সংস্কৃতির অঙ্গনে নিউ নরমাল যাপন

রঙ্গমঞ্চের বর্তমানের প্রথম সারির কুশীলবদের মধ্যে অন্যতম এক নিভৃত আলাপচারিতায় বলেছিলেন যে, ঘন্টা দুয়েকের মঞ্চের লাইভ অ্যাকশন এবং ওই মুহূর্তে দর্শকঠাসা অডিটোরিয়ামের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় অবগাহন তাঁর সু-অভিনয়ের অন্যতম অনুঘটক। শুধু নাট্যমঞ্চ কেন, এ কথার প্রতিধ্বনি সংস্কৃতি চর্চার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রের ধারক-বাহকদের মধ্য থেকেই উঠে আসে। দর্শক-শ্রোতার প্রতিক্রিয়াই তো তাঁদের পারফরমেন্সের উন্নতির চাবিকাঠি। অন্ধকার অডিটোরিয়ামের প্রবল জ্যান্ত আবহাওয়াই তো পারে আলোকোজ্জ্বল, রঙিন মঞ্চে ফুল ফোটাতে।

 তাহলে ... তাহলে এখন কি? গত প্রায় বছর দেড়েক ধরে এই মানুষের মুখে আনন্দ, সুখ-দুঃখ, রাগ ফুটিয়ে তুলবার কান্ডারীরা কেমন আছেন? কেমন আছে তাঁদের সৃষ্টিশীল মানসিকতারা ? বিশ্বব্যাপী থমকে যাওয়ার মুহূর্তের মাঝে তারাও কি স্থবিরতা-আক্রান্ত হয়েছেন ? নাকি ... ?

  বাৎসরিক নাটকের উৎসব, নাট্য প্রতিযোগিতা, পয়লা কিংবা ২৫ শে বৈশাখ উদযাপন, বিদ্রোহী কবির জন্মদিনে ঘটা করে সংগীতের মাধ্যমে মঞ্চ অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা, সঙ্গীত বা নৃত্যের সুচারু অনুষ্ঠানের আয়োজন- এসবকিছুই কোভিডের করাল গ্রাসে ভীষণভাবে বিঘ্নিত। প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাঝামাঝি সময়ে করোনার খানিক ঝিমুনির কালে মঞ্চ আবার বেশ কিছু স্থানে কথা বলে উঠলেও সে কথা শুনবার মানুষ কিন্তু খুব বেশি ছিলেন না অডিটোরিয়ামে। সামগ্রিকভাবে ভীতির পরিবেশ রচিত হয়েছে যে অনেক আগেই তারপর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রুদ্ধ রয়েছে অডিটোরিয়ামের দরজা। কোন সুদূর ভবিষ্যতে সে দ্বার উন্মুক্ত হবে তা বোধহয় একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।

  কিন্তু, আমরা এডজাস্টমেন্টে বিশ্বাসী। সাম্প্রতিক কোভিড আবহাওয়া সে অভ্যাসে আরো বেশি করে শান দিয়েছে মাত্র।  সবকিছু বন্ধ থাকার কালে সর্বস্তরের মানুষ বিভিন্নভাবে তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপে বদল এনেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে ধনী থেকে দরিদ্র, সরকার থেকে বিরোধী, শত্রু থেকে মিত্রের  দল যখন গৃহকোণে নিশ্চিন্তির আশ্রয় খুঁজে পেতে ব্যস্ত, ঠিক সেইসময় সংস্কৃতি চর্চা জগতে আনাগোনাকারীরা পিছপা হবেন কেন। অতএব ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ গুলি। গত দেড় বছরে নেট ব্যবস্থার সাহায্য নিয়ে ভার্চুয়ালি সংস্কৃতি প্রেমিকদের মধ্যে বন্ধন যেন আরো দৃঢ় হয়েছে। এ মুহূর্তে অসংখ্য ফেসবুক গ্রুপ পেজে প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যেয় প্রায় ঘন্টা দুয়েক ধরে অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকছেন সবাই। অগণিত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে আয়োজিত হচ্ছে থিয়েটার আড্ডা, বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিষয় ভিত্তিক সেমিনার কিংবা অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আসর। বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহারে সরগর হয়ে উঠেছেন এর ফলে আট থেকে আশির দল। নাট্য অঙ্গনে প্রাজ্ঞ গৌতম হালদার, অসিত বসু থেকে শুরু করে পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিল্পী, পশ্চিমবঙ্গের খুব সাধারন নাট্যকর্মী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মঞ্চ কাঁপানো অভিনেত্রী সবাই এর ফলে এসেছেন খুব কাছাকাছি। আলোচনার মাধ্যমে অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান, অতীত থেকে বর্তমান শিখছে অনেক কিছুই। শুরু হয়েছে বিভিন্ন অনলাইন থিয়েটার ক্লাস। ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় ধীরে হলেও বাড়ছে সেখানে। গত দেড় বছরে আয়োজিত হয়েছে বেশকিছু অনলাইন নাট্য প্রতিযোগিতা। নিজস্ব অনুশীলন কক্ষে নিভৃতে করা নাটকের ভিডিও ক্লিপিংস পাঠিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে উত্তর থেকে দক্ষিণের প্রচুর নাট্যদল। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় অনলাইন প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন সঙ্গীত নৃত্য আবৃত্তি অঙ্গনের শিল্পী থেকে শুরু করে অনুগল্প, কবিতার লেখক-লেখিকা কিংবা প্রাবন্ধিকেরা।  সন্ধ্যা লগনে বাস্তবিক অর্থেই ব্যস্ত থাকছে অনলাইন সংস্কৃতির অঙ্গন।

 কোভিড আবহে সংস্কৃতির অঙ্গনকে সচল রাখার এই নিউ নরমাল প্রক্রিয়ার বাইরে এ মুহূর্তে ভাবার কিছু নেই অবশ্যই। যদিও এসবের ছোঁয়ার বাইরেও অনেকে আছেন, যাঁরা মনোযোগী দর্শক হয়েও দূরে রয়ে গেছেন, যাঁরা কুশলী শিল্পী হলেও রয়ে গেছেন এ গণ্ডির বাইরে। বলাবাহুল্য, নিতান্ত বাধ্য হয়েই। এদের কাছে একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার কিংবা সে ফোনে প্রয়োজনীয় জিবি ভরে অনলাইন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ একটা বিরাট বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। মনে ইচ্ছের পাহাড় জমা রেখে এই ধারার সংস্কৃতি প্রেমিকরা কিন্তু এখনও তাকিয়ে আছেন বন্ধ হয়ে থাকা অডিটোরিয়াম গুলোর দরজার দিকে।
                                                            .................... নীলাদ্রি বিশ্বাস