বিহঙ্গ

রোজকার এই চাপা কষ্টটা আর নিতে পারছে না অনু। এক ছাদের নিচে থেকেও সায়নের সাথে দুরত্বটা  ক্রমশ বেড়েই চলেছে । ছোটখাটো বিষয় নিয়েও অশান্তি হয় আজকাল। অথচ অনু প্রাণপণে চেষ্টা  করে যাতে অশান্তিটা না হয়। বিয়েটা বাবা মায়ের পছন্দেই হয়েছিল,অনুর নয়। তবে অশান্তির কারণ সেটা নয়।  বরের উদাসীনতা ,অবহেলা,উপেক্ষা,দুর্ব্যবহার সব কিছু মাথা পেতে নিয়েই দিন কাটাচ্ছিল সে। সবাই বলত সন্তান এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এমন কি সায়নও খুব উৎসাহ দেখাল ছেলেটা যখন পেটে এল।দায়িত্তশীল স্বামীর ভুমিকা নিয়েছিলো তখন, হ্যাঁ ভূমিকাই বটে কারণ দায়িত্তশীলতার সীমাবদ্ধতা শুধু ওই টুকু সময়ের জন্যই ছিলো ।
তারপর আবার আগের মতই ছন্নছাড়া দাম্পত্য। আজকাল ব্যপারটা আরো জঘন্য হচ্ছে জেঠতুতো জা নীতার মদতে। কানাঘুষোয় শোনা যায় নীতার মেয়ে মিস্টুর বায়োলজিকাল বাবা সায়ন। সেটা যে সত্যি তা সায়নের হাবেভাবে প্রকাশও পেয়ে থাকে সবসময় তাছাড়া বিয়ের পর থেকেই সায়ন যে নীতাময় তা অনুও বুঝতে পেরেছিল । শুধুমাত্র পরিস্থিতি তাকে চালনা করে গেছে প্রতিনিয়ত। বাবা মায়ের সম্মানহানির ভয় তাকে বেরতে দেয়নি সম্পর্ক থেকে।অবশ্য বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে বয়সটাও কমই ছিলো, তাই ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছিল অনু সঙ্গে নিজেকে সাবলম্বী করারো চেষ্টায় ছিল। শুধুমাত্র মনের জোরে অবশেষে এল সেই সাফল্য ; অনুর কঠোর পরিশ্রম আজ সফল করে চাকরির জয়েনিং লেটার হাতে পেল এই মাত্র । সায়ন অফিসে আর বাকিরা দুপুরের ভাত্ঘুমে ব্যস্ত রোজকার  মতই , তাছাড়া এই বাড়িতে অনুর সাফল্য  বা ব্যর্থতায়  কারোর কিছুই  এসে যায় না; বাড়ির লোকের কাছে সে আদৌ মানুষের পর্যায়ে পরে কিনা সেটা ও ভাবার বিষয়। অতএব পায়ের তলার জমি শক্ত করার লড়াইয়ে একলা সৈনিক অনু তার পরিকল্পনার জাল সন্তর্পণে গতানুগতিক ধারায় চালু রাখল। 
    একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ঘুমন্ত ছেলেটার মুখের দিকে তাকাল তার পর চোখ বন্ধ করে সবটা সাজিয়ে নিল মনে মনে। না বাবা মাকেও জানবে না কিছু; লড়াইটা যে  তার একলার। সায়ন চেয়েছিল আলাদা থাকতে কিন্ত অনু চায়নি সায়নের ভরণপোষণে বাঁচতে। অনেকবার ডিভোর্সের  কথাও বলেছে সায়ন ; অনু এড়িয়ে গেছে । আজ সব সমাধানের দিন । একটা স্বস্তির শীতল বাতাস  মনটাকে তার জুড়িয়ে দিল একনিমেষে। না চাইতেও অদ্ভুত্ভবে দুচোখ জুড়ে ঘুমের আবেশ নেমে এল । দুর থেকে কেউ একটা ডাকছে অত্যন্ত  কর্কশ গলায়; হঠাৎ একটা নরম হাতের ছোঁয়ায়  ঘুম ভেঙে গেল অনুর। ছেলেটা উঠে গেছে,অবাক হয়ে  তাকিয়ে আছে অনুর দিকে হয়তো ভাবছে তার মাও তাহলে ঘুমায়! আসলে এটুকু বয়সে দুপুরে মাকে ঘুমাতে দেখেনি তো কোনোদিন। হয়তো মায়াও হচ্ছিল  কিংবা ভয়  পাচ্ছিল মায়ের  কিছু হল নাকি এই ভেবে তাই আলতো হাতে মাকে জড়িয়ে ধরেছিল। মা জেগে উঠতেই  যেন প্রাণ ফিরে পেল। অনু ছেলেকে কোলে নিয়েই রান্নাঘরে ছুটল বিকেলের জলখাবার বানাতে। শাশুড়িমা রান্নাঘরে আগেই ঢুকে গেছেন অণুকে দেখে থমথমে মুখে জিজ্ঞেস করলেন অনু এতক্ষন ঘুমিয়ে পড়েছিল নাকি? প্রায় সাথে সাথেই অণুকে কিছু না বলতে দিয়ে ঝড়েরবেগে নাতিকে নিয়ে বসার ঘরে চলে গেলেন। অনু জানে এর মানে আজ রাতের রান্নায় শাশুড়ি মার সাহায্যটুকু থেকে বঞ্চিত  হতে হবে। তাই বসার ঘরে জলখাবারটা পৌছে দিয়ে তাড়াতাড়ি রাতের রান্নার জোগাড়ে লেগে গেল অনু। আজ থেকেই গোছগাছ করতে হবে জয়েনিংএর কদিন আগেই এ বাড়ি ছাড়তে চায় সে। রাতে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে অনু দিয়াকে একটা ফোন  করলো পরশুই সে দিয়াদের ভাড়া  বাড়িতে উঠবে দিয়া যেন সব ব্যবস্থা করে রাখে। অনু প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে শুয়ে পড়ল । সায়ন অফিস থেকে ফিরে মিস্টুকে পড়ায় রোজ তাই এখনো  মিস্টুদের ঘরেই আছে ।  ঘুম আসছিল না  কিন্তু অপেক্ষাই বা করবে কার জন্য? আনমনে নিজের কথাই ভাবছিল ;সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে আজ সবাইকে নিয়ে কত মজা করত ; অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস নিস্তব্ধ ঘরটাতে শব্দের মূর্চ্ছনা  তুলল, দু ফোঁটা চোখের জল ও কি গড়াল  অনুর চোখে ! খরখরে আঙুলগুলো দিয়ে দ্রুত চোখদুটো মুছে নিয়ে ঘুমন্ত ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলো অনু; হয়তো মনে মনে ছেলেটাকে মানুষ করার প্রতিজ্ঞাও করলো নিজের ক্ষমতায় ,সুশিক্ষায় । আর সেইসব বাচ্চাদেরকেও সে সুশিক্ষার সাথে সুন্দর মানসিকতার মেলবন্ধনে  মানুষ করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করল মনে মনে যাদের সে পড়াতে যাচ্ছে ।
     অনুর ভাবনার মাঝেই আজ অপ্রত্যাশিতভাবে  সায়ন একটু তাড়তাড়ি ই ঘরে ফিরে এল । রাতের খাবারটা সায়ন শোবার ঘরেই খায় ; অনু  উঠে রোজকার মতই সায়নের খাবারটা টেবিলে সাজিয়ে আবার শুতে যাচ্ছিল হঠাৎ সায়ন জানতে চাইল আজ যে চিঠিটা  এসেছিল সেটা অনু তাকে দেয়নি কেন?
   নীতাময় সংসারে এটা কি আর সায়নের  অগোচরে থাকে? সর্বদাই যে অনুর উপর নজরদারি চলছে যেন চলন্ত বন্দিনী সে অথচ চিঠিটা নেওয়ার সময়ও বাইরে কেউই ছিল না। শাশুড়ির রাগের  কারণটাও যে এটাই বুঝতে পারল; চিঠিটা হয়ত সায়নের দেখাও হয়ে গেছে ; চিঠিটা যে খোয়া যায়নি এই অনেক।
     মুচকি হেসে অনু জানাল ওটা সায়নের নয় অনুর চিঠি আর পরশু ছেলেকে নিয়ে সে চলে যাচ্ছে। সায়নের উত্তরের অপেক্ষা  না করেই সরে এল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আনমনে খাবারটা শেষ করে সায়ন বলল স্কুলটা তো ঘন্টা দুয়েকের পথ তা বাড়ি থেকেই তো যাতায়াত করতে পারত অনু।
অনুও জানে চাইলেই সে এটা করতে পারত  কিন্তু না আর নয় রোজকার অপমান আর নয়; মুখে বলল আসলে টুবানটা অনেক ছোট  তাই ওকে নিয়ে রোজ এতটা পথ জার্নি করতে চাই না আর মার ও তো বয়স হয়েছে  তাই বাড়িতে রেখে যাওয়া ও সম্ভব নয়। সায়ন বিড়বিড় করে বলল; তা বলে টুবানের কি বাবার দরকার নেই…  সায়ন তো এটাই চেয়েছিল  তবুও বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল ।এটা  কি ছেলে টুবানের জন্য যাকে সারাদিনে একটা বার ও আদর করে কোলে নেয়না সে; নাকি অনুর জন্য যাকে সারাটা সময় দাবিয়ে রেখেছে জুতোর নিচে নিজের ইচ্ছেয় বা অন্যের প্ররোচনায় ! অনু কি ওর  অভ্যেস  হয়ে গেছে নাকি দাসী ভেবে রাখা মেয়েমানুষের মানুষ রূপের উত্থান তার পৌরষত্বএর আজন্ম লালিত অহঙ্কারকে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে? অণুকে জোর করে আটকে রাখার শক্তি হারিয়ে ফেলছে  কি সায়ন …
  অনুরও মন কেমন করছে তবে ভয়ে নয় আনন্দে। কাঁদতে চাইছে না সে তবুও দুচোখ বেয়ে জল ধারা  বয়ে চলেছে। এ কান্না তার ভালো  লাগছে; বুকের ভিতরের জমাট কষ্টগুলো যেন গলে গলে পড়ছে । সব বাধনে থেকেও মুক্ত সে আজ।