ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবে ভারতীয় অন্যান্য ভাষার সাহিত্যে যে নতুন ঘরানার সাহিত্য মূলত বিকাশ লাভ করেছিল তার মধ্যে উপন্যাসে ছিল প্রধানতম।বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের(১৮৩৮-৯৪) পর সম্পূর্ণ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল।ঐতিহাসিক উপন্যাসের আঙ্গিক থেকে বেরিয়ে বাংলা উপন্যাসের নতুন কায়াকে যিনি গঠন করেছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৬১-১৯৪১)। সামাজিক উপন্যাসের সূক্ষ্মতর ও ব্যাপকতর ব্যবস্থার প্রবর্তন করে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্য ও সমাজকে বা উপন্যাসের ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণ করেছিলেন।বাংলা উপন্যাসের বাস্তবতার যে গভীরতর পরিণতি দেখা গিয়েছিল তার প্রথম সূচক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।”রোমান্স ও ইতিহাস” এই দুটি বিষয়কে দূরে সরিয়ে বাস্তব জীবনের শক্ত জমির উপরে রবীন্দ্রনাথ নিজ স্বাতন্ত্র্যকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।উল্লেখ্য যে রবীন্দ্রনাথের পূর্বসূরী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য জীবনের শেষদিকে মানবচরিত্রের নানান দিক উন্মোচনে মনোযোগ দিয়েছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ “বিষবৃক্ষ”(১৮৭৩) “কৃষ্ণকান্তের উইল”(১৮৭৮) এর নাম বলা যায়।
বাংলা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ নিজ মৌলিকতার প্রতিষ্ঠা করলেও তার প্রথমদিকে রচনা গুলি যেমন “বউ ঠাকুরানীর হাট”(১৮৮৩) “রাজর্ষি'(১৮৮৭) বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাবমুক্ত ছিলনা। তাই উক্ত উপন্যাস দ্বয়ের আদর্শ ও গঠনে ঐতিহাসিকতার গন্ধ ছিল। কিন্তু সাধনা পর্বের পর (১২৯৮-১৩০২)রবীন্দ্রনাথের লেখনী আরো পরিণত হয়ে উঠেছিল। সমালোচকেরা বলেন সাধনায় নাকি হাত পাকিয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই আমরা তারপরের রচনা “চোখেরবালি”-তে(১৯০৩) সেই গভীরতার পরিচয় পাই।নবপর্যায় বঙ্গদর্শন(১৯০১) এর মোট সতেরোটি সংখ্যায় প্রকাশিত চোখের বালি উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।এই উপন্যাসের মহেন্দ্র, বিহারী ,বিনোদিনী ,আশালতা প্রত্যেকেই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে উজ্জল। প্রতিটি চরিত্রের একটি নিজস্ব Identity আছে; যা উপন্যাসের গতিশীলতাকে বজায় রেখেছে।যদিও বুদ্ধদেব বসু(১৯০৮-১৯৭৪) তাঁর “কবিতা পত্রিকায়” চোখের বালি নিয়ে যে সমালোচনা করেছিলেন তা রবীন্দ্রনাথ নিজেও মেনে নিয়েছিলেন। উপন্যাসের পরিণতি নিয়ে লেখক থেকে পাঠক কেউই তৃপ্তি পায়নি। যদিও রবীন্দ্রনাথ যেভাবে আঁতের কথাকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন তা অসাধারণ। পরবর্তী বিখ্যাত উপন্যাস “গোরা”(১৯১০) প্রবাসী পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত বৃহত্তর উপন্যাস। এখানে পাত্র-পাত্রীর ব্যক্তিগত Identity নেই। তারা বৃহত্তর সমাজ, বৃহত্তর আন্দোলনের প্রতিনিধি স্বরূপ।গোরা, বিনয় বা পরেশ বাবু প্রত্যেকের নিজস্ব মতবাদকে প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত থেকেছেন তাই মনে হয় এই উপন্যাসের লেখক লুপ্তপ্রায় হিন্দু ধর্মের প্রতি আবেগই দেখিয়েছেন। যদিও তিনি নতুন ধর্মের প্রতি ঝোঁক দেখিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি(১৯০৬) চতুরঙ্গ(১৯১৬) যোগাযোগ(১৯২৯) শেষের কবিতা(১৯৩০) ঘরে বাইরে(১৯১৬) দুই বোন(১৯৩৩) মালঞ্চ(১৯৩৪) চার অধ্যায়(১৯৩৪) উপন্যাসের মধ্যে আঙ্গিক ও চরিত্র নিয়ে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন অন্যদিকে পত্রপত্রিকার চাহিদা মেটাতে অতিরিক্ত লেখার ফলে উপরোক্ত কয়েকটি উপন্যাস রবীন্দ্রনাথ এর নিজস্ব মানের তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়ে।যদিও বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের গতিকে ত্বরান্বিত করে নতুন পথে উন্মুক্ত করেছিলেন।বিষয় নির্বাচন চরিত্র পরিকল্পনা বা অন্তর্নিহিত সমস্যার বিশেষত্ব নিজস্ব কবি প্রতিভা ও অসাধারণত্বের পরিচয় রবীন্দ্রনাথ বারে বারে দিয়েছেন।রবীন্দ্রনাথ তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী রচয়িতাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক নতুন ঘরানার সৃষ্টি করেছিলেন এবং সেই ঘরানার পরবর্তী বংশধর আজও সম্ভবত তৈরি হয়নি। তাই তার উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
অনেক আলোচক রবীন্দ্র উপন্যাসকে নানান স্তরে বা পর্যায়ে বিভক্ত করে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু Reader Response Theory বা পাঠক প্রতিক্রিয়া বাদ এর আলোকে বলা যায় যে রবীন্দ্র সাহিত্যের কোন অংশকে এভাবে বিভাজন করে আলোচনা করা ঠিক নয়।বলা ভাল সাহিত্য পাঠক হিসেবে গ্রন্থ পাঠ করতে বসলে ওইভাবে পর্যায় বা শ্রেণীবিভাগ করলে লেখক ও পাঠক উভয়কেই সীমাবদ্ধ করা হয়।
বাংলা উপন্যাসের শাখায় রবীন্দ্রনাথের বিশেষত্ব ও অবদান অনস্বীকার্য। আমরা এখানে সংক্ষেপে সূত্রাকারে তা দেখানোর চেষ্টা করব :
১। ভারতীয় সাহিত্যে বা বলা ভাল বাংলা সাহিত্যে মনোবিশ্লেষণ বাস্তব পদ্ধতির প্রবর্তন রবীন্দ্রনাথের প্রথম করেন।
২।রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের সব পাত্র-পাত্রী বাঙালি। জাতিতে নাহলেও সংস্কারে, সমাজে ও শিক্ষায়। ফলত পাত্র-পাত্রীদের জীবনকথার সাথে বাঙালি জীবনের মিল রয়েছে।
৩। রবীন্দ্র উপন্যাসে বাহ্য ঘটনার প্রাধান্য খুব বেশি বেশিরভাগ সময়েই তা যেন অন্ত বিক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং সাহিত্য পাঠক প্রথম উপলব্ধি করল চরিত্রের মনের গভীরতাকে।
৪। উপন্যাসের বাচনভঙ্গি এত অনায়াস ও সরল যে ঘটনার মধ্যে পাঠকের সহজ প্রবেশে বাধা তৈরি হয় না। যা বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে নতুন ছিল।
৫।রবীন্দ্র উপন্যাসে চরিত্রের মনের জটিলতাকে বা অনুভূতিকে পাঠককে কল্পনা করতে হয়না চরিত্র নিজেই নিজের সার্বিক পরিচয় দেয়। এ কারণে সাহিত্য পাঠকের কৌতূহলের নিবৃত্তি ও আকর্ষণের বৃদ্ধি হতে থাকে।
আলোচনা শেষে বলা যায় যে রবীন্দ্রনাথ বাংলা উপন্যাস কে নতুন রূপ দিয়েছিলেন এবং এই নতুন রূপ নির্মাণ পর্বে চরিত্র নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। আজও পাঠক রবীন্দ্র রচনা পড়ে নিজের সমাজের ঘটনাকে খুঁজে পায় কারণ তার সৃষ্টি চিরকালীন।