হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা পার্বণের মধ্যে রথযাত্রার উৎসব একটি প্রসিদ্ধ উৎসব। আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে এই রথযাত্রার অনুষ্ঠিত হয়। শুক্লা একাদশীর দিন পুনর্যাত্রা বা উল্টো রথ হয়। হিন্দুরা রথযাত্রার দিন পুণ্যার্জনের জন্য রথের দড়ি টেনে থাকেন। তাদের বিশ্বাস রথের দিন শ্রী শ্রী জগন্নাথ বা শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করলে আর পুনর্জন্ম হয় না। বাংলা তথা ভারতের সর্বত্রই রথযাত্রার উৎসব উদযাপিত হয়। এর মধ্যে হুগলী জেলার মাহেশের রথযাত্রা, মায়া পুরের ইস্কনের রথযাত্রা, ওড়িশার পুরীর শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উল্লেখযোগ্য। রথযাত্রার উৎসবের প্রথম দিকে কিন্তু জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা বা শ্রী কৃষ্ণের রথযাত্রা বলা হতো না। বলা হত মৎস্যেন্দ্রনাথের রথযাত্রা। তবে কে এই মৎস্যেন্দ্রনাথ!
অনেক দিন আগের কথা, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তখন নাথ ধর্মের প্রচলন হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে উল্লেখ আছেনাথ সম্প্রদায়ের আদিগুরু হলেন শিব। তিনিই আদিনাথ। নাথ ধর্মে ন’জন গুরুর কথা জানা যায়। বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরা তাঁদের চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যের সঙ্গে এই ন’জন নাথেরও পূজা করতেন। মোটামুটি তাঁদের নামধাম এইরকম ঃ পূর্বে গোরক্ষনাথ, উত্তরাপথে জলন্ধর (জালামুখী তীর্থ), দক্ষিণে নাগার্জুন (গোদাবরী নদীর কাছে ), পশ্চিমে দত্তাত্রেয়, দক্ষিণ পশ্চিমে দেবদত্ত, উত্তর পশ্চিমে জরভরত , কুরুক্ষেত্র ও মধ্যদেশে আদিনাথ এবং দক্ষিণ পূর্বে সমুদ্রোপকূলে মৎস্যেন্দ্রনাথ। এই হচ্ছেন ন’জন নাথগুরু। একদা ভারতের কোন কোন দার্শনিক গোষ্ঠী জড়দেহকে মুক্তির বাধা না বলে সোপান হিসেবেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরা নানা ধরনের যৌগিক, তান্ত্রিক, রাসায়নিক ও আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত ভিষগ্ বিদ্যার সাহায্যে জড়দেহকে পরিশুদ্ধ বা পরিপক্ক করে তার সাহায্যে মোক্ষ-মুক্তি নির্বাণ লাভের আকাঙ্ক্ষা করতেন। এঁরা দর্শন হিসেবে পতঞ্জলির যোগদর্শন এবং ক্রিয়া কর্ম হিসেবে তন্ত্র ও হঠযোগের বিশেষ সাহায্য নিয়ে পিন্ড দেহকে দিব্য দেহে পরিণত করতে বিশেষ প্রয়াসী হয়েছিলেন। এক কথায় এঁদের যোগী বা যুগী সম্প্রদায় বলে। এঁরা “কায়াসাধনা ” করতেন । অর্থাৎ পিন্ডদেহ বা ভূতকায়ার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। যোগের দ্বারা প্রাণায়ামাদির সাহায্যে এঁরা নিঃশ্বাস প্রশ্বাসকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রিত করতে পারতেন। পুরক কুম্ভক রেচক শীর্ষক বায়ু বশীভূত করে এঁরা মোক্ষ লাভের পরম সোপান অতিক্রম করতেন। তারপর তন্ত্রের কুলকন্ডলিনী তত্ত্ব অবলম্বনে নিজ দেহ মধ্যে শিরঃস্থিত সহস্রারে শিব শক্তির মিলন সম্ভূত দিব্যানুভূতি লাভ করতেন। তখন পাঞ্চ ভৌতিক জড়দেহ অপার্থিব দিব্য দেহে পরিণত হত। এঁরা মূলতঃ আত্মবাদী, ঈশ্বরবাদী ততটা নন। সাধন প্রকৃয়ার দ্বারা নিজের মোক্ষ লাভ– এই হল এঁদের সাধনা। শিব হলেন এঁদের আদিগুরু _তিনিই আদিনাথ। শিবের শিষ্য মীননাথ অর্থাৎ মৎস্যেন্দ্রনাথ, মৎস্যেন্দ্রনাথের শিষ্য গোরক্ষনাথ। এই গোরক্ষনাথের পবিত্র জীবন কাহিনী নিয়ে সারা ভারতেই অনেক গান- গল্প রচিত হয়েছে।
নাথ সম্প্রদায় মূলতঃ ছিলেন নিরীশ্বরবাদী। এঁরা মনে করতেন, নিজের আত্মার মুক্তি মোক্ষ নিজের সাধনার দ্বারাই সম্ভব। দেব দেবীর প্রতি এঁদের খুব একটা শ্রদ্ধা ছিল না। এঁরা আকার বিশিষ্ট ঈশ্বর চেতনায় উদাসীন বা বিমুখ ছিলেন বলে মুসলমান সাধকেরাও এই দলে যোগ দিতেন।
এই সম্প্রদায়ের সবারই একটাই গোত্র, তা হল শিব গোত্র। নাথরা বেশিরভাগ দেবনাথ উপাধি লেখেন, কেউ কেউ পন্ডিত উপাধিও লেখেন।
ইদানীং কালে এঁরা হিন্দু দেব দেবীর পূজা করে থাকেন। এঁদের ব্রাক্ষ্মণ পুরোহিত থাকে না। নিজেদের সম্প্রদায়ের কেউ কেউ পুরহীতের কাজ করে থাকেন।
অনেক দিন আগের কথা, বাংলায় তখন নাথ ধর্মের প্রচলন হয়েছে। নাথ ধর্মাবলম্বীরা ছিলেন শৈব প্রভাবিত বৌদ্ধ। তখন নেপালেও ছিল বৌদ্ধ ধর্ম। নাথ যোগী মৎস্যেন্দ্রনাথের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। নেপালে তখন পর পর সাত বৎসর খরা চলছিল। নেপালরাজ একদিন স্বপ্নে দেখলেন, যদি যোগীরাজ মৎস্যেন্দ্রনাথকে একবার নেপালে আনা যায় তাহলে এই খরা দূর হবে।
মৎস্যেন্দ্রনাথ তখন বৃদ্ধ। তবু যদি নেপালের কল্যাণ হয়, এই ভেবে নেপালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন, তিনি নেপাল রাজ্যের সীমানায় পৌছবার সংঙ্গে সংঙ্গে নেপালের রাজা তাঁকে পায়ে হেঁটে বা অন্য কোন যানবাহনে চড়ে যেতে দিলেন না। সীমান্তে সাজিয়ে রেখেছিলেন একটি সুবৃহৎ মানুষ টানা কাঠের রথ। তখন থেকে রথযাত্রার রথের নাম হল মৎস্যেন্দ্রনাথের রথ। মৎস্যেন্দ্রনাথ সেই রথে উঠলে রথের কাছিতে টান পড়তেই রথ গড় গড়িয়ে এগিয়ে চলল , সেকালের নেপালের রাজধানী ললিত পুর বা ললিত পাটনের দিকে। রথের চাকার ঘর্ঘর আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ভেঙে নামল বৃষ্টি। রাজা তাঁকে একটি সুনির্বাচিত সুরক্ষিত ঘেরা জায়গায় কিছুদিন রাখলেন। সেই সময়ের মধ্যেই রাজা তাঁর ফেরার জন্য একটি উত্তম মানের লোহার রথ তৈরি করিয়ে ফেললেন। মৎস্যেন্দ্রনাথ সেই লোহার রথে ফিরলেন। সেই থেকে শুরু হলো পূর্ব ভারতের রথযাত্রা।
“নেপাল রাজার দেখাদেখি সেকালের ঢাকা বিক্রমপুরে ও ধর্মরাজিকা বিহারেও অনুরুপ রথযাত্রার ব্যবস্থা করা হলো। তাঁরা তৈরি করলেন বাঁশের রথ। ধর্মরাজিকার বর্তমান নাম ধামরাই । ধামরাইও রথের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে উঠল। ধামরাইয়ের কিছু দূরে কুমিল্লাতে সেকালে বাংলার রাজারা রথের প্রবর্তন করেছিলেন। বাংলার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীরে ছিল ভোগরাজিকা বিহার । সেখানে অনুরূপ মৎস্যেন্দ্রনাথের রথের শোভাযাত্রা প্রবর্তিত হয়েছিল। কলিঙ্গের রাজারা পুরীধামে মৎস্যেন্দ্রনাথের রথের প্রবর্তন করেছিলেন। অনেকের মতে পুরীধামের এই মৎস্যেন্দ্রনাথের রথই পরবর্তী কালে জগন্নাথ দেবের রথে পরিবর্তিত হয়।” সূত্রঃ প্রভাত রঞ্জন সরকার -এর লেখা ‘বাঙলা ও বাঙালী ‘।
নেপালে সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল মৎস্যেন্দ্রনাথের তপোবলে। অনেকের ধারণা সেই তপোবলের জের হিসেবে আজও যে সব স্থানে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় সেই সব স্থানে ওইদিন বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।
…….সন্তোষ কুমার দে সরকার