়