ফাঁদ

-গুড মর্নিং স্যার!

-ও তুমি এসেছ তিতাস? শরীর কেমন আছে তোমার?

-আগের থেকে বেটার। তবে উইকনেস পুরোপুরি কাটেনি এখনও।

-উফ, এই কোভিড যা খেল দেখাচ্ছে! জানিনা আর কত প্রাণ কেড়ে নেবে এই মানুষ খেকো ভাইরাস? যাই হোক, খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করছ তো?

-হ্যাঁ স্যার, করছি। আপনি তো জানেন স্যার আমার বাবা নেই। বাড়িতে শুধু মা আর ভাই। ওদের নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম। তবে আমাদের বাড়িওয়ালা কাকু-কাকিমা এই কঠিন সময়ে ভীষণ সাহায্য করেছেন। হোম আইসলেশানে থাকার সময় বাজার-হাট সব ওঁরাই করে দিতেন। ভাগ্যিস আমি ছাড়া আর সবার টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভই ছিল।

-ভাগ্য সত্যিই সহায় তোমাদের। নাহলে এই ছোঁয়াচে ভাইরাস, গোটা পরিবারকে কাবু করে ফেলে।

-ঠিকই বলেছেন স্যার। কত মানুষ যে কর্মহীন হল এই কয়েকমাসে!

-সে আর বলতে? মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই অতিমারি এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

-আবারও ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতে হয় স্যার। এই দুর্দিনেও আপনি আমার পাশে থেকেছেন। ল’ পাশ করেই ক’জন আর আপনার মতো নামী আইনজীবীর অ্যাসিস্ট্যান্ট হবার সুযোগ পায়?

-হুম, অনিরুদ্ধ অনেকদিন থেকেই আমার সঙ্গে কাজ করছে। ওই আমাকে বলেছিল তোমার কথা।

-অনিরুদ্ধদার সঙ্গে আমার জানাশোনা খুব বেশিদিনের নয়। মাস তিনেক আগে এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল। শুনেছিলাম উনি  কোনও এক নামকরা পাবলিক প্রসিকিউটারের আন্ডারে কাজ করছেন। আমি সদ্য এল এল বি শেষ করে কোন রাস্তায় পা বাড়াবো বুঝতে পারছিলাম না। সেই বন্ধুই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওঁর কাছে, যদি কোনও পথের হদিস পাওয়া যায়, এই ভেবে।

-তবে এখন ক’টা দিন খুব সাবধানে থাকতে হবে তোমায়।

-হ্যাঁ স্যার। কিন্তু ভাবছিলাম, আপনার হাতে এতো ইম্পরট্যান্ট একটা কেস, আর এই সময়েই আমার শরীরটা…

-আরে না না অসুখ হতেই পারে। অনিরুদ্ধ তো রয়েছে আমাকে সাহায্য করার জন্যে। আর কেসের হেয়ারিংও এখনও শুরু হয়নি। আমরা গত একমাস ধরে শুধু হোমওয়ার্ক করেছি কেসটা ঠিকঠাক প্রেজেন্ট করার জন্য, কোথাও কোনও ফাঁক যাতে না থাকে। মেঘনা কাপুর আর তার পেছনে থাকা বড়বড় মাথাগুলোকে একটাও সুযোগ দেওয়া যাবে না।

-প্রথমদিন কাগজে খবরটা পড়েই চমকে গিয়েছিলাম। উফ্! সাহস আছে বটে মেয়েটার। আর্যভট্ট যাদবের মতো ধুরন্ধর পুলিশ অফিসারকে এভাবে কব্জা করে নিল! আমি তো ভাবতেই পারছিনা!

-তোমার বয়স, অভিজ্ঞতা দুটোই এখনও অনেক কম, তাই বিশ্বাস করতে পারছ না। এর মধ্যে সাহসের কিছু নেই। পুরোটাই নিখুঁত গেম প্ল্যান।  বহুকাল ধরেই চলে আসছে এ জিনিস। শুধু মাত্র যুগ বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে এর নাম, কাজ হাসিল করার ধরণ।

-তাই নাকি? সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং! একটু খোলসা করে বলবেন স্যার?

-স্পাই হিসেবে মেয়েদের ব্যবহার করার চল সেই রাজা বাদশাদের সময় থেকেই চলে আসছে। একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখতে পাবে বিভিন্ন সময়ে রাজারা সুন্দরী রমণীদের পাঠাতেন শত্রু রাজার দরবারে উপহার হিসেবে। আবার কখনও ছদ্ম পরিচয়ে তারা থাকতো রাজার আশ্রিতা হয়ে, গোপনে পাচার করতো খবরাখবর। কখনও কখনও তারা শত্রু রাজাকে হত্যা করার দায়িত্বও তুলে নিত নিজের কাঁধে।

-মারাত্মক!

-একবার এক পত্রিকায় বিষকন্যা বিষয়ে একটা প্রতিবেদন পড়েছিলাম। সেখান থেকেই জেনেছি, গ্রীকবীর আলেকজান্ডারকে মারার জন্যেও নাকি এক ভারতীয় রাজা কলাবতী নামে রূপসী নারীকে পাঠিয়েছিলেন। সে ছিল অসামান্য সুন্দরী। যার সঙ্গে যে কোন শারীরিক সংসর্গই ডেকে আনতে পারত মৃত্যু। সেই মায়াবিনীর রূপে মাতোয়ারা আলেকজান্ডার সে যাত্রায় বেঁচে যান অ্যারিস্টটলের তৎপরতায়। কিন্তু এমন বহু নজির আছে যেখানে মহাপ্রতাপশালী রাজারা বিষকন্যাদের রূপের জোয়ারে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছেন।

-বিষকন্যা! মানে যাদের শরীরে বিষ থাকে?

-হ্যাঁ ঠিকই ধরেছ। সত্যি মিথ্যে জানিনা, তবে শোনা যায় খুব ছোটবেলা থেকে বেছে নেওয়া হত কিছু সুন্দরী মেয়েকে আর তাদের খাবারে নাকি মিশিয়ে দেওয়া হত একটু একটু করে বিষ। বিষকন্যাদের বিষসহনে অভ্যস্ত করার পদ্ধতির নাম মিথ্রিডেটিজম। গ্রীসের পণ্টাসের রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডেটস শত্রুদের পরাজিত করার জন্যে প্রথম এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এরা যে শুধু রূপবতী আর বিষগ্রহণে পারদর্শী ছিল তাই নয়, নাচ-গান, অস্ত্রচালনা সবেতেই এদের দক্ষতা ছিল অসামান্য। বিদ্যাবুদ্ধির ছটা চোখে পড়ত চেহারার মধ্যে।

-এই বিষকন্যাদের চেনার উপায় ছিল না কোনও?

-প্রাচীন ভারতের চিকিৎসক সুশ্রুত সম্ভবত বিষকন্যা চেনার কিছু লক্ষণের কথা বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেসব সাধারণ মানুষ অথবা কামোন্মত্ত রাজাদের চোখে অধরাই থেকে যেত। ফলে বিষকন্যারা হয়ে উঠত পেশাদার হত্যাকারী এবং মোহিনীবেশধারী গুপ্তচর। যাদের দিনের পর দিন ইচ্ছে মতো ব্যবহার করেছে কুশলী রাষ্ট্রনেতারা।

-হুম বুঝতে পারলাম স্যার। পৌরাণিক গল্পেও তো আমরা দেখেছি কীভাবে স্বর্গের অপ্সরাদের ব্যবহার করা হত ফাঁদ হিসেবে।

-একদম তাই। মেনকা, উর্বশী, রম্ভা, তিলত্তমাদের ব্যবহার করা হয়েছিল ঋষি-মুনি এবং অসুরদের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্যে। কখনও দেবতা, কখনও ক্ষমতালোভী মানুষ মোহরা বানিয়েছেন নারীকে। সেই ট্রেন্ড আজও চলছে। শত্রু রাষ্ট্রের গোপন সামরিক নথি হস্তগত করাই হোক বা সেনাবাহিনী, পুলিশের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ, সব কিছুতেই ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে নারীকে। তবে এখন আর বিষকন্যা নয়, কম্পিউটার সফটওয়্যার, টেকনলজিতে পারদর্শী হাইটেক স্পাই হিসেবে উঠে আসছে তারা। আমরা যাদের বলছি হানি ট্র্যাপ।

-বেশ কিছুদিন ধরে মিডিয়া সরগরম এই হানি ট্র্যাপদের নিয়ে। কয়েকটা দুঃসাহসিক কেসের কথা পড়েছি। একদম সিনেমার মতো।

-হুম, আমাদের আর্যভট্ট আর মেঘনা কপুরের কেসটাও কম সিনেম্যাটিক নয়। ইনস্পেক্টর যাদবের মতো সুপুরুষ অফিসারের সঙ্গে অনেক সুন্দরী মহিলাদেরই বন্ধুত্ব আছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাদের সঙ্গে নিয়মিত চ্যাটিং, ফ্লার্টিং সবই চলে। তেমনই একজন স্মার্ট, ঝকঝকে তরুণী মেঘনার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় আর্যভট্টের। নিয়মিত কথা চলাচলি করতে করতেই কবে যেন তাদের বন্ধুত্ব পরিণত হয় ঘনিষ্ঠতায়। ধীরে ধীরে একে অপরের ব্যক্তিগত, পেশাগত জীবনের খবরাখবরও জানতে থাকে। মেঘনা নিজেকে একজন সমাজসেবী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল। ফেসবুকে আপলোড করেছিল আগাগোড়া মিথ্যে দিয়ে সাজানো একটা ফেক প্রোফাইল। এমনকি মেঘনা নামটাও ভাঁড়ানো। তার রূপ ও লাস্যের মোহে আচ্ছন্ন আর্যভট্ট ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কিছু। নির্দ্বিধায় মেঘনার সঙ্গে শেয়ার করেছে তার দৈনন্দিন কাজকর্মের বৃত্তান্ত আর মেঘনাও কৌশলে জেনে নিয়েছে পুলিশের অনেক সিক্রেট মিশনের হালহদিস।

-মেঘনা তো কোনও এক আন্তর্জাতিক মাদকপাচার চক্রের হয়ে কাজ করত শুনেছি।

-শুধু মাদক নয়, এরা বেআইনি অস্ত্র কারবারের সঙ্গেও যুক্ত। যারা পশ্চিমবঙ্গকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে। আর্যভট্টর নেতৃত্বে ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশের একটা দল তাদের এই মৌচাকে ঢিল মেরেছিল। একের পর এক প্রজেক্ট ব্যর্থ হচ্ছিল এদের তৎপরতায়। ধরা পড়ছিল লাখ লাখ টাকার চোরা কারবার। ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছিল পুরো দলটা।

-ওহ্! তারপর?

-পুলিশের রিপোর্ট থেকে জেনেছি মেঘনা ছিল এই দলের একজন চাঁই। অন্য উপায় না দেখে সে নিজেই নেমে পড়ে আসরে। তার রূপের ফাঁদে ফেলে আর্যভট্টর কাছ থেকে জেনে নেয় পুলিশের গোপন পরিকল্পনার তথ্য।

-কিন্তু মেঘনা ধরা পড়ল কীভাবে?

-পুলিশের একের পর এক প্ল্যান ফেইল করতে থাকায় সন্দেহ দানা বাঁধছিল। গোপন পরিকল্পনার খবর কে বা কারা লিক করছে সেটা নিয়েই চিন্তিত ছিল আর্যভট্ট ও অন্যান্য অফিসাররা। কিছুদিন যাবৎ নজরদারি চালিয়ে পুলিশের গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয় খবর ফাঁস হচ্ছে আর্যভট্টর মাধ্যমেই। তার ফোন, ল্যাপটপ সব খুঁটিয়ে দেখে তারা জানতে পারে মেঘনার কথা। মেঘনা যদিও অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি। দিনের শেষে আমরা সকলেই তো মানুষ, আর কমবেশি সব মানুষেরই একটা মন আছে।

-মানে? মেঘনা নিজেই ধরা দিয়েছে পুলিশের হাতে?

-না, ঠিক তা নয়। তুমি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিষকন্যা’ গল্পটা যদি পড়ো তাহলে আমাদের এই মেঘনা কাপুরের সঙ্গে সেই গল্পের নায়িকা উল্কার মিল খুঁজে পাবে।

-কী রকম?

-উল্কা ছিল অসাধারণ রূপবতী এক বিষকন্যা। মগধের রাজা সেনজিৎকে হত্যা করে শিশুনাগবংশ ধবংস করার জন্য পাঠানো হয়েছিল তাকে। কিন্তু সেনজিতের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রেমে পড়ে যায় উল্কা। সেনজিৎকে হত্যা করার পরিবর্তে সে নিজেই নিজের প্রাণ দিয়ে দেয়। প্রেমের খেলা খেলতে খেলতে মেঘনাও ভালবেসে ফেলেছিল আর্যভট্টকে। সে রূপের ফাঁদে দুঁদে পুলিশ অফিসারকে ফাঁসিয়েছিল ঠিকই কিন্তু অপরদিকে প্রেমের ফাঁদে আটকা পড়েছিল নিজেও। পুলিশের পরিকল্পনা মাফিক আর্যভট্টর ডাকে তার সঙ্গে দেখা করতে আসে মেঘনা আর তখনই ধরা পড়ে যায় হাতেনাতে।

-বাপ রে! আমি তো ভেবেই শিউরে উঠছি।

-হুম, অভ্যেস করো। যে পেশায় এসেছ সেখানে অনেক নতুন নতুন ঘটনার ঘনঘটা দেখতে পাবে।

-তা যা বলেছেন স্যার! শুরুটাও নেহাত মন্দ হল না।

-তোমার কি আজকে কম্পিউটারে কাজ করতে অসুবিধে হবে তিতাস? কিছু জিনিস টাইপ করার ছিল।

-একটুও অসুবিধা হবে না স্যার। বলুন কী করতে হবে? আমি এখুনি করে দিচ্ছি।

-আপাতত মেঘনা কপুর কেসের কিছু রিপোর্ট তৈরি করেছি আমি আর অনিরুদ্ধ মিলে। এগুলো একটু কষ্ট করে টাইপ করে রাখো।

-ঠিক আছে স্যার। আপনি কোনও কাজ করতে বলবেন আর আমি সেটা করব না, এমনটাও কি হতে পারে? কষ্ট নয়, খুশি মনেই করব কাজটা।

-আচ্ছা, আমি এখন একটু বাইরে