নুন (প্রথম পর্ব)

বলুন দেখি, ভারত ভাগ কবে প্রথম হয়েছিল ?
জানি, আপনি হৈ হৈ করে বলে উঠবেন – ১৯৪৭ এ!
উঁহু!
যদি বলি ১৮২৩, খুব অবাক হবেন, না ?
দুদিকের ডানা কাটা নয়,
পাকিস্তান বাংলাদেশ ছেঁটে ফেলা নয়,
আজকের ভারতের বুক চিরে দেওয়া হয়েছিল কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ।
উত্তর থেকে দক্ষিণ!
যাতে এদিক থেকে ওদিক একটা জিনিস না যেতে পারে
কি সেই জিনিস ?
নুন, হ্যাঁ আমাদের জীবনের অন্যতম অপরিহার্য উপাদান, লবণ!

আজকে যে লবণ আপনি পাড়ার মুদি দোকান থেকে আনেন সে লবণের প্রতিটি গুঁড়োয় মিশে আছে রোমহর্ষক ইতিহাস। চীনের প্রাচীর থেকে শুরু করে ফ্রেঞ্চ রেভোলুশন। গুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে ব্রিটিশ কলোনিয়ালিজম – কালো ইতিহাস নির্লজ্জ ভাবে লবণাক্ত।

এই দুঃসাহসী নুন আমাদের রান্না ঘরে ঢুকেও যে কি তান্ডব বাঁধাচ্ছে দেখবো তাও। হলফ করে বলতে পারি নার্সারি থেকে ক্লাস ১২ – এই ইতিহাসের একটা লাইনও আমাদের পড়তে দেওয়া হয়নি।

গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহ খানিকটা ঠেলে ঠুলে ইতিহাস বইয়ে ঢুকলেও তা নিতান্তই ‘সামান্য’!

– বাবু একটু সইরে বসবে গো ?
বাসের ঢুলুনিতে চোখ লেগে এসেছিলো।
কুন্ঠিত হয়ে ব্যাগটা কোলে টেনে নিলাম।
মেঝেতে বসা দেহাতি মানুষটার কাঁধে চেপে বসেছে আমার ঘুমন্ত হাতে ধরা ভারী ব্যাগটা।

– আহা, লাগেনি তো ?
– না বাবু , কুথায় যাবি তোমরা ?

বাস ভর্তি প্রাণী, ছাগল মুরগি,মানুষ কম।
বেশিরভাগই বাসের মেঝেতে।
চারপেয়েদের মালিকরাও মেঝেতে।

– যাব নাসি গ্রাম।

– ওহ, বাবুরা কি মেলা দেখতে এয়েছেন ?
– শুধু মেলা নয়, সাথে গ্রাম দেখতেও এলাম।

আমি শুধাই, আপনার বাড়ি কি নাসি গ্রামে?

– না না বাবু, এই  সব অবলাদের নিয়ে যাচ্ছি মহাজনের কাছে!
গেলো বর্ষায় মহাজনের নুন খেয়েছি, সেসব ফেরত দিতে হবে নি ?
নুন ?

কথা এগোলো না কন্ডাক্টর বললো নাসি গ্রাম উঠে আসুন।

নাসি গ্রাম যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য ঢলে গেছে,
খানিকটা হেঁটে অভিজিতের গ্রামের বাড়ী।
পেটে  ছুঁচোয় ডনবৈঠক দিচ্ছে,

আজকে খাবার আর পেটের ব্যাটে বলে আর হচ্ছে না। সকাল থেকে ফ্লপ চলছে।

তখন মেডিকেল কলেজ পড়ি। হোস্টেলে থাকি। ডিসেম্বরের ঠান্ডা। অনেক প্ল্যান প্রোগ্রাম করে ঘুরতে যাবো ঠিক হলো।

নাসি গ্রাম, অভিজিতের গ্রামের বাড়ি। প্রচুর শিব মন্দির আর মজা নাকি আনলিমিটেড!

আমরা চার মূর্তি বেরিয়ে পড়লাম।

তখন হাওড়া ট্রেন লাইনে হকারদের  কি যেন একটা বিক্ষোভ চলেছে।
কলেজ স্ট্রিট থেকে হাওড়া এসে চটপট ট্রেনে উঠে ভাবলাম এবার জমিয়ে ঝালমুড়ি খাবো।

কোথায় কি! কোনো হকারও নেই , ট্রেনও  বেশ লেট করলো।
বর্ধমানে নেমে পেট  চুঁইচুঁই!

৯০ দশকের মধ্য-ভাগ,
পকেটের জোর বেশ কম,
মাসে ৭০০ টাকা বরাদ্দ , বই কেনার থাকলে ১০০০।

স্টেশনের পাশে ফাঁকা হোটেল দেখে ঢুকলাম।
– চিকেন ভাত দাও ভাই!
সে চিকেনের কি গন্ধ আর কি চেহারা। দেখেই জিভে জল!

দীপ্ত ফিসফিস করে বললো এক্সট্রা ভাত লাগবে কিন্তু!
– ও দাদা এক্সট্রা রাইস হবে ? কত ?
– হবে হবে, আপনারা শুরু করুন, কাউন্টার থেকে আওয়াজ আসে ।

আরাম করে হাত ধুয়ে খেতে বসে চারমূর্তি মুখ চাওয়াচায়ি করি।

রান্নায় কোনো নুন নেই!

– এই রে, আপনারা একটু নুন নিয়ে নিন না! আসলে যে রান্না করে, সে আসেনি, গন্ডগোল হয়ে গেছে । কাউন্টার তখন টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছে।

রইলো পরে এক্সট্রা রাইস আর কব্জি ঢুবিয়ে চিকেন।

এদিকে অভিজিৎ আল্টিমেটাম দিচ্ছে, বাস ছেড়ে দেবে কিন্তু!

কোনো ক্রমে দু গ্রাস খেয়ে সকলে পড়িমরি করে বাসের দিকে দৌড়ই। এই বাস ছেড়ে দিলে কাল সকালের আগে আর কোনো বাস নেই।

ফাঁকা বাসে একটু হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম সকলে। বাস ছাড়লো, খানিক পেরোতেই ভর্তি।

বেশিরভাগ চারপেয়ে, দুপেয়ে যা ছিল তার মধ্যে মানুষ কম, মুরগি বেশি।
ছোটরা ও তাদের মালিকরা প্রত্যেকেই যদিও বেশ ভদ্র।

মাফলার টুপি টেনে টুনে ঢেকে নিই। ভারী ব্যাগে আরও শীতবস্ত্র ভরা।  ব্যাগ কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘুম ভেঙ্গেছিল সেই ডাকেঃ বাবু একটু সইরে বসবে গো ?

নাসি গ্রামে যখন বাস থেকে নামলাম তখন সূর্য ঢলে গেছে।
মেলা ঘুরে তারপর অভিজিতের বাড়ি।
মেলাতে আরো ফ্লপ, মশলামুড়িতে এত নুন যে লেবু চিপেও বিশেষ মুখে দেওয়া গেল না।

বাড়ি পৌঁছে ঠাকুমার আতিথেয়তায় মুগ্ধ আমরা। আমাদের খাওয়া দাওয়ার দুর্ভাগ্য শুনে বললেন তোমরা হাত মুখ ধুয়ে বস। জলখাবার দিয়ে খিদে মারবো না। একবারে মাংস ভাত।

পাঁঠার মাংস রান্নার সুবাস আসছিলো অনেকক্ষণ থেকেই।  তবে অভাগা পেটকে বলি, সাবধান বৎস, গন্ধে দৃশ্যে বিভ্রান্ত হয়ো না, স্বাদের অপেক্ষা কর!

অভিজিৎ বেশ নার্ভাস!

ঠাকুমা নিরামিষাশী , অভিজিতের দুশ্চিন্তা ঠাকুমা ঠিক স্বাদের মাংস করে উঠতে পারবেন তো ?

আবার ফ্লপ হবে নাতো ?

বসতে না বসতেই ঠাকুমার সাবধানবাণী, আমি তো মাংস খাই না, সন্ধ্যা থেকে টিমটিম করে আলো জ্বলছে, ভোল্টেজ কম!
জানি না নুন টুন্ ঠিক হয়েছে কিনা।

আমাদের তখন মাথা ঝিম ঝিম!
অভিজিৎ বলছে ভয় পাসনা, পাশের ঘরে ঘি  আছে – যদি দরকার হয় তো!

নাহ্, সে রাতে আর ঘি দরকার হয় নি!
জম্পেশ সেই পাঁঠার মাংসের স্বাদ মনে হয় এখনো মুখে লেগে আছে।

সকাল থেকে আমাদের নুন-বিভ্রাট শুনে ঠাকুমা হেসে গড়িয়ে পড়লেন।  বললেন নুন একটা সাংঘাতিক জিনিস।  তবে তোমরা এখন যত সহজে নুন পাচ্ছ আমরা কিন্তু ছোটবেলায় তা পাইনি। নুন ছিল মহার্ঘ্য!

দাদু-ঠাকুরদাদের কাছে গল্প শুনেছি কি এক পারমিট লাইন পেরিয়ে নুন আসতো বাংলায়।  বাড়িতে সুন্দর পাত্রে থাকতো লবণ। ঝিনুকের খোলায় দেওয়া হয়তো রান্নায়।

ভরপেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগে অনেক গল্প হলো ঠাকুমার সাথে। কিন্তু পারমিট লাইনের গল্প ঠাকুমার ঝুলির লালকমল নীলকমল গল্প ভেবে ভুলেই গেছিলাম।

কিন্তু শক খেলাম ২০০২ সালে!
….(ক্রমশঃ)