মল মাস কি ও কেন

মল মাস বলে একটা মাসের কথা আমরা সবাই জানি। আমরা এটাও জানি, মল মাসে হিন্দুদের কোন পূজা পার্বণ এবং কোনরূপ শুভ অনুষ্ঠান হয় না। তবে কেন হয় না সেকথা আমরা অনেকেই জানি না। এ ব্যাপারে আলোচনা করতে গেলে ক্যালেন্ডার নিয়ে আলোচনা করতে হয়। ভারতবর্ষে দুই ধরনের ক্যালেন্ডার প্রচলিত আছে। এর একটি হলো চান্দ্র গণনা সাপেক্ষে, যা মূলত উত্তর ভারতে প্রচলিত, আর একটি হল সৌর গণনা সাপেক্ষে, যা বাংলা ক্যালেন্ডার। বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন করেছিলেন সিংহপুরের (বর্তমান হুগলি জেলার সিঙ্গুরের) রাজা শালিবাহন । শালিবাহনের নির্দেশে দন্ড ভূক্তীর (বর্তমান মেদিনীপুর জেলার কাঁথির) জ্যোতির্বিদ জয়ন্ত পানিগ্রাহী মহাশয় সূর্য সিদ্ধান্ত সরণি অনুসারে বাংলা বর্ষ গণনা প্রবর্তন করেন। যা আজও  চলছে। এই বাংলা ক্যালেন্ডার অথার্ৎ সৌর গণনা অনুযায়ী ক্যালেন্ডার পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অসম, মনিপুর, ত্রিপুরা, ওড়িশা, ছোটনাগপুর, সাওতাল পরগণা, পুর্ণিয়া ও বাংলাদেশ এই বিরাট ভূখণ্ডের মানুষ মেনে চলে।
       এখন প্রশ্ন হল সংবৎ প্রথা অনুযায়ী ভারতবর্ষে একটি ক্যালেন্ডার প্রচলিত থাকা স্বত্ত্বেও সূর্য সরণি সাপেক্ষে আর একটি ক্যালেন্ডারের প্রয়োজন হলো কেন ?
       উত্তর ভারতে চান্দ্র গণনা সাপেক্ষে যে ক্যালেন্ডার তৈরি হয় তার পদ্ধতি হচ্ছে চাঁদ যে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে তা একবার ঘুরতে সময় নেয় কখনো আঠাশ দিন, কখনো ঊনত্রিশ দিন, কখনো বা ত্রিশ দিন। একবার চাঁদ ঘুরে গেলে সেটাকে বলা হয় চান্দ্র মাস। আর তাকে বারো দিয়ে গুণ করে বছরের হিসেব বেড় করা হয়। বছর হয় ৩৫৪/৫৫ দিনে। এটা হল ‘ চান্দ্র বর্ষ ‘ । উত্তর ভারতে এই রীতি প্রচলিত। এতে অসুবিধে কোথায়? অসুবিধা হচ্ছে লুনার ক্যালেন্ডারে বছর হয় ৩৫৪ দিনে। এক বছরে ১১ দিন এগিয়ে যায়। তিন বছরে এক মাসের চেয়েও বেশি এগিয়ে যায়। ফলে কোনো বছর অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান কাটা হয়তো তিন বছর পর সেটা কাটা হয় পৌষ বা মাঘ মাসে। শষ্য রোপণের ক্ষেত্রেও একই রকম হের- ফের হয়ে যায়। কোন বছর বর্ষা হয়ে যায় আষাঢ় মাসের আগেই আবার কোন বছর বর্ষা চলে যাবার পর আষাঢ় মাস হয়। এতে কৃষকদের অসুবিধা, সরকারেরও রাজস্ব সংগ্রহে অসুবিধা। তাই বাংলার মানুষ দেখল সূর্যের সাথে গণনা করলে ঋতুর সাথে হিসাব ঠিক থাকবে। তাই বাংলার মানুষ সূর্য সিদ্ধান্ত সরণী অনুসারে বাংলার বর্ষ গণনার প্রবর্তন করলেন।
            বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরির পদ্ধতি হচ্ছে ধরা হয় পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘুরছে। (যদিওবা সূর্য থেমে আছে পৃথিবী ঘুরছে। সঠিক ভাবে বলতে হলে বলা যায় সূর্যও তার গ্রহকে নিয়ে মহাকাশে ঘুরছে। মহাকাশে কোন গহ বা নক্ষত্র থেমে নেই।) পৃথিবীকে স্থির ভেবে সূর্যের ঘুরতে ৩৬৫/৬৬ দিন লাগে। এটাই হলো সৌর বৎসর। লুনার মতে প্রথমে মাস তাকে বারো দিয়ে গুণ করে বছরের হিসাব করা হয়, আর সোলার হিসেবের ক্ষেত্রে প্রথমে বছর তার পর বারো দিয়ে ভাগ করে মাস বের করা হয়।
   বাংলা ক্যালেন্ডারের যেমন ঋতুর সাথে হিসেবের মিল থাকে তেমনি ফসল রোপণ ও কর্তনের সময়ও ঠিক থাকে। তবে লুনার ক্যালেন্ডার রচিত হয় তিথির হিসেবে, তাই বাঙালিরা ঠিক করল পূজাপার্বন, শ্রাদ্ধ, বিবাহ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি শুভকার্য লুনার ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী করা হবে। শত-শত বছর যাবৎ এই নিয়মেই হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে সূর্যের হিসাব চলে না।
      আমি আগেই আলোচনা করেছি চাঁদের গণনা অনুযায়ী প্রতি তিন বছর অন্তর ওরা তের মাসে বছর করে নেয়। এই যে বাড়তি মাসটা_এবার আশ্বিন মাসটা ওদের বাড়তি মাস হয়েছে। এটা ওদের কাছে অধিক আশ্বিন মাস হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। কিন্তু বাংলা ক্যালেন্ডারের হিসেবে আশ্বিন মাস আশ্বিনই থেকে গেল। ওদের পাঁজিতে এই অধিক মাসে পূজা পার্বণ বা শুভ কার্য কিছু রাখা হয় না।, বাংলা ক্যালেন্ডারও ওঁদের সাথে অ্যাড্ জাস্টমেন্ট করতে গিয়ে প্রতি তিন বছর পর পর ওঁদের যে মাসটা ‘অধিক মাস’ হিসাবে খ্যাত হয় বাংলায় সেটাকে বলা হয় ‘মল মাস ‘ । এবারের আশ্বিন মাসটা উত্তর ভারতের মানুষের কাছে অধিক আশ্বিন মাস ,আর বাংলা ক্যালেন্ডারে মল মাস। তাই এবার ৩১শে ভাদ্র১৪২৭ সালে মহালয়া হলেও দুর্গা পূজা সময়মত হলো না। মহালয়ার সাত দিনের দিন সপ্তমী পূজা হবার হবার কথা, অর্থাৎ সাতই আশ্বিন। কিন্তু এবারের আশ্বিন মাস যেহেতু মল মাস তাই কার্তিক মাসের ৬ তারিখ দুর্গা পুজোর মহাসপ্তমীর দিন নির্দিষ্ট হয়েছে।
      মল মাস কি ও কেন এনিয়ে আমি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলাম।