বিম্বিসার বৈশালীর বিখ্যাত নগরনটী আম্রপালির উদাহরণে রাজগৃহে একজন চৌষট্টি কলার পারদর্শিনী সরকারি গণিকা নিযুক্ত করেছিলেন। মূলসর্বাস্তিবাদীদের বিনয় থেকে জানা যায়, আম্রপালি ছিলেন মহানাম নামক জনৈক ধনী বৈশালীবাসীর কন্যা। তিনি ছিলেন অসামান্যা রূপবতী ও গুনবতী। এই কারণে লিচ্ছবিসভা তাঁকে স্ত্রী রত্ন বলে ঘোষণা করে এবং সিদ্ধান্ত করে যে এরকম নারী কোন একজনের স্ত্রী হতে পারে না এবং এই কারণেই তাঁকে সাধারণী হতে হবে। আম্রপালি তাতে রাজি হন। তবে পাঁচটি সুবিধা লাভের শর্তে। মগধ রাজ বিম্বিসার ছিলেন আম্রপালির গুণগ্রাহী।
গৌতম বুদ্ধ বৈশালীতে পদার্পণ করলে আম্রপালি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ও তাঁর উপদেশাবলী শ্রবণ করেন। এরপর আম্রপালি নিজগৃহে ভোজনের জন্য সপারিষদ বুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানান। বুদ্ধ এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এর কিছু পরে লিচ্ছবি প্রধানগণ বুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানান। যাতে তাঁর আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেন তার জন্য আম্রপালিকে এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা প্রদানের প্রস্তাব জানানো হয়। প্রত্যুত্তরে আম্রপালি জানান সমগ্র বৈশালী রাজ্যের বিনিময়েও তিনি তাঁর আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করবেন না। আম্রপালির গৃহে বুদ্ধ ভোজন করেন। আম্রপালি বুদ্ধকে উপহার দেন ভিক্ষুদের ব্যবহারের জন্য তাঁর নামাঙ্কিত একটি উদ্যান।
L. Basham লিখিত wonder that was India নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদক অংশুপতি দাশগুপ্ত র ‘অতীতের উজ্জ্বল ভারত’- এ উল্লেখ আছে__প্রাচীন বৌদ্ধ কাহিনীতে প্রসিদ্ধ বৈশালী নগরের অম্বপালী (১) এই সুশিক্ষিতা গণিকাদের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ… তা থেকে প্রাচীন ভারতে শ্রেষ্ঠ ধরনের বারাঙ্গনাদের যে কতখানি মর্যাদা ছিল তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অম্বপালী ছিলেন বিপুল ধনের ও প্রচুর ধী-শক্তির অধিকারিনী। তাঁর খ্যাতি পরিব্যাপ্ত ছিল ভারতের কৃষ্টি সম্পন্ন অঞ্চল গুলিতে। যে নগরে তাঁর বাস ছিল সেখানকার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে তিনি পরিগণিত হতেন। রাজপুরুষদের সংগে তিনি মিশতেন তাঁদের সমান মর্যাদা নিয়ে। বুদ্ধ বৈশালী অতিক্রম করে যেতে যেতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন অম্বপালীর দ্বারা। নগর পিতারা চেয়েছিলেন বুদ্ধকে বৈশালীর পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা জানাতে। কিন্তু তাঁদের আহ্বানের চেয়ে অধিক আদরণীয় বিবেচনা করে অম্বপালীর এই আমন্ত্রণ বুদ্ধ গ্রহণ করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে অম্বপালী শেষে বৌদ্ধ ভিক্ষুনী হয়েছিলেন।
(১) অম্বপালী ও আম্রপালি দু’জন একই ব্যক্তি এবং দুটো উচ্চারণই ঠিক। আম্রপালি সংস্কৃত শব্দ এবং অম্বপালী পালি শব্দ। প্রাকৃত জনের অলস অসাড় জিহ্বার জড়তা জনিত কারণে উচ্চারণ বিকৃত হয়। ফলে তৎসম (সংস্কৃত) শব্দের কিঞ্চিৎ জাতিনাশ হয়েছে। যেমন সংস্কৃত মগধ উচ্চারণ প্রাকৃতে ‘হ’ -য়ে রূপান্তরিত হয়ে ‘মগধ ‘ হ’ল ‘মগহ’।ভাষার নাম ‘মাগধী’ হয়ে গেল ‘মাগহী।বুদ্ধদেব ও মহাবীর দু’জনেই ধর্মদেশনা দিয়েছেন পালি ভাষায়
।বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষার ব্যাপ্তিকাল খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ পর্যন্ত।তারপর জন্ম হয় পালি বা প্রাকৃত ভাষার।ভারতে ৭টি প্রাকৃত ভাষার উদ্ভব হয়।এরমধ্যে সৌরসেনী প্রাকৃত,মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত,মাগধী প্রাকৃত এবং অর্ধ মাগধী বা জৈন মাগধী প্রাকৃতের ব্যবহারিক গুরুত্ব বেশি।এক কালে মগধ ও পূর্ব ভারতে মাগধী প্রাকৃত ভাষা ব্যবহৃত হ’ত।যেমন বর্ধমানের প্রাচীন সংস্কৃত নাম ছিল ‘আস্তিকনগর’ পরে প্রাকৃতে নাম হয় ‘অথ্থিনগর’।বর্ধমান মহাবীর রাঢ় অঞ্চলে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে এসে এখানে আট বছর কাটিয়েছেন।তাঁর নাম অনুসারে অথ্থিনগরের নাম হয় ‘বর্ধমান ‘। অর্ধ মাগধী প্রাকৃত ভাষা পূর্ব ও পশ্চিম দুই ভাগে বিভক্ত।পূর্ব অর্ধ মাগধী প্রাকৃত ভাষার গর্ভ থেকে জন্ম হয় ১)মৈথিলী, ২ )অঙ্গিকা, ৩)বাংলা ,৪)অসমীয়া,৫) ওড়িয়া ও) ৬)কোশলী ।তাই আমরা রাজবংশী কামরূপী ভাষাতেও কিছু কিছু বিকৃত শব্দ রূপ পরিলক্ষিত হই যেমন_
শিষ্ট বাংলা কামরূপী
রাজ্য আইজ্য
রাক্ষস আইকখস
লাল নাল
রস অশ
ধর্ম ধমমো
‘র’ কে ‘ অ’ উচ্চারণ নিয়ে আমি বাল্যকাল থেকেই একটা প্রচলিত রসিকতা শুনে আসছি। তা হলো__ কোন এক যাত্রা পালার দৃশ্য।যুদ্ধে আহত এক রাজা মঞ্চে উঠলে রাণী তাঁকে দেখে বলছেনঃ আজা আজা তোমার কপালত্ ক্যানে অকতো? রাজা বলছেনঃ অকতো নোয়ায়, অকতো নোয়ায় আনী ওটা অঙ্ অঙ্ ।
আপনার জানেন ,বাঙালি জাতি আর্য বংশোদ্ভূত না। বাঙালি একটা সংকর জাতি। তাই আমর মুখেও কিছু কিছু শব্দের উচ্চারণ বিকৃত হয়।
আমি আমার ফেসবুক বন্ধুদের কাছে মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি, কারণ আমার পাদ টিকাটি কিঞ্চিৎ বড় হয়েছে ব’লে। আমি জানি আমার বন্ধুদের সিংহভাগই সাহিত্য চর্চা করেন। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস তাঁদের অজানা নয়, বরংচ অনেকেই আমার চেয়ে বেশি জানেন। আবার আমার এমন কিছু ফেসবুক বন্ধু আছেন যাঁরা জানেন না, তাঁদের উদ্দেশ্যেই এই টীকা।