“আশ্বিনের শারদ প্রাতে….” এক জলদগম্ভীর স্বরে হয়তো ব্যারিটোন গলায় নয়, কিন্তু বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের গলায় সেই আওয়াজ কানে আসা মাত্রই বাঙালির স্বপনে মননে যে উৎসবের জন্যে সারাবছর অপেক্ষা, তা শুরু হয়ে যায়। রাস্তার ধারে ধারে কাশের বনের ভিতর দিয়ে যে আকাশের দিকে তাকিয়ে যে শরতের পেঁজা তুলোর মতো মেঘের খেলা দেখতে দেখতে কখন যে অপু দুর্গার মতো আমাদের বয়েস ও বেড়ে গেলো তা টের ও পাই না। তাই দুর্গা পূজা বাঙালির চেতনায় এবং সংস্কৃতিতে এক অপরিসীম উৎকর্ষের সূচনা করে। কারণ মা আসছেন।
বাঙালির এই প্রাণের পূজা এই বঙ্গদেশে কবে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে নানা মতবিরোধ থাকলেও, মোটামুটি ভাবে বলা যায় রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ তাঁর পারিবারিক মন্দিরে প্রথম দুর্গা পূজার প্রচলন করেছিলেন। অশ্বিনের শারদ প্রাতে সেই প্রথম বাঙালির দুর্গাবন্দনার সূচনা।
কিন্তু সমস্যা ছিল প্রচুর। আজকের মতো সেই আমলে দুর্গাপূজায় এতো সার্বজনীন ছিল না। শ্রেণী বিভক্ত হিন্দু সমাজের দুর্গা পূজা আপামর জনসাধারণ থেকে অনেকটাই দূরে ছিল। অভিজাত জমিদার বাড়ি বা ব্রাহ্মণ বাড়ির পূজায়, সাধারণ মানুষের প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধই ছিল। উচ্চ বর্ণের প্রভাব সর্বত্র বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় ছিল। এখন যেরকম সব ধর্মের মানুষের কাছে দুর্গা পূজা এক উৎসবের মত হয়ে গিয়েছে। তখন তা ছিল শুধুই স্বপ্ন। নিজ ধর্মের নিম্ন বর্গের মানুষই যেখানে পূজায় স্থান পেতো না, সেখানে অন্যান্য ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল বাতুলতা মাত্র। কেবলমাত্র ধনী ব্যক্তিদের দ্বারাই পরিচালিত হত দুর্গাপূজা। কারণ তারাই ছিলেন সমাজের মাতব্বর। বাকি সকলে ছিলেন নেহাতই দর্শক মাত্র।
জমিদার দের হাতে এই দুর্গাপূজা ছিল একেবারেই তাঁদের পারিবারিক আভিজাত্যের মোড়কে বাঁধা। তাই জমিদারদের কাছে দুর্গা পূজা ছিল প্রতিবেশী জমিদার দের প্রতি ঈর্ষা জাগানোর প্রতিযোগিতা। টাকা পয়সা খরচের ক্ষেত্রে তাদের ঔদার্য ছিল চমকপ্রদ। দূর দুরন্ত থেকে বিখ্যাত কারিগর দের ডেকে এনে মাটির প্রতিমা তাঁরা তৈরি করাতেন। মণ্ডপ থেকে শুরু করে প্রতিমার গয়না পড়ানো থেকে সমস্ত কিছুতেই ছিল বিত্তের আরাধনা। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ প্রভুদের কাছে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর জায়গা হিসেবে দুর্গা পূজা ছিল আদর্শ। সেক্ষেত্রে অনেক বিত্তবান ব্যবসায়ীরাও এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না। সাহেব দের কে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে দামি উপহার থেকে শুরু করে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বাইজি নাচের আসর বসিয়ে দুর্গা পূজাকে কে এক সার্বিক ব্যবসায়ীক চেহারায় রূপান্তরিত করেন জমিদার এবং উচ্চ বিত্ত ব্যবসায়ী গণ। বঙ্গদেশে এই ভাবে দুর্গা পূজা এক প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়ে নেয়। যদিও বংশ পরম্পরা গত ভাবেই জমিদার এবং রাজারা দুর্গাপূজা চালাতে থাকেন। সেই ঐতিহ্য এখনো বহু বনেদি বাড়ি চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও।
কংসনারায়ণ যদিও বাংলায় প্রথম দূর্গা পূজার সূচনা করেছিলেন। তথাপি সেই পূজা জনপ্রিয় করেছিলেন নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। ১৭২৮ সালে তিনি সিংহাসন আরোহণ করার পর দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন।
পলাশীর যুদ্ধের পর থেকেই নব্য বাবুদের হাত ধরে দুর্গা পূজার সাহেবি আনন্দ শুরু হয়। রাজা নবকৃষ্ণ দেব নিজেই সোৎসাহে ইংরেজ সাহেবদের আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর পূজায়। তিনি তাঁর এক বন্ধুকে চিঠি লিখে জানালেন “লর্ড ক্লাইভ স্বয়ং তাঁর বাড়ির পূজায় প্রতিমা দর্শন করতে আসবেন। এছাড়া প্রচুর সাহেব আসবেন। সুতরাং তাঁরও আসা চাই।” এই সাহেবদের হাত ধরেই কিন্তু প্রথাগত দুর্গোৎসবের যে ঐতিহ্য ছিল তা ভেঙে একেবারে মদ বাইজি সহযোগে এক অন্য রকম দুর্গোৎসবের চেহারা দেখতে শুরু করলো বাঙালি। শারদীয়া দুর্গোৎসব হয়ে গেলো ” গ্র্যান্ড ফিস্ট অফ দি জেন্টুস” এ পরিণত হলো। বাঙালি জানে তার পরিণতি কি!
বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি আমরা লক্ষ করি তা হলো পরিবারসমন্বিতা বা সপরিবারে দুর্গা। কলকাতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবার ১৬১০ সালে এই সপরিবারে দুর্গার প্রচলন করেন। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত দুর্গাপূজা পালিত হয়।
স্বাধীনতার পর থেকেই জমিদার দের প্রভাব ক্রমশ কমতে থাকে। আর জমিদার প্রথা উচ্ছদের পর ধীরে ধীরে তারা বিলুপ্ত হয়ে যেতে থাকেন। পরে থাকে শুধু তাদের অতীতের কঙ্কাল। জলসাঘর সিনেমায় যা ভীষণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন ছবি বিশ্বাস আর সত্যজিৎ রায়।
পূজার ধরণ ক্রমশ পাল্টাতে থাকে। পূজা তখন গুটিকয়েক অভিজাত শ্রেণীর হাত থেকে বেরিয়ে প্রকৃত বারোয়ারী পূজায় পরিণত হতে থাকে। বিভিন্ন পাড়া বা ক্লাবের হাতে পূজার রাস চলে যেতে থাকে। এরফলে সমাজের সকলের হাতে পূজা উন্মুক্ত হয়ে যায়। প্রকৃত অর্থে সার্বজনীন দুর্গোৎসবে পরিণত হয়।অন্য ধর্মের মানুষ জনও এই পূজা উৎসবের আনন্দে নিজেদের কেও বিলিয়ে দিতে থাকেন। দুর্গা পূজা বাঙালির কাছে এক সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের ভুমিকা নিতে শুরু করে। “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার” এই আদর্শে দীক্ষিত হতে শুরু করে স্বাধীনতা উত্তর বাঙালি মননে।
দুর্গা পূজা বাঙালির একেবারেই নিজস্ব পূজা। বাঙালি চরিত্র চিত্রণে দুর্গা পূজার ভূমিকা অপরিসীম। তাই বর্তমানে গণেশ পূজার প্রাবল্যে মাঝে মাঝে একটু আশংকিত হতে হয়, শেষে আমাদের নিজের দুর্গা ও আর নিজের কাছে থাকবে কিনা! বর্তমানে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির সবই প্রায় হাতছাড়া হয়ে গেছে। শুধু রয়ে গেছে আমাদের দুর্গা। তাই ভীষণই ভয় হয়। উত্তর থেকে দক্ষিণ সমগ্র বাঙালির সামনে এক আনন্দ উৎসব মুখরিত সময়ের হাতছানি। যা সেই কংসনারায়ণের সময় থেকে চলে আসছে। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই অনুভবের সুবাতাস সঙ্গে নিয়ে মা দুর্গা আমাদের ধরাধামে উপস্থিত হবেন। এই আশা নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি আজো।
………………রুদ্র সান্যাল