বিয়েবাড়ি 

পড়ন্ত বিকেলে, সূর্য প্রায় নদীর বক্ষে ঢলে পড়েছে, আকাশ হলদে-লাল ছটায় ভরে গিয়েছে যেন কোনো এক পাড়াগাঁয়ের মেয়ের সবে মাত্র বিবাহ সম্পন্ন হয়ে  এই প্রথম কপাল থেকে নাকের ডগায় সিঁদুর গড়িয়ে পড়ল।  আর আকাশের সেই মেঘগুলো যেন কোনো এক  সদ্য স্নান সেরে আসা কিশোরীর ঘন কেশ। 

সেদিন ছিলো শ্রাবণ মাসের কোনো এক মঙ্গলবার, গ্রামের এক খানিক উন্নত পাড়ায় ভালোই সম্পদবান কোনো এক বাড়ির সবচেয়ে প্রিয় পুত্রের বিয়ে, বেশ জাঁক জমকভাবে সমস্ত কাজ সম্পাদন করা হচ্ছিলো, রান্নার ঠাকুর ছিলো উড়িষ্যার থেকে ভাড়া করা, নানারকমের মিষ্টির, সরবতের সমাহার ছিলো সেইখানে।  কোনো আয়োজনে কোনোপ্রকার খামতি ছিলো না। অতো বড়ো বিয়েবাড়ি তার ওপর আবার অত আয়োজন। শয় শয় মানুষের ভিড়,আত্মীয়স্বজনদের হই-হল্লা পুরো বাড়িকে বেষ্ঠন করে রেখেছিলো।  সময় বাইতে থাকলো ভিড় বাড়তে থাকলো।  তাড়াহুড়ো শুরু হয়ে গেল বিয়ে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে। 
হঠাৎই বাইরের বড়ো গেটের ভেতর দিয়ে একজনকে  প্রবেশ করতে দেখা গেল, দেখে মনে হচ্ছিল সে হয়ত অন্য কোনো প্রাণী।  দূরত্ব খানিকটা কমলো তখন সামনে থাকা লোকজন বুঝতে পারলো সে আসলে মানুষই।  কিন্তু তার শারীরিক গঠন এতটাই অদ্ভুত ছিলো যে তাকে দেখে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিলো।
সেই শিশুটি খুব দুর্বল ছিলো, হাতে প্রায় জোর ছিলো না বললেই চলে,সে এতটা পথ কিভাবে হেঁটে আসলো সেটা সত্যিই ভাবার বিষয়। বিয়ে বাড়ির কোনো এক সহৃদয় ব্যক্তি তাকে একটু জল দিয়ে বসতে বললো।  সেই লিকলিকে, হাড্ডির ওপর চামড়া বসনো শিশুটিকে চারিদিকের সব সুস্বাদু খাবারের গন্ধ আঁচড় কাটছিলো। অদৃশ্য ছিলো সেই আঁচড়ের দাগগুলো। শিশুটি সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে নির্লজ্জ হয়ে তীব্র আওয়াজে বলেই উঠলো
-“আমাকে একটু খাবার দাও,এসব গন্ধ আর সহ্য করতে পারছি না আমি”। 
এরই মধ্যে যার বিয়ে সে এসে হাজির হয়েছে,তার নাম নবীন। বাড়ির সবার আদরে সে বাঁদর হয়ে উঠেছে। বরাবরই সে বদমেজাজী স্বভাবের, স্বার্থপরও প্রচুর।  সে এত জটলা দেখে শিশুটির কাছে আসলো, শিশুটি এবার ক্লান্ত হয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
-” আমাকে একটু খাবার দাও নাহ্!”
শিশুটির কথাটা পুরোপুরি শেষ হতে না হতেই নবীন তার দিকে তেড়ে গিয়ে তার গায়ে হাত তুললো, আর প্রবল গালিগালাচ করলো, ভদ্রবাড়ির কোনো লক্ষনই তার মধ্যে দেখা গেল না, তাকে দেখে মনে হলো চওড়া ফুটপাতে বসবাসকারী লোকজন হঠাৎ খাবার পেলে যেমন মারামারি করে একে অপরের সাথে ঠিক সেইরকম মারামারিতে সে লিপ্ত হচ্ছে।  সে শিশুটিকে ধাক্কা মেরে বের করে দেবে এমন সময়ই বাড়ির কর্তা হাজির হলো, তিনি নবীনের এরূপ আচরণে অনেকটা ক্রুদ্ধ হয়ে বলেই ফেললেন

  • “আজ যদি  তোমাকেও আমি রাস্তার থেকে তুলে না এনে রেখে দিতাম ওখানে তোমারও এই অবস্থাই হতো”
    কথাটা শুনে বিয়েবাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে গেল,  এত বছর ধরে কষ্ট করে,নানা ফন্দী এঁটে রাখা কথাটা এক পলকে সকলের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল, যেন কথাটা আর বদ্ধ কুঠুরিতে থাকতে পারছিলো নাহ্!