হসপিটালের বেডে শুয়ে রিনসিম। চারদিন কেটে গেছে। সর্বভারতীয় মিডিয়ার নানা লোকের ভিড় ক’মেছে বাইরে। বাইটও দিচ্ছে না আর রিনসিমের কলিগেরা। রেসিডেন্ট কমিশনার অফ স্টেট, মণিপুর, থেকে তার খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে যদিও। খবর নেওয়া হচ্ছে পি এম ও থেকেও। ইতিমধ্যেই পুলিশ ধরেছে তিনজনকে। কিন্তু মূল অভিযুক্ত এখনও ফেরার।
নার্স কেবিনে ঢুকে টিভিটা চালালে রিনসিমের কানে এলো এক পুলিশ অফিসার বলছেন যে ওরা বুঝতে পারে নি মেয়েটি ভারতীয়। ভেবেছিল মেয়েটি চীন বা জাপান থেকে এসেছে। আর বিদেশী চামড়ার মোহ এতোটাই যে তারা মেয়েটাকে একা পেয়ে….। মজা করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাবে ভাবেনি সেটা। চলন্ত গাড়িতে অবশ্য মজাটা পুরোপুরি করা যায় না। তাও আবার মেয়েটি হাত পা ছুঁড়ছিল। তাই ইচ্ছে থাকলেও চরম পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারে নি তারা। আর মেয়েটি যখন হিন্দিতে চিৎকার করতে শুরু করে তখন তারা বুঝেছিল যে ভুলটা হয়ে গেছে। গাড়ির গেট খুলে তাই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় মেয়েটিকে। তাই ধর্ষণের চার্জ না এনে মলেস্টেশনের মামলা করা হচ্ছে। পুলিশ অফিসারের কথা শেষ হতেই টিভির পর্দায় ভেসে উঠলো নারী অধিকার রক্ষা সমিতির এক সদস্যার মুখ। তিনি পুলিশ অফিসারের কথাই সমর্থন করলেন। জানালেন ওনারাও মেয়েটিকে প্রথমে দেখে বিদেশী ভেবেছিলেন। আসলে মণিপুর যে দেশের মধ্যেই সেটা মনে থাকে না তাদের। জাতীয় মহিলা কমিশনের এক সদস্যা জানালেন যে শেষ পর্যন্ত ধর্ষণ হয় নি এটাই বড় কথা। অবশ্যই মণিপুর বা অরুণাচল বা মেঘালয় দেশের মধ্যে। সেখানকার নারীরাও দেশের নারী।
রিনসিম নার্সকে কোনমতে ইশারায় বলে টিভিটা অফ করে দিতে।
সিরুই খাসঙের ফুলের আবাদিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে রিনসিম। তার পেছনে হেইসিং। রিনসিম হাত দু’টোকে মেলে ধরেছে প্রজাপতির মতো। হেইসিং ছুটছে তার পেছনে। মাঝেমাজেই হাসিতে গড়িয়ে পড়ছে তারা। রিনসিম ফানেক পরলেও হেইসিং প্যান্ট-শার্টই পরা। উখরুলে কত মজা! কত জায়গায় যেতে পারে তারা। খানখুই কেভ, জেনেফুই লেক, নিল্লাই চা বাগান…হেইসিং এগিয়ে এসে রিনসিমের হাত ধরে।ঠোঁট এগিয়ে দেয় রিনসিম।চোখ বন্ধ করে অপেক্ষায় থাকে হেইসিঙের। কিন্তু প্রত্যাশিত সেই উষ্ণ ঠোঁটটা রিনসিমের ঠোঁটের ওপর নেমে আসেনা বেশ খানিকটা পরেও। চোখ খোলে রিনসিম। চোখ খুলে দেখে হেইসিঙের মুখটা পালটে গিয়েছে। হেইসিঙের পাশে আরও দুটো ছেলে। তিনজনকেই তার চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছে ভাবতে না ভাবতেই বিদ্যুৎ চমকের মধ্যে তা তার মনে পড়ে যায়। এই তিনটে ছেলেই সেদিন রাতে তাকে একা পেয়ে চলন্ত গাড়িতে…। না মীমাংসা আজও হয়নি মলেস্টেশন না ধর্ষণ। মাসে অন্তত একদিন তাকে প্রতিদিন এখন ধর্ষিত হতে হচ্ছে আদালতে সবার সামনে।কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারে নানাবিধ চোখ চেটেপুটে নিচ্ছে তার শরীরের আগাপাশতলা। ফিসফিস করে বলতেও শুনেছে সে কাউকে কাউকে, “ওখানকার সব মেয়েগুলিই কি এরকম বিদেশী বিদেশি নাকি রে! সত্যি ওদের পুরো দোষ দিয়ে লাভ নেই। দেশের মধ্যেই বিদেশ থাকলে কে আর যায় ব্যাংকক!”
রিনসিম দেখে সেই তিনটে ছেলে তাকে ধরতে আসছে। হেইসিং হেইসিং বলে জোরে চিৎকার করলেও গলা দিয়ে স্বর বের হয়না রিনসিমের। দিগ্বিদিক না দেখে পিছু ফিরে ছুটতে শুরু করে রিনসিম। ছুটতে ছুটতে এসে দাঁড়ায় পাহাড়ের এক কোণায়। এদিকে তিনটে ছেলে ছুটে আসছে! নাঃ। আর ভাবনা নয়। রিনসিম ঝাঁপ দেয়।
প্রজাপতি হয়ে গেছে রিনসিম। সিরুই খাসং থেকে লাফ দিতেই শরীরটা হালকা হয়ে দুটো পাখা কোথা থেকে যেন আপনাআপনি গজিয়ে গেল রিনসিমের পিঠে। শক্ত মাটিতে না পড়ে, ছিন্নবিচ্ছিন্ন না হয়ে রিনসিম প্রজাপতি হয়ে মণিপুর, জাপান,চীন,উত্তরপ্রদেশ, কেরালা সব জায়গায় উড়ে বেড়ায় আজকাল। তার রঙবাহারী, মোমের মতো তুলতুলে শরীর দেখে সবাই তার পেছনে হাততালি দিয়ে বেড়ায়। তার আর এখন কোনো দেশ নেই, নেই কোনো জাত। সে একটা প্রজাপতি। সুন্দর, ফুটফুটে।
কোর্টেই কেবল দুপক্ষের উকিল লড়ে যাচ্ছে মলেস্টেশন না ধর্ষণ ছিল সেই দেশের ভেতর থাকা বিদেশি দেখতে জায়গার মেয়েটার কেসটা।
………………….শৌভিক রায়