সালটা ২০১৮। গভীর রাত। বৃষ্টি পড়ছে অঝরে। একটা ফোন বিশ্বজিৎ বাবুকে ভীষণ বিচলিত করে তুলল। বন্ধু গৌর সরকার ও কাবলু সেনগুপ্তকে সাথে জল কাঁদা পেড়িয়ে পৌছালেন তিস্তাচরে। যে খবর পেয়েছেন তা একেবারেই ঠিক। বর্ষার ভয়াল তিস্তা তার ১২০০০ স্বপ্নের সাথে যুদ্ধে মেতেছে। উৎখাত করে চলেছে তাদের একে একে। অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র অল্প কিছু। তারা যে চিৎকার করে তাকে বলছে, “দাদা, আমাদের বাঁচাও।” চোখের সামনে নিজেদের স্বপ্নগুলিকে নদীর জলে ভেসে যেতে দেখে বড় অসহায় হয়ে পরেন তাঁরা। কি করে থামাবেন এই ধ্বংসলীলাকে? এযে প্রকৃতির নিষ্ঠুর প্রতিশোধ। ভয়কে তুচ্ছ করে তিস্তার দিকে অনেকটা এগিয়ে গেলেন বিশ্বজিত বাবু। কোমর সমান জলে দাড়িয়ে তিস্তার জল তুলে নিলেন দু-হাতে। তিনবার তিস্তার বুকে জল নিবেদন করে তিস্তাবুড়িকে অভিযোগ করলেন প্রার্থণার মাধ্যমে, “মা তিস্তা তুই যদি শান্তি পাস তবে সব ভাসিয়ে নিয়ে যা। আর আসব না আমরা তোর কাছে।” পেছন ফিরে আর একটি বারের জন্যও ঘুরে তাকালেন না তাঁরা স্বপ্নভঙ্গের সেই লাইভ দৃশ্যগুলির দিকে। সারারাত ঘুমাতে পারেননি। কেমন আছে তাদের দেখে আসা শেষ স্বপ্নগুলি? নাকি তাদের ভালোবাসার একফালি তিস্তাচর এখণ একেবারেই স্বপ্নহীন?
পাখীদের কিচিরমিচির ছন্দের সাথে ভোরের আলো ফুটছে। বুকফাটা একটা বেদনা দীর্ঘশ্বাস সৃষ্টি করে চলে অনবরত। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন বিশ্বজিৎ বাবু। তাঁর আবার ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে তিস্তাচরে। কিন্তু না, তিনি যে তিস্তাবুড়ির সামনে প্রতিজ্ঞা করে এসেছেন আর যাবেন না তাঁদের স্বপ্নচরে। বুড়িতিস্তা গলা টিপে মেরেছে সব স্বপ্নদের। হঠাৎ বালিশের পাশে রাখা মুঠোফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল।
এ বছর (২০২০) মাঘী পূর্ণিমার রাতে আমি আর বন্ধু কেডি তাবু খাটিয়ে ছিলাম বার্নিশ এলাকার তিস্তাচরে। রাতের তিস্তার অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে তথা আর এক ফালি তিস্তাচরের অভিজ্ঞতা নিতে। পরেরদিন ঘন কুয়াশার চাঁদরে মোড়া সকালে একজন ভদ্রলোককে আমাদের দিকে আসতে দেখলাম। উনি এলেন। নিজের পরিচয় দিলেন। বিশ্বজিৎ দত্ত। নিবাস ময়নাগুড়ি রোড। প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য, বার্নিশ গ্রাম পঞ্চায়েত। বিশ্বজিত বাবুকে আমাদের দিকে আসতে দেখে প্রথমে আমাদের মনে একটু আশঙ্কা হয়েছিলো। ভেবেছিলাম হয়তো এখানে থাকার জন্য উনি কিছু দাবী করবেন আমাদের কাছে।কিন্তু অবাক করে দিয়ে উনিই আগে বাড়িয়ে দিলেন হাত। হাত মিলিয়ে জানালাম আমাদের পরিচয়। জানালাম আমাদের এই বাউন্ডুলেপনার উদ্দ্যেশ্য। বিশ্বজিৎ বাবুর চোখটা ছলছল করে উঠলো। বুকে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। তারপর বলে চললেন, “আজ আমার স্বপ্ন স্বার্থক। এইতো চেয়েছিলাম আমি। পাখীরা বাসা বাধবে। রুক্ষ বালুকা রাশির ওপর গাছেরা ছায়া ছড়াবে। তিস্তার মায়াবী রূপ এখানে বসে পর্যটকেরা দেখে মুগ্ধ হবেন সর্বোপরি অত্যন্ত উর্বর এই কূলটা রক্ষা পাবে। সত্যি বলছি আজ আমি ভীষণ খুশী। ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা কি আনন্দ হচ্ছে আজ আমার মনে”। তিস্তার বুকে হেলে পরা একটি গাছের ওপর বসে গল্পে মশগুল হলাম আমরা। আমাদেরও সৌভাগ্য আমরা পেয়ে গেছি সত্যিকারের পরিবেশপ্রেমী একজন মানুষকে। ওনার মুখ থেকেই জানতে পারলাম অনেক কথা। তারপর বুঝতে পারলাম তার এই অত্যাশ্চর্য অনুভুতির রহস্যটুকু।
পরিবেশকে কেই না ভালোবাসে। কিন্তু পরিবেশের জন্য অন্তর থেকে কিছু করার তাগিদ কজনেরই বা থাকে? ২০১২ সালে বিশ্বজিৎ বাবু বার্নিশ গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য থাকাকালীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিস্তাতটের সুবিস্তির্ন এই এলাকায় বৃক্ষ রোপণ করবার। দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে বেড়ালেন। সহযোগিতা পেলেন বিডিও অফিস ও গ্রাম পঞ্চায়েতের। সামাজিক বনসৃজনের আওতায় তিস্তার এই চরে রোপণ করলেন ১২০০০ চারাগাছ। ১০০ দিনের কাজের শ্রমিকের সাথে নিজেরাও খেটেছিলেন সাধ্যমত। আজও খেটে চলেছেন।
গ্রীষ্মের তপ্ত দিনে জলের অভাব দেখা দিয়েছিল। ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন পাম্পসেট, শ্যালো মেশিন ও পাইপের। তিস্তার রোদ, জল, বালু মেখে আর বিশ্বজিৎ বাবুর অপত্য স্নেহে শিশু, শিমুল, গামারি, চিকরাশি, জারুলেরা পরম যত্নে বড় হতে লাগল তিস্তাপারে। কিন্তু প্রতিবছরেই বাঁধ সাধে ভরা বর্ষার তিস্তা। ক্ষতিসাধন করে চারাগাছ গুলির। অতঃপর সকলের সাথে শলাপরামর্শ করে সেই স্থানে স্থাপন করেন তিস্তাবুড়ির মন্দির। জনশ্রুতি রয়েছে তিস্তাবুড়ি জাগ্রত দেবী। ভক্তের কাতর প্রার্থণায় উনি সারা দেন। তাই তিস্তাবুড়ির বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হবার সাথে সাথে মন্দিরের পাশে নির্মান করেন একটি দোচালা ঘরের। বসবার জন্য জায়গা তৈরী হয়। আজ তার কিছুই নেই। তিস্তাই নাকি সব গ্রাস করে নিয়েছে।
ফোনটা তুললেন বিশ্বজিৎ বাবু। ফোনের ওপারে উত্তেজক গলা। “দাদা তিস্তাবুড়ি কথা শুনেছে। অনেক দূরে চলে গেছে তিস্তা”। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে বিশ্বজিৎ বাবু ছুটে গেলেন তার স্বপ্নচরে। একি? কি দেখছেন উনি? নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বিশ্বজিৎ বাবু। গতকাল রাতের তিস্তা গতিপথ বদলে বইছে অনেক দূরে। বেঁচে গেছে তার শ-খানেক শিশুগাছ। সেদিনের সেই শ-খানেক শিশুগাছের মাঝেই আমরা তাবু খাটিয়েছিলাম মাঘী পুর্ণিমার রাতে। দু-একটা শিমুল গাছও রয়েছে এখানে। জায়গাটির স্থানীয় নাম শিশাবাগান। তিস্তা ব্রীজ পার করে জোড়াবাধের ডানদিকের রাস্তা ধরে বার্নিশের দিকে তৃতীয় স্পারের মাথায় এই শিশাবাগান। একদিকে দিগন্ত বিস্তৃত তিস্তার মনভোলানো রূপ আর অপর দিকে বিস্তির্ন শস্যখেত। তার মাঝে নীল আকাশের নীচে সবুজ ছায়ার মাঝে লুকিয়ে থাকা নিস্তব্ধ সৌন্দর্য্যের স্বর্গরাজ্য এই শিশাবাগান।
শিশাবাগানে কাটানো সেই রাতের একটি অভিজ্ঞতা পাঠকদের সাথে ভাগ না করলে আজকের এই গল্প অধরাই থেকে যাবে। সেদিন রাত ১১ টা নাগাদ আমরা টেন্টের সামনে বসেই ডিনার করি। হাত ধোবার পর টিফিন বাক্সের একটি অংশ কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। টেন্টের আশপাশ প্রচুর খুঁজেছি। অবাক হয়েছিলাম দুজনেই। কোন কুকুর, বেড়াল বা শেয়াল নজরে আসেনি। অগত্যা যখন হাল ছেঁড়ে দিয়ে টেন্টে প্রবেশ করবো ঠিক তখণ দেখি টেন্টের পাশে পরে রয়েছে টিফিন বাটিটি। যাইহোক চেন আটকে টেন্টের ভেতর স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পরে পরলাম দুজনেই। টেন্টের ভেতর পূর্ণ চাদের নরম আলো। সেটা গায়ে মাখতে মাখতেই দু-চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে চললাম। আমার ঘুম হলো না মোটেই। কখণও মনে হচ্ছিল বাইরে থেকে কেউ আমার আঙুল চেপে ধরছে। কখণও মনে হল টেন্টের নীচে কেউ হাত ঢুকিয়ে পিঠে খামচি মারছে, কখণও মনে হচ্ছিল কেউ স্লিপিং ব্যাগের ভেতর কিছু চলমান বল ঢুকিয়ে দিয়েছে আবার কখণও মনে হয়েছে কেউ জাপটে ধরছে জোড়ে। মাঝে মাঝেই ভেঙে গিয়েছিল ঘুম। টেন্টের চেন খুলে বাইরে টর্চ মেরেছি বহুবার। কেডিও সারা দিয়েছে প্রতিবার।
রিভার বেডে একটা শেয়াল নজরে এসেছিলো। লাঠি দেখানোয় আর এমুখো হয়নি। রাতে কেডিকে এসব কিছুই বলিনি। বলিনি লজ্জায়। জানতাম কেডি কয়েকটা কাঁচা খিস্তি দেবে। আমি হলেও তাই করতাম। কারন বহু দূর্গম এলাকায় এর আগে আমরা এভাবে প্রায় পনের বিশ বার থেকেছি। কোথাও এ ধরনের কোন অভিজ্ঞতা আমার হয়নি। এর কোন সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে সকালে দাঁত মাজতে মাজতে কেডিকে খুলে বললাম সব। কেডি অবাক হয়ে বলল, “বল কী নীলু? আমারও তো ঘুম হয়নি। একি অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে গতরাতে। তবে আমি দেখেছি আমার স্লিপিং ব্যাগের ভেতর কেউ দুটা কচ্ছপ ঢুকিয়ে দিয়েছে আর সেগুলি চলছিলো।” দুজনে দুজনার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম আর কি। এর উত্তর খুঁজতে বহু মানুষের সাথে শেয়ার করেছি এই কথা। নানা জনে নানা মত দিয়েছেন। কেউবা আবার হেঁসে উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে এক তান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন বন্ধুর কথা খুব মনে লেগেছিল।
সে বলেছিলো,”তোরা যে ওখান থেকে বেঁচে ফিরেছিস সেটাই ভাগ্য। নিশ্চই তোরা ওখানে এমন অশৌচ কাজ কিছু করেছিস যা আত্মারা মেনে নেয়নি। কারন এই সমস্ত নির্জন স্থানেই অতৃপ্ত আত্মারা ঘাটি গেঁড়ে থাকে। আর একটা কথা বলে রাখি, কোনোদিন পূজার পর ফেলে দেওয়া ফুলের মালা পা দিয়ে মাড়াবি না। যদি তা করিস বেঁচে ফিরতে পারবি না, সাবধান।” প্রকৃতির ডাকে সারা দিয়ে নদীর চরকে ব্যবহার করাটা তো অশৌচ হতে পারে না তবে আজ স্বীকার করছি এমন একটি কাজ আমরা হয়তো করেছিলাম। রাতে গ্লাসের প্রয়োজন হয়েছিলো আমাদের। আমাদের কাছে তা ছিল না। ভুলে গিয়েছিলাম সাথে আনতে। বাধ্য হয়ে কিছু মানুষের ব্যবহৃকৃত ফেলে দেওয়া প্লাষ্টিকের গ্লাস কুড়িয়ে এনে আমরা পুনরায় সেটা ব্যবহার করেছিলাম। তান্ত্রিক বন্ধুকে এটা বলিনি ইচ্ছে করেই। তবে হয়ত চাকুরী বাকুরী ছেড়ে দিয়ে সে তন্ত্রসাধনাতেই ঢুকে যাবে। ভুত-প্রেত-আত্মা এসব থেকে আমরা অনেক দূরে থাকি। বিশ্বাস করিনা দুজনের কেউই। তাইতো ‘ভূত ভগবান সয়তান বনাম ডক্টর কাভুর’ নামক বইটি সবাইকেই পরার কথা বলি। কিন্তু যে আজব ঘটনার সম্মুখীন আমি আর কেডি হয়েছিলাম তার উত্তর আজও আমরা খুঁজে বেরাই। না, তান্ত্রিক বন্ধুর সেই কথা মনে লাগলেও আমরা মোটেই তা শিরধার্য করে নেইনি। সুতরাং আপনারাও বিন্দুমাত্র ভয় পাবেন না এই অনুরোধ রইলো। সময় সুযোগ হলে দিনে দিনেই ফ্যামিলি নিয়ে গিয়ে ঘুরে আসতে পারবেন শিশাবাগান থেকে। ভালো লাগবেই। কথা দিলাম।
……………………নীলাঞ্জন মিস্ত্রী