পাপের ফল

আশ্বিন মাসের শেষ। দুর্গাপূজাও শেষ হয়ে গেছে সপ্তাহখানেক আগে। এ সময়টাতে যে এমন প্রবল ঝড়ের সাথে সাথে বজ্রপাতসহ অঝোর নয়নে বৃষ্টি হবে, তা নীরজের কল্পনাতীত ছিল। রাত সাড়ে এগারোটার সময় এক মুমুর্ষ পেশেন্টের প্রতিবেশীর ডাকে যখন ওর বাবা বললেন, “নীরজ, আজ তুমি এই পেশেন্টটার ট্রিটমেন্ট করে এসো।“
এই তো সবে মেডিক্যালের পড়াশোনা শেষ করেছে সে। এত তাড়াতাড়ি বাবা যে তাকে পেশেন্ট দেখতে যেতে বলবেন, এটা সে আশা করেনি। তাই খানিকটা অবাকই হয়েছিল সে। তবুও বাবার কথার উপর নীরজ না বলতে পারেনি।
সুবোধ তলাপাত্র এ চত্ত্বরের একমাত্র নাম করা হাতুড়ে ডাক্তার। বয়স ৬২। গ্রামের সবাই তাকে পাত্রবাবু বলেন, ভগবান মানেন। তারই একমাত্র ছেলে হল নীরজ। হাতুড়ে নাম ঘোচাতে তিনিই সখে ছেলেকে শহরে রেখে দেড় বছরের একটা ডাক্তারীর কোর্সটা করিয়েছিলেন। সেই কোর্স পূর্ণ করে সপ্তাহ দুয়েক হল নীরজ গ্রামে ফিরে এসেছে।
পাত্রবাবু যথেষ্ট অমায়িক লোক। ভিজিট নেন নামমাত্র। যেটুকু উপার্জন হয়, তাতেই দিব্যি নিজের সংসার চালিয়ে নেন। এই অতিমূল্যের বাজারে কিভাবে যে উনি সংসার চালান? উনিই জানেন।
গরীব মানুষ হলে সুবোধবাবু বিনামূল্যে চিকিৎসা করেন। বেশী বাড়াবাড়ি হলে নিজ খরচে রোগীকে শহরের বড় হসপিটালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করান। তবে তিনি একেবারে গৌরী সেন নন, রোগীকে শুধু ঔষধগুলো কিনে নিতে হয়।
প্রতিবেশীটির কাছ থেকে নীরজ জানতে পারল, “পেশেন্টের নাম সাতকড়ি। তার অবস্থা খুব সিরিয়াস। হালকা জ্বরসহ কলের জলের মতো পাতলা পায়খানা হচ্ছে। অসহ্য মাথার যন্ত্রণা। শরীর ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।“
নীরজ বুঝল, “খুব সম্ভবত কলেরা। “
এই লালমাটি ভরা পাঁচমুখী অঞ্চলে নলকূপের সুবিধে না থাকায়, গ্রামের সবাইকে কূপ বা পুকুরের জল খেতে হয়। তাই এই গ্রামাঞ্চলে কলেরার প্রকোপ খুব বেশী।
যাতায়াত ব্যবস্থাও ভীষণ খারাপ। অ্যাম্বুলেন্স এখানে স্বপ্ন, ভ্যান-রিকশই ভরসা। ব্লক স্বাথ্যকেন্দ্রও বহুদূরে। তা প্রায় পঁচিশ-তিরিশ কিলোমিটার দূর।
নীরজ, বাবার মেডিক্যাল কিটের ব্যাগটার চেনটা খুলে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। নাহ, স্যালাইন, সিরিঞ্জ, নিডল, ডক্সিসাইক্লিন, প্যারাসিটামল সবকিছু ঠিকঠাক আছে। ব্যাগে যা ঔষধপত্র আছে তাতে এ যাত্রায় রোগী বেঁচে যাবে বলে মনে হয়।
ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নীরজ, যখন বাবার আদ্যিকালের ভাঙাচোরা পুরোন মোপেডটা নিয়ে বেরোচ্ছিল। তখন কিন্তু আকাশের মুখ এতটা গোমড়া ছিল না। বেশ ফুটফুটে, পরিষ্কার, ঝকঝকে-তকতকে ছিল। আকাশে তারাও ফুটেছিল অনেকগুলো। প্রতিবেশীটিকে পিছনে চাপিয়ে মোপেড চালানোর সময় তাড়াহুড়োতে আকাশের অবস্থা সে আর অতটা লক্ষ্য করেননি। অনেক কষ্টে এঁকেবেঁকে প্রায় সাত কিলোমিটার মোরাম বিছানো এঁটেল মাটির কাঁচা পথে মোপেড ঠেঙিয়ে মিনিট কুড়ি পর সাতকড়ির বাড়ীতে পৌঁছে তড়িঘড়ি মোপেডটা বিচালী ছাওয়া কুটিরের সামনে একটুখানি ফাঁকা জায়গাটায় স্ট্যান্ড করে মেডিক্যাল কিটের ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে হাতে ঝুলিয়ে দ্রুত সাতকড়ির ঘরে ঢুকে গিয়েছিল।
প্রথমে সে সাতকড়ির বামহতের নাড়িটা ধরল। দেখল, পালসের হার নামমাত্র। তারপর কানে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে সে সাতকড়ির হার্ট-বিট মাপল। প্রেশার মেপে বুঝল, প্রেশারও নেমে গেছে অনেকটা। সাতকড়ির চোখ ও জিভ ফ্যাকাসে সাদা হয়ে গেছে।
সাতকড়ি সারাদিন কিছু খায়নি মনে হচ্ছে, তাই সে সময় নষ্ট না করে দ্রুত স্যালাইন চালু করে দিল, তারপর ডক্সিসাইক্লিনের একটি বড়মাত্রার ডোজ রোগীর শরীরে ইনজেক্ট করে দিয়ে একটা কাঠের চেয়ারে বসে ফলাফলের জন্য একটু অপেক্ষা করতে লাগলেন।
প্রায় একঘন্টা পর সাতকড়ির অবস্থা খানিকটা স্থিতিশীল হল, তখনই সে ঘরের ভেতর থেকে দমকা বাতাস আর আকাশে মেঘের গর্জনের শব্দ শুনতে পেয়েছিল।
নাহ, আর দেরী করা ঠিক হবে না। অনেকটা পথ ফিরতে হবে। তাই তড়িঘড়ি সে ব্যাগ থেকে কয়েকটা ঔষধ বের করে, সাতকড়ির স্ত্রীকে ঔষধপত্র কিভাবে, কখন খেতে হবে? তা বুঝিয়ে দিয়ে ঔষধের টাকা-পয়সা হিসেব মতো বুঝে নিয়ে বাড়ীর পথ ধরেছিলেন।
জনবসতি কম হওয়ায় পাঁচমুখীর এ রাস্তাটা ভীষণ নির্জন, অরণ্যঘন। ভাল্লুকেরও উপদ্রব আছে। রাস্তার পাশে সার সার আকাশমণি, শিরীষ, ইউক্যালিপটাশ দাঁড়িয়ে। তাদের মাঝে দু-একটা বেমানান বট বা অশ্বত্থ গাছ।
তার জীবনের প্রথম পেশেন্ট সাতকড়ি। আবার তার চিকিৎসায় সাতকড়ির অবস্থা বেশ ভালো। তাই নীরজের মনটাও বেশ খুশি খুশি লাগছিল। কিন্তু কোথা থেকে অসময়ের কালো মেঘ এসে সব আনন্দ মাটি করে দিল।
ঝোড়ো দমকা বাতাস আর বজ্রপাত তো আগে থেকেই হচ্ছিল। সাতকড়ির বাড়ী থেকে মিনিট পাঁচেক পথ আসবার পর হুড়মুড়িয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাত নামল। কোথাও যে আশ্রয় নেবে তেমন কোন জায়গা নীরজ দেখতে পেল না। চিটচিটে মোরাম, কাদামাটি লেপ্টে তার মোপেডের চাকা প্রায় অসার, তাই বৃষ্টির মধ্যেই ভিজে ভিজে কোনোমতে ধীরে ধীরে মোপেডটা চালিয়ে নিজের বাড়ী ফিরছিল। হঠাৎ বৃষ্টির জলে ঝাপসা হয়ে যাওয়া মৃদু বাইকের আলোতে রাস্তার পাশে একটা কুঁড়েঘর দেখতে পেল। নীরজের মনে একটা আশ্রয় লাভের আশার আলোর সঞ্চার হল।
বাড়ীটির দালানে দাঁড়িয়ে একজন অল্প বয়স্ক যুবতী মেয়ে তাকে হাঁক দিয়ে বলল, “ছোট ডাক্তারবাবু, বৃষ্টিতে ভিজবেন না। শরীর খারাপ করবে। এখানে একটু দাঁড়িয়ে যান।
নীরজ ভাবল, এত রাতে মেয়েটি যেন তার প্রতীক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। এখানে তো আগে কোনো ঘর ছিল না। অবশ্য সে দেড়বছর এই গ্রামে ছিলনা, তার মধ্যে কেউ এখানে বাড়ী বানিয়ে থাকতেই পারে। সাতকড়ির বাড়ীতে যাওয়ার সময় তাড়াহুড়োতে অতটা লক্ষ্য করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
অতশত না ভেবে সময় নষ্ট না করে সে রাস্তার পাশে বাইকটা ঠেকিয়ে, কুঁড়েঘরের দালানে উঠে দাঁড়াল।
ভেতর থেকে তৎক্ষণাৎ একজন বৃদ্ধের খুকখুক কাশির শব্দ শোনা গেল। নীরজ বুঝল, এ বাড়ীতে একজন বৃদ্ধও আছেন। আর কে কে আছে কে জানে?
কাঁপা কাঁপা গলায় ভেতর থেকে বৃদ্ধটি বললেন, “দালানে না ভিজে, ছোট ডাক্তারবাবুকে ভেতরে নিয়ে আয় সন্ধ্যা।“
বাইরে বজ্রপাতসহ প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল, তাই সে বজ্রপাতে আলোর ঝলকানিতেই সন্ধ্যার পিছনে পিছনে ঘরের ভিতরে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে দাঁড়াল। তারপর বলল, “যাক বাবা, বাঁচা গেল। যা অঝোর বৃষ্টি হচ্ছে। ভালোয় ভালোয় বাড়ী ফিরতে পারলে বাঁচি।“
নীরজ খানিকটা উপযাচক হয়ে বলল, “আপনাদের ঘরে বাতি জ্বলছে না কেন?”
বৃদ্ধ মানুষটি বললেন, “বাবু, গরীব মানুষ আমরা। খাবার কেনবারই পয়সা পাই না। কেরোসিন কিনব কোথা থেকে?”
সন্ধ্যা বলল, “আমাদের বাড়ীতে বসতে দেওয়ার জায়গা নেই। সারা ঘর তো জল থইথই করছে। তাই আপনাকে কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটাতে হবে।“
নীরজ খানিকটা লজ্জিতভাবে বলল, “না, না, ঠিক আছে। বৃষ্টির হাত থেকে বেঁচেছি এটাই ঢের। আপনাদের এই উপকার আমি জীবনেও ভুলবো না।“
সন্ধ্যা বলল, “আপনি খুব ভালো মানুষ হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে আপনার বাবার মতো কখনো গিরগিটি হয়ে যাবেন না’তো?”
নীরজ খানিকটা অবাক হয়ে বলল, “আমার বাবা গিরগিটি হতে যাবে কেন? তিনি তো আদ্যপ্রান্ত ভালো মানুষ। গ্রামের সবাই তাকে কতো সম্মান করেন।”
বৃদ্ধটি বলল, “না, বাবা, তুমি কিছুই জানো না।“
নীরজ বলল, “বাবা চিকিৎসার জন্য গরীব মানুষজনদের কাছ থেকে কোনো টাকা ভিজিট নেন না। উল্টে রোগ বাড়লে তার চিকিৎসার জন্য নিজ খরচে তিনি রোগীকে শহরের বড় হসপিটালে ভর্তি করেন।“
সন্ধ্যা খিলখিল করে অদ্ভূত হেসে বলল, “তাদের কতজন বেঁচে বাড়ী ফিরে এসেছে, তা তুমি জানো কি?”
নীরজ মৃদু হেসে বলল, “আমি ওসব জেনে কি করব? আপনারা যদি জানেন তো বলুন, কতজন ফিরে এসেছে?”
ঠিক তখনই বজ্রপাতে ঘরের ভেতরে আসা মৃদু আলোতে নীরজ দেখল, সন্ধ্যা একটা বিভৎস মূর্তি ধারণ করেছে। তার দেহের কোথাও আর এতটুকুও মাংস নেই। নিমেষে তার শরীরটা একটা খটখটে হাড়গোড়যুক্ত নরকঙ্কালে পরিণত হল। সে বিভৎস স্বরে বলল, “একজনও ফিরে আসে নি।“
তা দেখে নীরজ ভয়ে হতভম্ব, নির্বাক হয়ে বৃদ্ধটির দিকে তাকাল। বৃদ্ধটিও তখন নরকঙ্কালে পরিণত হয়েছে। তার চোখ দু’টো ইঁটভাটার মতো জ্বলছে। সে ক্রর দৃষ্টিতে নীরজের দিকে তাকিয়ে বলল, “সত্যি, একজনও বাড়ী ফেরেনি।“
আচমকা নীরজ দেখল, সে যে বাড়ীটার ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিল সেটা এখন আর নেই। তার মাথার উপর এখন উন্মুক্ত আকাশ। বৃষ্টির অঝোর ধারা আবার তার শরীর ভিজিয়ে দিতে থাকল। বিদ্যুতের ঝলকানিতে সে লক্ষ্য করল, তার আশেপাশে আরও অনেকগুলো কঙ্কাল সদ্য গজিয়ে উঠেছে। তারা ধীর পায়ে উন্মত্তের মতো দু’হাত তুলে নীরজের দিকে অগ্রসর হতে লাগল।
নীরজ ‘না’, বলে একটা আর্ত-চিৎকার করে কাদামাটির উপর অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল।
পরের দিন সকালে নীরজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুবলে নেওয়া লাশটা রাস্তার পাশে পাওয়া গেল। পুলিশ পোস্টমর্টেম করে জানাল, এটা ভাল্লুক-টাল্লুকের মতো কোনো বিভৎস জানোয়ারের কাজ হবে।
সুবোধবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সজল নয়নে মনে মনে বললেন, “সবই আমার পাপের ফল।“