শেষ  বিকেল

সকাল থেকেই  ধুপধুপ শব্দটা শুরু হয়েছে।প্রথমে ধীরে একটানা।বেলা বাড়িতেই শব্দটা বাড়তে থাকে আরো জোর  জোরে।আজ আর বাজারে যেতে ইচ্ছা করছে না  সুমনা দেবীর।।সারাদিনের যে মেয়েটা থাকে সঙ্গে-ছন্দা-ওই যায় সঙ্গে । আজ ওকেই পাঠালেন একা।টুকটাক জিনিস।একার সংসারে আর কতটুকু বা লাগে। মেয়েরাও রাগারাগি করে রাস্তা পেরিয়ে দোকান বাজার গেলে।তবু,সকালের দিকে একবার না গেলে ভালো লাগে না।অনেক দিনের অভ্যাস তো। ওদের বাবা চলে গেছেন তা প্রায় বছর দশেক হলো। তারপর থেকে দোকান বাজার দুধ সবই সামলেছেন একা হাতে। অফিস,সংসার,ঘর বাড়ি ছেলেপুলে মানুষ সবই করেছেন.চিরকাল নিজেই।।কোনদিন একটা রান্নার  লোকও রাখেন নি।বড় মেয়ে নন্দিতার বিয়ে হয়েছে,তাও বছর পনেরো হয়ে গেল।ওর বাবা যেদিন চলে গেলেন হঠাত করে তখন ওরা নিউইয়র্ক। নাতনিটা হয়েছে সবে। এদিকে পনেরো দিনের বাচ্চা নিয়ে এতটা পথ—সুমনাই না করেছিল আসতে।মানুষটাই যখন চলে গেল তখন আর কি।তারপর এলো অফিস থেকে অবসরের দিন। এই সংসার আঁকড়েই তো বাঁচা তখন।।কাজই  ছিল তার জীবন, কাজই তার আনন্দ ।বছর দুয়েক হলো ছোট মেয়ে শিবানীর বিয়ে হয়ে যাবার পর  জীবনটা যেন কাজহীন হয়ে গেল। প্রথম প্রথম  মেয়েটা কাছাকাছি থাকতো।  দেখা করে যেত ।দুবেলা ওর টিফিন করে রাখা। এটা ওটা রান্না করা ।তারপর সোমেশও ট্রান্সফার  হয়ে গেল ব্যাঙ্গালোরে ।মাকে বারবার সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল শিবানী।কিন্ত  সুমনাদেবী রাজি হন নি।।চিরকালই  তিনি স্বাধীন ভাবে থেকেই  অভ্যস্ত।  মেয়ে জামাইয়ের সংসারে তিনি থাকবেন কেন? তার এই শ্বশুরের ভিটে।। এ অঞ্চলের  প্রথম পাকাবাড়ি।এখন বাড়িটার অবস্থা যদিও ভালো নয় ,প্রতি বর্ষায় একবার  অত্যন্ত , জল ঢুকবেই।সবসময়ই ভিজে ভিজে স্যাতস্যাতে ,চাপড়া খসে পড়ছে এখানে ওখানে-তবু এই তার আদি শ্বশুর ভিটে।ওদের বাবা থাকতে অনেকবার পুরো ছাদ খসিয়ে ,প্লাস্টার চটিয়ে নতুন করে করেছিলেন। কিন্ত বছর পাঁচ দশ যেতেই  যে কে সেই।পুরানো সেগুন কাঠের দরজা,জানলা। দশ ইঞ্চি পুরু দেওয়াল যেন শক্ত পাথরের মত ।প্রমোটাররা তো রাত দিন পড়ে আছে।”
ভালো ফ্ল্যাট  দেবো মাসিমা। 50 পারসেন্ট আপনাদের। কেন এতো কষ্ট করে থাকবেন বলুন তো। টাইলস বসানো বাথরুম,কল খুলতেই  জল,মার্বেল  ফ্লোর।।আপনার পায়ে ব্যাথা,শ্বাসরোধ কষ্ট। দেখবেন  কতো আরামে থাকবেন। “
শেষ পর্যন্ত  দুই মেয়ের চাপে রাজী হলেন সুমনা দেবী।তার আর কটা দিন।ওরা যা চায় হোক।।মেয়েরাও চায় না এতো বড় বাড়িতে মা একা থাকুক।আজকালকার দিনকাল।ফ্ল্যাট  হলে একটা সিকিউরিটি গার্ড  থাকবে।একই বাড়িতে আরো পাঁচটা  লোক পাবে বিপদে আপদে।
তবু  ইচ্ছা হয় না সুমনার  ।এই ঘর ,রান্নাঘর, কলতলা-সর্বত্র শুধু স্মৃতি ।প্রথম  এ বাড়িতে  বউ হয়ে আসার স্মৃতি ,লোডশেডিং এ ছাদে মাদুর পেতে তারা গোনার স্মৃতি,, ,ফুঁ দিয়ে দিয়ে উনান জ্বেলে শীতের সকালে সবার জন্য চা করে আনা,পৌষ সংক্রান্তির ভোরে উঠোনে কাঁচা কাঠের জ্বালে ধোঁয়ার গন্ধ মাখা বাস্তু পূজোর পায়েস বানানো।কত কত স্মৃতি শুধু জড়িয়ে ধরে তাকে।বাড়ির পিছন দিকের বাগান আর এঁদো পুকুর থেকে বর্ষার রাতে ব্যাঙের ডাক ভেসে আসত ,লেবু ফুলের গন্ধ  আসতো পিছনের জানলা দিয়ে,।শীতের সকালে কোঁচড় ভরে শীম পেরে আনতো বাগান থেকে, নিজের হাতে লাগাতো সে সব গাছ । রাতের বেলা সংসারের কাজ সেরে, মেয়ে,শ্বশুর  শাশুড়ি  ঘুমিয়ে পড়লে সুমনা আর সুবলবাবু  মাঝে মাঝেই উঠতো ছাদে।পাশাপাশি বসে প্রাণ ভরে নিত বৈশাখের দেখিনা বাতাসের সোহাগ।দূর আকাশের  দিকে তাকিয়ে সুবল বাবু দেখাতেন –
“ঐ দেখো সপ্তর্ষিমন্ডল-ক্রেতু,পুলহ ,পুলস্ত। কতো কথা জমা এই বাড়ির কড়িকাঠে, বারান্দায়। ওদের বাবার নিজের হাতে লাগানো মেহগনি , কাঞ্চন ,রুদ্রপলাশ-সব যখন এক এক করে কাটা পড়ল সুমনার  মনটা  যেন বড্ড হু হু করে উঠছিল। মনে হচ্ছিল কোথাও পালিয়ে যাই। আজকালকার মেয়েরা এসব  সেন্টিমেন্ট টেন্টিমেন্ট বোঝেনা।।ওরা অনেক প্রগতিশীল ,বাস্তব ।পুরোনো আঁকড়ে  থাকে না,থাকতে চায় না।।কিন্তু  কি অদ্ভুত -আন্টিক শো পিস দিয়ে কিন্ত  ঘর সাজায় বেশ সুন্দর  করে।
দুই মেয়ে সংসারী হয়ে যাবার পরই ,সুমনা দেবী  একটু একটু করে বুঝলেন সংসারের প্রতি  তার টানটাও যেন কমে আসছে ।। যে সংসারের প্রতিটি কানাকড়ি,রান্নাঘরের প্রতিটি কৌটা,আলমারি প্রতিটি তাক,বাসনপত্র,এমনকী ছেঁড়া মাদুর , পাপোশও ছিল তার প্রাণ,আজকাল সবই যেন কেমন শূন্য লাগে।কিছুই করতে ইচ্ছা করে না। ছন্দা মেয়েটা ভালো।সারাদিন আগলে রাখে।।সত্যি জীবনটা বড্ড অদ্ভুত।পরের জন কত আপন হয়ে যায় সহজেই।।
“ও দিদা ওঠো।। কিছু খাবার টাকার বানাও দেখি আগের মত।মুড়ি মাখবো। তালে টিভিটা দেখ  ।শুয়ে শুয়ে থাকলে শরীল বসে যাবে কিন্তু। পিঠে তেল দিয়ে মালিশ করে দেব তো বল।।চলো আমার সঙ্গে হেটে আসবে।“
এরকম নানান আবদারের সেই এখন সঙ্গী।
প্রমোটারের পরামর্শ  মতো পাড়ার মধ্যেই  এক প্রতিবেশীর  একতলায় ভাড়ার ব্যবস্থাও  হয়ে গেল। ছেলেটা করিৎকর্মা।।মাঝে শিবানী এসে সই সাবুদ করে পাওয়ার অব আটর্নী দিয়ে গেছে। ছেলেটা প্রায় রোজই আসে এটা ওটা সই করাতে।
“মাসিমা।দিদিদের বলে দিয়েছি।আপনি এখন আমার কেয়ার থাকবেন।কোন অসুবিধা হবে না।যাতায়াতের পথে দুবেলা দেখে যাবেন নিজের ফ্ল্যাট। বেহাল দেখলেই ছেলের মতো আমাকে জানাবেন।জল টল দিচ্ছে কিনা, কোন জাগায় কিরকম ডিজাইন সব আপনি দেখে নেবেন।এই বেশ ভালো হল কি বলেন।দিদিরাও নিশ্চিন্ত হল।দূরে থাকে।সবসময়ই  চিন্তা করে আপনার জন্য।“
আজ সকাল থেকেই  বাড়ি ভাঙা শুরু হল।ভিত পূজা হয়েছে কাল। ভোর থেকেই সুমনার বুকের ভেতরটা যেন কেমন করছে।কিছুক্ষণ  বাদে ছন্দে এসে বললো-“ও দিদা ।দেখ গে যাও।কতসব বড় বড় যন্ত্র  এনেছে।ধুপধাপ করে ভাঙা শুরু হয়ে গেছে।দেখে এসো যাও।“
সুমনা স্নান সেরে পুজোয় বসে।সব দরজা জানলাগুলো টাইট করে বন্ধ করে দেয়।
যেন একফোঁটা শব্দও কানে যেতে না পারে।মনটা বড় অস্থির লাগছে।সকাল সকাল দুই মেয়ে ফোন করেছিল-“শোন মা,,একটু নতুনের  সাথে মানাতে শেখো।দেখবে কতো ভালো থাকবে।বাবা তো জিদ করে কিছুই ভোগ করতে পারল না। তুমি সাবধানে থাকবে।“
পূজো সেরে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন সুমনা।রান্নাঘরের  পাশেই ছিল ওদের শোবার ঘর।ফুলশয্যার রাতে সে কী বৃষ্টি।একটা ব্যাঙবাবাজী ঢুকে পড়েছিল ঘরে।সুমনা তো ভয়ে কাঠ।তাকে বের করতে নতুন বরেরও কালঘাম ছুটে গেছিলো । সে সব ভাবলে আজও হাসি পায় সুমনার ।যেন সেদিনের ঘটনা।।যেদিন ছোট্ট নন্দিতাকে নিয়ে হসপিটাল  থেকে এলো ওরা-প্রথম সন্তান।সারা রাত দুজনে জেগে কাটিয়ে দিল পাছে মেয়ের চোখে মুখে বালিশ চাপা পরে যায়।

হঠাত একটা প্রচন্ড শব্দে চিন্তার তারটা ছিড়ে গেল সুমনার ।।হুড়মুড় করে একটা বাজ পড়লো যেন ঘরের মধ্যে। ছন্দা দৌড়াতে দৌড়াতে এলো–“ও দিদা,দেখবে যাও গে।একদিনের মধ্যেই পুরো বাড়িটা বোধহয় গুড়িয়ে দেবে ওরা।।।তোমাদের শোবার ঘরের পুরো ছাদটা প্রায় ভেঙে ফেলল এর মধ্যে।
সুনীতার বুকের মধ্যেও কে যেন হাতুড়ি মারতে লাগলো।ছেড়া তারের মতো একটা ভাঙা সুরের যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো বুক থেকে মাথায়। অনেক অনেক দিন পর মনে হল যেন উনি এসেছেন-।হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছেন ছাদে।
“দেখো দেখো নীতা-ঐ যে দূরে কালপুরুষ,সপ্তর্ষিমন্ডল।।আর ঐ যে ওটা। ওটা তো আমার ধ্রুবতারা-তুমি।“ঠান্ডা একটা দেখিনা বাতাস যেন খেলে বেড়াতে লাগলো গোটা ঘর জুড়ে।