মহাবীর মহারথী মহান  দাতা কর্ণ

মহাভারতে অন্যতম আকর্ষণীয় ও বর্ণময় চরিত্র হইলেন মহাবীর কর্ণ । পান্ডু পত্নী কুন্তী কুমারী থাকা কালীন কর্ণ জন্মগ্রহণ করেন । কুমারী কুন্তী দৈব প্রদত্ত একটি মন্ত্র প্রাপ্ত হন । সেই মন্ত্রের দ্বারা উনি বহু দেবতাকে আহ্বান করিতে পারিবেন । কুমারী কুন্তী ওই মন্ত্রের শক্তি পরীক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে একদিন নির্জনে নদী তীরে সূর্যদেবকে আহ্বান করিলেন । সূর্যদেব সেই আমন্ত্রণে কুমারী কুন্তীর কর্নে প্রবেশ করিলেন  ও কুন্তী গর্ভবতী হইলেন । তৎপরে কবচ কুণ্ডলসহ একটি সুদর্শন পুত্র ভূমিষ্ট  হইল । কর্ণ হইতে ভূমিষ্ট হইবার হেতু তার নাম হয় কর্ণ । কুন্তীর পুত্র হইবার কারণে কর্ণের আর এক নাম কৌন্তেয় ।  কুমারী থাকা কালীন সন্তান জন্ম হইবার কারণে লোকলজ্জার ভয়ে অপূর্ব কান্তি সেই পুত্র সন্তানকে একটি পাত্রে করিয়া সলিলে ভাসাইয়া দিলেন । নিঃসন্তান সারথি অধিরথ সেই সন্তানকে উদ্ধার করিয়া নিজ পত্নী রাধার হস্তে সমর্পণ করেন । সারথি অধিরথ ও রাধা সেই সন্তানকে আপন পুত্র স্নেহে প্রতিপালন করিয়াছিলেন । রাধার নিকট প্রতিপালন হইবার কারণে কর্ণের আর এক নাম রাধেয় । পরবর্তী কালে কুন্তী  পান্ডুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইলেন ।  পান্ডুর দুই পত্নীর নাম কুন্তী ও মাদ্রী । পান্ডু  শাপগ্রস্ত হইবার কারণে সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছিলেন। পান্ডু সন্তান অভিলাষ প্রকাশ  করেন কুন্তীর নিকট । তখন কুন্তী  পান্ডুর নিকট দৈব প্রাপ্ত মন্ত্রের কথা জ্ঞ্যাত করিলেন । পান্ডু সানন্দে সম্মতি প্রদান করিলেন  মন্ত্র প্রয়োগের । কুন্তী  সেই মন্ত্র প্রয়োগ করিয়া  প্রথমে ধর্মরাজ কে আহ্বান করিলেন । ধর্মরাজ সেই আহ্বানে সাড়া দিলে তিনি গর্ভবতী হইলেন এবং নির্দিষ্ট সময়ে সত্যাশ্রয়ী যুধিষ্ঠির জন্মগ্রহণন করিলেন। পুনরায় পান্ডুর ইচ্ছানুযায়ী কুন্তী পবনদেব কে আহ্বান করেন । পবনদেবের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন মহাবলী ভীমসেন । এইভাবে কুন্তী স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী দেবরাজ ইন্দ্রকে আহ্বান করেন । দেবরাজ ইন্দ্রের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন তৃতীয় পান্ডব অর্জুন ।ইহার পর কুন্তী স্নেহ বশত মাদ্রীকে এই মন্ত্র প্রদান করিলেন  । মাদ্রী একবারই দেব বৈদ্য অশ্বিনী কুমার দ্বয় কে আহ্বান জানান । দেব বৈদ্য অশ্বিনী কুমার দ্বয়ের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন নকুল ও সহদেব । এই পঞ্চ পুত্র পরবর্তী কালে পঞ্চ পাণ্ডব নামে খ্যাত হন । 
প্রত্যেকে জেষ্ঠ্য ভ্রাতা সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের অনুরক্ত হন  এবং যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের যথোপযুক্ত নির্দেশ দান করিতেন । মহারাজ বিচিত্র বির্যের দুই পুত্র । তদের নাম ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডু । সেই সময় বিচিত্রবির্জের ঔরসে রাজ পরিবারের এক দাসীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন মহামতি বিদুর । তিনি রাজপরিবারে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডুর সহিত প্রতিপালিত হন । ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ছিলেন । ক্রমে
যৌবনপ্রাপ্ত হইবার পরে ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হওয়া সত্বেও অযুত হস্তীর ন্যায় বলশালী ছিলেন । মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র গান্ধার রাজকন্যা গান্ধারী কে বিবাহ করিলেন ।  গান্ধারী যখন জানিতে পারিলেন  তার স্বামী জন্মান্ধ তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করিলেন  স্বামী যখন দর্শন করিতে অক্ষম তখন তিনি ও আজীবন তার দৃষ্টিকে বস্ত্র দ্বারা আবদ্ধ রাখিবেন । কালক্রমে ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে গান্ধারী  গর্ভবতী হইলেন। যথা সময়ে গান্ধারী শত পুত্র ও এক কন্যার জন্ম দিলেন । দূর্যোধন , দুঃশাসন , দুঃ শলা ইত্যাদি । ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর পুত্ররা কৌরব নামে পরিচিত হয় । কৌরব গণ  ও পঞ্চ  পাণ্ডব একসাথে প্রতিপালিত হইতে  থাকেন । পাণ্ডব ও  কৌরব রাজপুত্র গণ ক্রিয়া ও অস্ত্র শিক্ষার জন্যে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের নির্দেশে অস্ত্র গুরু দ্রোণাচার্যের নিকট অস্ত্র শিক্ষা এবং সমস্ত রকম সমর বিদ্যা শিক্ষা লাভ করেন । যে যার দক্ষতা অনুযায়ী পারদর্শী হইয়া ওঠেন । রাজপুত্র গণ যৌবন প্রাপ্ত হইলে যুবরাজ দূর্যোধন ও দুঃশাসনের মধ্যে দম্ভ ও অহংকারের প্রকাশ হইতে লাগিল । তারা পাণ্ডব ভ্রাতাদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করিতে লাগিলেন । সত্যাশ্রয়ী যুধিষ্ঠির কৌরব ভ্রাতাদের হিংসার মনোভাব বুঝিতে পারিলেও নিজ কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের সদা ধর্ম পথে চলিবার উপদেশ দিতেন এবং সংযমী হইবার নির্দেশ দিতেন । রাজপুত্র গণের মধ্যে দূর্যোধন ও ভীমসেন গদা যুদ্ধে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন ।  ।  তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন ধনুর বিদ্যায় সর্বাপেক্ষা কৃতবিদ্য হইয়া উঠিয়াছিলেন । সকল রাজপুত্রদের মধ্যে মহাবীর অর্জুন ই শিক্ষাগুরু দ্রোণাচার্যের প্রিয়  পাত্র রূপে পরিগণিত হইয়া ছিলেন ।অপরদিকে কর্ণ যৌবন প্রাপ্ত হইবার পরে অত্যন্ত তেজস্বী ও রূপবান হইলেন । ধনুর বিদ্যায় পারদর্শী হইবার জন্যে ভৃগুমুনী পুত্র মহাবীর পরশুরামের নিকট পরিচয় গোপন করিয়া ব্রাহ্মন কুমার রূপে ধনুর বিদ্যা শিক্ষালাভ করিবার উদ্দেশ্যে গমন করেন । এখানে উল্লেখ্য পরশুরাম প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে ব্রাহ্মণ সন্তান ভিন্ন অন্য কাহাকেও ধনুর বিদ্যা দান করিবেন না।  কর্ণ ধনুরবিদ্যা শিক্ষা লাভের উদর্গ আগ্রহে আপন পরিচয় গোপন করিয়া ব্রাহ্মণ সন্তান পরিচয় দিয়া  সকল শিক্ষা গুরুর নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন  এবং তিনি অন্যতম সর্বাধিক প্রিয় শিষ্য রূপে অভিহিত হইয়াছিলেন । এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে অস্ত্র গুরু দ্রোণাচার্য পরশুরামের শিষ্য ছিলেন । মহাবীর পরশুরামের নিকট শিক্ষা লাভের সময় অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে কর্ণ ধনুর বিদ্যায় সবিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করিয়াছিলেন । তিনি  গুরু পরশুরামের সর্বাপেক্ষা প্রিয় শিষ্য রূপে পরিগণিত হইয়াছিলেন । বীর কর্ণ আপন দক্ষতায় পরশুরামের সমস্ত বিদ্যা আয়ত্বাধিন করিয়াছিলেন । এক দিন গুরু পরশুরাম কর্ণকে  গভীর বন মধ্যে  অস্ত্র বিদ্যা শিক্ষা দান কালে ক্লান্ত হইয়া বিশ্রামের জন্য কর্ণকে উপবিষ্ট হইতে বলিলেন ।  কর্ণের বাহুতে মস্তক রাখিয়া নিদ্রাবিভূত হইলেন । এমন সময় এক বজ্র কীট কর্ণের বাম জানু তে দংশনকরিবার ফলে ক্ষত সৃষ্টি হইল ।  অত্যন্ত যন্ত্রণা সত্বেও গুরুর নিদ্রা ভঙ্গ হইতে পারে এই হেতু আপন সহ্য শক্তি দ্বারা সময় অতিবাহিত করিতে লাগিলেন । জানু তে রক্তস্রোত প্রবাহিত হইতে থাকে । সেই মুহূর্তে গুরু দেবের  নিদ্রা ভঙ্গ হয় । গুরু পরশুরাম কর্ণের সহ্য শক্তি অবলোকন করিয়া  বিস্মিত হইলেন  এবং অনুভব করিতে পারিলেন ব্রাহ্মণ  কুমারের পক্ষে এইরূপ সহ্য শক্তি সম্ভব নহে । তিনি কর্ণকে বলিলেন তুমি সত্য করিয়া আপন পরিচয় ব্যাক্ত করো । সেই  ক্ষণে কর্ণ আপন পরিচয় ব্যাক্ত করিতে বাধ্য হইলেন । তৎপরে পরশুরাম রুষ্ঠ হইয়া আপন প্রতিজ্ঞাহেতু কর্ণকে কহিলেন তুমি আমার  সর্বাপেক্ষা প্রিয় শিষ্য  , তৎসত্ত্বেও পরিচয় গোপন করিবার কারণে আমি তোমাকে অভিশাপ দিতেছি রণক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনের মুহূর্তে আমার নিকট হইতে শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্রহ্মাস্ত্র তোমার বিস্মরণ হইবে । তৎসত্ত্বেও অভিশাপ প্রাপ্ত কর্ণ দুঃখিত চিত্তে গুরু পরশুরাম কে প্রণাম করিয়া আশীর্বাদ গ্রহণ করেন ও দুঃখিত চিত্তে  পরশুরাম  প্রিয় শিষ্য কে আশীর্বাদ করিয়া বিদায় দান করেন । দুঃখিত চিত্তে কর্ণ গুরুর নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন । পরবর্তী কালে পাণ্ডব ও কৌরব ভ্রাতাদের মধ্যে ক্রমান্বয়ে বিরোধ বৃদ্ধি হইতে লাগিল । দূর্যোধন ও দুঃশাসনের দুষ্কর্মের হেতু ও পাণ্ডব ভ্রাতাদের প্রতি হিংসার ফলে বিরোধ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করিতে লাগিল। রাজা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের প্রতি অন্ধ স্নেহ ও প্রশ্রয় দানের ফলে দূর্যোধন,  দুঃশাসন প্রজাবর্গ ও গুরুজনদের প্রতি অশোভন আচরণ করিতে থাকেন ।
এই সময় কর্ণের পরাক্রম ও শৌর্যৈর কথা অবহিত হইয়া যুবরাজ দূর্যোধন কর্ণের সহিত সক্ষতা লাভের আগ্রহী হইলেন । কর্ণ ও চারিদিক হইতে সূত পুত্র নামে অভিহিত হইয়া অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হইবার কারণে যুবরাজ দূর্যোধনের সহিত মৈত্রী তে  বাধ্য হইলেন ।  বাল্যকাল হইতে দূর্যোধন দুঃশাসন ইত্যাদি কৌরব ভ্রাতা গণ পঞ্চ পাণ্ডব ভ্রাতা গণের নিকট হইতে যথেষ্ঠ সহৃদয় ব্যাবহার প্রাপ্ত হইয়াও পাণ্ডব ভ্রাতা দের প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রু মনে করিতেন । একদিন গুরু দ্রোণাচার্য কৌরব ও পাণ্ডব ভ্রাতা দের অস্ত্রসস্ত্র বিদ্যা প্রদর্শনের হেতু উন্মুক্ত প্রান্তরে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, পিতামহ  ভীষ্ম , ও মাতা গান্ধারী কুন্তী,  মাদ্রী ও পুর নারী গণের সম্মুখে প্রদর্শনীর আয়োজন করেন । কৌরব ও পাণ্ডব ভ্রাতা গণ নানাবিধ অস্ত্র কৌশল প্রদর্শন করিয়া উপস্থিত সর্বজন কে চমৎকৃত করিতেছিলেন । তন্মধ্যে কুমার অর্জুন  আপন গন্ডিব ধারণ করিয়া সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত ও অপূর্ব শরসন্ধান দ্বারা উপস্থিত সর্বজন কে হতবাক করিতেছিলেন । পিতামহ ভীষ্ম ও গুরু দ্রোণাচার্য সপ্রশংসায় অর্জুনকে নিরীক্ষণ করিতেছিলেন । তৎকালে গজোরাজের ন্যায় মহাবলী শৌর্য কান্তি কর্ণ অকুস্থলে উপস্থিত হইলেন এবং অর্জুনকে সন্মোধন করিয়া বলিলেন ” হে অর্জুন তুমি যেইরুপ শরসন্ধাণ  করিতেছিলে আমিও তদানুরূপ ও অধিকতর সুন্দর শরসন্ধান করিতে সক্ষম ‘। এই কথা শুনিয়া ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য ও  উপস্থিত ব্যক্তিগণ বিস্মিত হইলেন । অজ্ঞাত কূলোশীল কোন ব্যক্তির সহিত রাজ কুমার অর্জুন কোনরূপ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাইতে পারে না বলিয়া কর্ণকে নিবৃত করেন । যুবরাজ দূর্যোধন অর্জুনের শর চাতুর্যের প্রতি মনে মনে শঙ্কিত থাকিতেন । সেই কারণে যুবরাজ দূর্যোধন সেই ক্ষণে ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য কে সম্মোধন করিয়া বলিলেন এই মুহূর্তে মহাবীর কর্ণ কে অঙ্গরাজ্য দান করিয়া কর্ণ কে মিত্র রূপে স্বীকার করিলাম সুতরাং ভবিষ্যতে মহাবলি কর্ণ অঙ্গ রাজ্যের রাজা হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে সক্ষম হইবেন । কর্ণ মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন যে  তিনি চিরকাল  যুবরাজ দূর্যোধন এর সহযোগী থাকিয়া সদা সর্বদা তাহার পাশে  থাকিবেন ।অঙ্গ রাজ্য প্রাপ্ত হইয়া কর্ণ আপন রাজ্যের প্রজাগণের কল্যাণ ও মনোরঞ্জনের জন্য নানাবিধ ব্যাবস্থা গ্রহন করিয়া প্রজাদের অত্যন্ত প্রিয় রাজা রূপে গণ্য হইলেন । মহাবলি কর্ণ প্রত্যহ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্নানাদি সম্পর্ণ করিয়া সূর্য প্রণাম সমাপ্ত করিবার পরে উপস্থিত যে কোনো প্রার্থী যাহাই  প্রার্থনা করিতেন তিনি তাহাই দান করিতেন । এই রূপে তাহার দানের খ্যাতি সমস্ত রাজ্যে প্রচারিত হইল । ক্রমে প্রার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল । তিনিও সদা সর্বদা সর্ব প্রার্থীকে দান করিতেন । তিনি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন  যে স্নান সমাপনান্তে কোনো প্রার্থীকেই তিনি বিফল মনোরথ হইতে দিবেন না । মহাবীর কর্ণ সহৃদয় ও দাতা কর্ণ রূপে পরিগণিত হইলেন । একদা কর্ণের দান ক্ষমতা পরীক্ষা করিবার জন্যে ব্রাহ্মণ প্রার্থীর ছদ্মবেশে স্বয়ং নারায়ন কর্ণের স্নান ও সূর্য প্রণাম সমাপনান্তে উপস্থিত হইয়া বলিলেন আমি ক্ষুধার্ত , তুমি আমার ক্ষুধা নিবারণ করো । কর্ণ করজোড়ে ব্রাহ্মণ কে ফলমূল  তন্দুল  ঘৃত দুগ্ধ  গ্রহণ করিতে অনুরোধ,কিন্তু ব্রাহ্মণ জানাইলেন এই সকল আহার্যে তাহার রুচি নাই । তিনি কর্ণকে বিস্মিত করিয়া জানাইলেন তিনি নর মাংস ভক্ষণ করিতে আগ্রহী এবং ইহাতেই তাহার ক্ষুধা নিবারণ হইবে । কর্ণ অনুরোধ করেন অন্য কিছু আহার করিতে কারণ নর মাংস আয়োজন করা অসম্ভব । ইহাতে ব্রাহ্মণ কর্ণকে কহিলেন তুমি রাজ্যের রাজা সেহেতু তুমি তোমার রাজ্যের যে কোনো অবাধ্য প্রজাকে বধ করিয়া আমাকে ভক্ষণ করাও। কর্ণ কহিলেন আমি প্রজা পালক সেই হেতু আমার দ্বারা কোনো প্রজা বধ  করা অসম্ভব । রুষ্ট হইয়া ক্ষুধার্থ  ব্রাহ্মণ  চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে কর্ণ মিনতি পূর্বক তাহাকে ক্ষণকাল অপেক্ষা করিতে বলিলেন । অতঃপর তিনি অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া মহিষী কে সকল বৃত্তান্ত অবহিত করিলেন । যেহেতু পুত্র বৃষকেতু উভয়ের সন্তান সেহেতু রানীর সম্মতির প্রয়োজন । তিনি রাণীকে জানাইলেন ইহাতে তাহার প্রতিজ্ঞা রক্ষা হইবে । রাণী সম্মত হইলে উভয়ে দুঃখিত চিত্তে সেই কার্য সমাধা করিলেন । অতঃপর  ব্রাহ্মণ তৃপ্তি সহকারে ভক্ষণ করিলেন । বিমর্ষ চিত্তে কর্ণ ও তার মহিষী  ব্রাহ্মণ কে বিদায় দান করিতে প্রস্তুত হইলেন । সেই ক্ষণে ব্রাহ্মণ রূপ পরিত্যাগ করিয়া  নারায়ণ রূপে সাক্ষাৎ দান করিয়া বলিলেন ধন্য তুমি রাজা কর্ণ ও তোমার মহিষী । আমি তোমাকে পরীক্ষা করিবার  নিমিত্ত ক্ষুধার্থ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করিয়াছিলাম । তোমার বৃসকেতু পুনরায় সঞ্জীবিত হইবে । আজি হইতে যতদিন মনুষ্য কুল থাকিবে তুমি দাতা কর্ণ রূপে গণ্য হইবে । আমি স্বয়ং বিস্মিত ও চমৎকৃত হইয়াছি । বস্তুত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ পূর্বে সকল মহারথী ও মহাবীর গণ জ্ঞাত ছিলেন যে  ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য এর ন্যায় কর্ণ  ও ধনুর বিদ্যায় কুশলী ছিলেন।  এই হেতু স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র স্বীয় সন্তান অর্জুনের প্রাণ রক্ষার্থে একদা স্নাত ও সূর্য প্রণামন্তে কর্ণের সমীপে ব্রাহ্মণ এর ছদ্মবেশে  প্রার্থী রূপে উপস্থিত হইলেন ।  তিনি কর্ণের নিকট অনুরোধ করিলেন তাহার  সহজাত কবচ কুণ্ডল প্রদান করিতে । কর্ণ সেই ক্ষণে বিস্মিত হইলেন এই  কারণে যে  কবচ কূণ্ডল তাহার দেহের বাহুপাশের অভ্যন্তরে রহিয়াছে । কর্ণ সকল বিষয় উপলব্ধি করিতে পারিয়া ও ততক্ষনে একটি ধারালো ছুরিকাঘাতে আপন দেহ ছেদ করিয়া কবচ কুন্ডল নির্গত করিয়া ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণ কে  প্রদান করিলেন । সেই ক্ষণে দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণ এর ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া কর্ণকে দর্শন দিয়া  বিস্মিত হইয়া কর্ণকে মহাবীর ও মহা দানি রূপে অভিহিত করিলেন।  তিনি স্বীকার করিলেন স্বীয় সন্তান কে নিষ্কণ্টক করিবার হেতু ইহা গ্রহণ করিতে বাধ্য হইলেন । পরিবর্তে তিনি কর্ণকে এক একাঘ্নী শর প্রদান করিলেন । ইহা যাহার উদ্যেশ্যে নিক্ষিপ্ত হইবে সে অবশ্যই বধ হইবে । কর্ণ দেবরাজ ইন্দ্র প্রদত্ত সেই বাণ গ্রহণ করিলেন ও মনে মনে স্থির করিলেন  এই বাণ যুদ্ধ কালে অর্জুনকে ই প্রয়োগ করিবেন । পরবর্তী কালে কুরুক্ষেত্রের মহারণে শ্রী কৃষ্ণের কৌশলে এই একাঘ্নী বাণ ভীম পুত্র ঘটোতকচ এর  প্রতি নিক্ষিপ্ত হইলে  ঘটোতকচ বধ হইল । ইহাতে অর্জুন নিষ্কণ্টক হইলেন । কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে পাণ্ডব জননী কুন্তী শ্রী কৃষ্ণের উপদেশে কর্ণের শিবিরে প্রার্থী হইলেন । বিস্মিত কর্ণ কুন্তীর সহিত  যোগ্য মর্যাদায় সাক্ষাত করিলেন । সাক্ষাতে কুন্তী কর্ণের জন্ম বৃত্তান্ত ব্যাক্ত করিয়া অশ্রু সজল নেত্রে  কহিলেন যে কর্ণই তাহার জেষ্ঠ্ সন্তান । তিনি মিনতি পূর্বক কর্ণকে কৌরব পক্ষ ত্যাগ করিয়া পাণ্ডব পক্ষে জেষ্ঠ ভ্রাতার আসন গ্রহণ করিতে আহ্বান করিলেন । তিনি কর্ণকে অশ্রুসিক্ত নয়নে  তাহার নিকট ফিরিয়া আসিতে অনুরোধ করিলেন ।বিচলিত  ও  কিংকর্তব্যবিমূঢ়  কর্ণ প্রথমে প্রলুব্ধ হইলেও পরক্ষণেই স্বীয় কর্তব্য স্থিতপ্রজ্ঞ হইলেন এবং মাতা কুন্তী কে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন। ”  হে মাতা আপনি জন্মমূহর্তে আমাকে ত্যাগ করিয়াছেন । সেই মুহূর্তেই আমার ভাগ্য স্থির হইয়া গিয়াছে ,  দুর্ভাগা আমি । আমি আপন প্রতিজ্ঞাপাশে আবদ্ধ । মম হৃদয় প্রলুব্ধ হইলেও নিরুপায় আমি । আমি জ্ঞাত আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতারা ধার্মিক ও মহাবীর । পাণ্ডবরাই জয়ী হইবে । স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণ যাহাদের সহায় । ভাগ্য বিলম্বিত আমি অঙ্গ রাজ্য প্রদানের দ্বারা একমাত্র স্বীকৃতি পাইয়াছি মিত্র দুর্যোধনের নিকট হইতে । সেই হেতু আপনার সস্নেহ আহ্বান রক্ষা করিতে আমি অক্ষম । হে মাতা আমি বাক্য প্রদান করিতেছি জগৎ জানিবে আপনি পঞ্চ পান্ডবদের জননী , ভবিষ্যতে আপনি পঞ্চ পাণ্ডব জননী ই থাকিবেন । এই ঘোরতর রণ শেষে হয় অর্জুন নহিলে আমি জীবিত থাকিব । আপনি হৃষ্ট চিত্তে আপন শিবিরে গমন করুন । আপনি আমার  শত কোটি প্রণাম গ্রহণ করুন । ” বস্ততু কর্ণ পিতামহ ভীষ্মের ন্যায় আপন প্রতিজ্ঞা ও ত্যাগে অটল ও অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী । বীর ও দাতা কর্ণ  সর্বাপেক্ষা মহান চরিত্র রূপে পরিগণিত হন । বস্তুত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে সহজাত কবচ কূন্ডল থাকিলে ও হস্তে ধনুর বাণ থাকিলে অবশ্যই কর্ণ অবোধ্য । তিনি সর্বাপেক্ষা মহা বীর কিন্তু কার্যকালে ভাগ্য বিরম্বনায় অর্জুনের হস্তে বীরদশা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন । এক মহান বিয়গান্ত চরিত্রের অবশান হইয়াছিল ।