স্কুল কলেজ তো এক বছরের ওপর থেকে বন্ধই পড়ে আছে। অফিস-আদালতেও এখন “কার্যত লকডাউন” জারি। এমতাবস্থায় কি ঘরে বসে বসে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন? হাঁপিয়ে উঠেছেন মোবাইল আর সোশ্যাল মিডিয়ায়? নিত্যনতুন রান্নাবান্না, ফেসবুক, ইউটিউবেও আর মন বসছে না? তাহলে আর মন বসানোর চেষ্টাও করবেন না। অনেক তো হলো অন্তর্জাল জড়িত ক্রিয়াকর্ম। এবার না হয় একটু অন্য দিকে মনোনিবেশ করা যাক।
এই বন্দিদশায় আরো বেশি করে বাঙালি হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন তো। মানে, কিছু বাংলা বই, বাংলা সিনেমার সান্নিধ্যে আসুন। না না, নিজেদের জন্য নয়। প্রধানত বাড়ির খুদেটির জন্যই এই পন্থা অবলম্বন করুন আর খুদেটিকে বাংলা নামক সাগরে সাঁতার শেখাতে হলে আপনাকে তো জলে নামতেই হবে। তখন দেখবেন, স্বাভাবিকভাবেই সময় কেটে যাচ্ছে কত সহজে।
আসলে বর্তমানের এই সময়টাতে বিশেষ করে শিশুরা বাংলার সান্নিধ্য ঠিক কিভাবে কতটা পাচ্ছে তা একটা প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়েছে। ভবিষ্যতে “কেরিয়ার” গড়ার লক্ষ্যে বুঁদ অভিভাবকদের একাংশ তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করছেন। ফলত, শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ পড়াশোনা শুরুই করছে বাংলা কে “সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ” হিসেবে রেখে। অনেকের তো আবার বাংলার থেকেও হিন্দিকে সহজ বলে মনে হয় এবং আবারও ওই কেরিয়ারের সুবিধার্থে আসবে বলে তাকে “সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ” করছে। স্বভাবতই বাংলার চর্চা তাদের আর করা হয়ে উঠছেনা। তাছাড়াও আজকাল বাংলা ভাষার মাঝে কয়েকটা করে হিন্দি বা ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে কথা বলার প্রবণতা অত্যধিক রূপে বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা এভাবে কথা বলছে তাদের হয়ত সেটাকে স্মার্টনেস বা ভাষার আধুনিকীকরণ বলে মনে হলেও, কিছু কিছু আদ্যোন্ত বাঙালির পক্ষে তা হয়ে উঠছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ইংরেজি ছাড়া বর্তমান যুগ অচল, এ কথা অস্বীকার করার সামর্থ্য কারো নেই। কিন্তু তার পাশাপাশি বাঙালি হিসেবে নিজের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার দায়ও তো আমাদের ওপরই বর্তায়। মাতৃভাষা দিবসে “মোদের গরব মোদের আশা” বলে পদ্য করে লম্বা লম্বা রচনা লিখে পরদিনই “বাংলাটা ঠিক আসে না” গোছের মনোভাব পোষণ করে থাকলে তাতে বাংলা ভাষার অসম্মান বই আর কিছু হয়না।
ঠিক এ কারণেই অভিভাবকদের ওপরেই দায়িত্ব বর্তায় সন্তানদের মধ্যে বাংলা ভাষার রস সঞ্চার করা। আমরা বাঙালি তবে একটা দিন কেন, একটা গোটা ঘন্টাও সম্পূর্ণ বাংলায় কথা বলার সামর্থ্য আজকে আমরা হারিয়েছি। হ্যাঁ, অবশ্যই সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথেই এটা ঘটেছে। এ কারণেই তো আরো বেশি করে বাংলার প্রতি মনোনিবেশ বাড়ানো উচিত।
তাই বলে কি হিন্দি বা ইংরেজি বা অন্য যে কোন বিদেশী ভাষার চর্চা ছেড়ে দেব? অবশ্যই নয়। চর্চা আমাদের জারি রাখতেই হবে। তবে সেটা যেন চর্চাতেই সীমাবদ্ধ থাকে এটাও দেখতে হবে। সাবলীল আমরা অবশ্যই হব কিন্তু সে সাবলীলতা যেন আমাদের অভ্যাস না হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষই আছেন যারা অনেকগুলি ভাষা বলতে সক্ষম, সাবলীল। তাই বলে কি তিনি নিজের মাতৃভাষার জ্ঞান বিসর্জন দিয়ে তারপর ভাষাগুলি আয়ত্ত করেছেন ?
যে ভাষায় আমরা প্রথম নিজের মা কে ডাকি সেই ভাষাকে কি কখনো হেলা করা উচিত?
আমাদের স্বাভাবিকতা লুকিয়ে থাকে এই মাতৃভাষার আড়ালে। যতই আমরা বিদেশিদের অনুকরণ করার চেষ্টা করি না কেন কখনো কি বিদেশি হয়ে উঠতে পারব? তাহলে কেন বৃথা তাদের অনুকরণ করতে যাব? একটা সময় হাজার হাজার বাঙালিকে গোটা বিশ্ব অনুসরণ করেছে, আজ সেই বাঙালি জাতির বংশধর হয়ে আমরা কেন অন্য জাতিকে অনুকরণ করব?
খাঁটি বাঙালিয়ানার টানে কত বিদেশি এ দেশে এসেছেন, আর আমরা হেলায় সেই বাঙালিয়ানাকে অবজ্ঞা করে চলেছি দিনের পর দিন। শুধু মাতৃভাষা দিবস বা নববর্ষের দিন নয়, বছরের প্রতিটি দিনকে বাঙালিয়ানায় ভরপুর করে তোলা উচিত।
শার্লক হোমস এর পাশাপাশি আমরা যেমন ফেলুদা, ব্যোমকেশ বা মিতিনমাসি কে গোগ্রাসে গিলে খাই ঠিক তেমনই প্রতিটা পদক্ষেপে বাংলা কে সঙ্গী করে নেওয়া হলে তবেই ঘটা করে ভাষা দিবস পালনের মাহাত্ম্য সঠিকভাবে প্রতিস্থাপিত হবে, তবেই ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’- বলাটা সার্থকতা লাভ করবে।
………………. চিরদীপা বিশ্বাস