মোবাইলটা লাগাতার বেড়ে যাচ্ছিল, অগত্যা ভেজা গায়েই টাওয়েল জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ফোনটা ধরতেই হল। একরাশ বিরক্তি মাখা গলায় প্রশ্ন ছোড়ে সুশোভন,
কে বলছেন ?
পটাবাবু বলছেন কী?
ডাষনামের সঙ্গে ‘বাবু’ যোগ করে নীলপাহাড়ির মানুষ, বড়জোর কার্মাহাটার দু’চারজন
পরিচিত ছাড়া ‘সুশোভন’ নামেই সবাই ডাকে।
-কে আপনি? চিনলাম না তো!” স্বরে আর কাঠিন্য আনে সুশোভন। আমি থানা থেকে বড়বাবু বলছি। এস. সি. মহাপাত্র। আপনি নীলপাহাড়ি চা বাগানের বড়বাবু তো?
থানা শুনে মুহুর্তে সুশোভনের স্বরের কাঠিন্য উবে যায়।
- ইয়েস স্যার… আমিই পটা মানে সুশোভন সাঁতরা। কী ব্যাপার স্যার? – আপনাদের বাগানের একজন লোক সেই সকাল থেকে থানায় বসে আছে। বলছে আপনাকে চেনে। একবার আপনাকে আসতে হবে থানায়। রীতিমতো অর্ডার করার সুরে কথা বলেন মহাপাত্র।
কে লোক, কী নাম ? নীলপাহাড়ির মানুষ কেনই বা থানায় গেল আর তাকে চেনে বললেই দুম করে থানাতেই বা যেতে হবে কেন! —‘স্যার লোকটার নামটা একটু বলবেন। বেশ মোলায়েম স্বরে অনুরোধ করে
সুশোভন।
–’অ্যাই, লোকটার নাম কী জিজ্ঞেস কর তো।’ কারও উদ্দেশ্যে গলা চড়ায় মহাপাত্র। -দেখছি না স্যার। এইমাত্র তো ছিল এখানে। ফোনে কারও গলা শোনা যায়। -‘দ্যাখো দ্যাখো… ভালো করে দ্যাখো… যাবে কোথায়, আশপাশেই হবে। সকাল থেকে বারবার এসে জ্বালিয়ে মারছিল। আর এখনই হাওয়া!
– “দেখতে কেমন একটু বলবেন স্যার? নামধাম কিছু…।’ সুশোভন প্রশ্ন করে। —“চেহারার অভ ডিটেল দিতে পারব না। তবে বয়স্ক মানুষ। মুখে দাড়ি, দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছিল। স্মার্টফোনটা সঙ্গে নেই। থাকলে না হয় ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিতাম। শেষের কথাগুলোতে শ্লেষ জড়ানো।
ফের একটা ঝটকা। নীলপাহাড়িতে থাকে। সুশোভনকে চেনাটাই স্বাভাবিক। তবে লোকটা থানায় গিয়েছে কী উদ্দেশ্যে। গিয়েছে যাক মরতে তার নামটাই বলতে হয়। ‘আমার নামে কী বলেছে স্যার?? একটু ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেই করে সুশোভন। ‘বলছে আপনারা নাকি ওর টাকা আটকে রেখেছেন। পাওনা টাকা চাইলেও
দিচ্ছেন না। চাইতে গেলে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। বিস্ময়ের বেলুনটা ফুলতে ফুলতে যখন প্রায় ফেটে যাওয়ার উপক্রম ঠিক তখনই
করে একটা মুখ ভেসে ওঠে।
– ‘স্যার একটু কুঁজো মতো কী ? হাতে লাঠি আছে ??
-“হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন… এই – এই তো এসে পড়েছেন বাপধন। অ্যাই ইধা আও… তুমহারা নাম ক্যায়া ?? -‘ধানো… ধানো মাহালি।” স্পষ্ট
শুনতে পায় সুশোভন। মহাপাত্র রিপিট করেন, “ধানো মাহালি। চেনেন তো ?” -‘হাঁ স্যার বিলক্ষণ। ও থানাতেও পৌঁছে গিয়েছে!”
—‘অন্যায় তো কিছু করেনি। আপনারা ওর পাওনা টাকা আটকে রাখবেন আর ও
অসুস্থ শরীরে টাকার জন্য ঘুরে বেড়াবে সেটা কি ঠিক হচ্ছে ? লোকটা ‘গেরচিটি-গেরচিটি’ করে কী একটা বলছে। সেটা কী ??
—‘আজে ওটা গ্র্যাচুইটি। ওর গ্র্যাচুইটির কিছু টাকা পাওনা আছে সেটাই বলছে।”
–‘অ। তা দিয়ে দিচ্ছেন না কেন?’
-“আজ্ঞে স্যার, দিইনি তা নয়। বার তিনেক পেয়েছে পাঁচ হাজার করে। যতবারই
দিয়েছি টাকাগুলো ওর ভাইপো বউয়ের ভোগে লেগেছে। টাকা কেড়ে নিয়ে এখন বারবার বুড়োটাকে পাঠাচ্ছে টাকার জন্য।’
–’অ্যাই তুম ঝুট কিঁউ বোলা। তুমকো তো পইসা মিলা…।” ধানো মিনমিন করে
কী বলল, ঠিক বোঝা গেল না।
—‘লোকটা অসুস্থ বুঝলেন। হাসপাতালে ভর্তি ছিল ক’দিন। হাসপাতালের কাগজপত্র যা দেখাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে অপারেশন কেস। বাকি পাওনা টাকাটা একথোক পেলে ওর কাজে লাগবে। দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলুন।
-‘আসলে কি স্যার… রিটায়ারড ওয়ার্কারদের হিউজ অ্যামাউন্টের গ্যাচুইটি বাকি পড়ে আছে। কোম্পানি প্রতি মাসে লাখ দুয়েক করে পাঠায়। তাই দিয়ে কিস্তিতে পাঁচ হাজার করে যতজ্জনকে সম্ভব দিতে হয়, তাও সিরিয়ালি, ইয়ার অব রিটায়ারমেন্ট দেখে।’
– বুঝলাম। তা পি. এফ-র টাকা ঠিকটাক জমা হচ্ছে তো? নাকি ‘সেটাও…’। সুশোভন কী বলবে বুঝে পায় না, ‘ইয়ে’ মানে স্যার ওই ইনস্টলমেন্টে…
‘বুঝেছি। তা আপনাদের ম্যানেজার কে এখন??
=”মি. ভাগব, স্যার।
“আগের জন তো পি. এফ. এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্টের ভয়ে ওয়ারেন্ট বেরোতেই
রিজাইন দিয়ে কেটে পড়েছিলেন। ইনিও সেইরকম সরে পড়বেন না তো ??
“কী করে বলি স্যার।”
– ‘নতুন ম্যানেজারের নাম্বারটা দিন তো। এখানে জয়েন করার পর আশপাশের
মোটামুটি সব বাগানেই ভিজিট করেছি। আপনাদেরটাতেই যাওয়া হয়নি।’
সুশোভন নাম্বারটা বলে। মহাপাত্র লিখে নিয়ে বলেন এভাবে গরিবের টাকা
মেরে কি ব্যবসা করা যায় পটাবাবু। যায় না। গরিবের টাকা কেটে ব্যবসায় ঢালবে অথচ
প্রতিবাদ করতে গেলেই বাগান বন্ধ করে সরে পড়বে।
মহাপাত্রের শেষ কথাগুলোয় একটু সাহস পেয়ে সুশোভন বলে, ‘কী আর বলব
স্যার। আর বছর দুয়েক পর রিটায়ার করব। বড় চিন্তায় আছি। রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট্
না পেলে তো ধান্যের মতোই অবস্থা হবে আমারও।
—’হুম। তা ম্যানেজারবাবু বাগানে আছেন তো?” সুশোভনের দুশ্চিন্তা মাখানো
কথার কোনো প্রতিক্রিয়া শোনা গেল না মহাপাত্রর গলায় ।।
– ‘ম্যানেজারবাবুকে বলে রাখবেন একদিন যায় দেখা করতে।
-“ইয়েস স্যার।” ফোনটা বোধহয় কেটে দিতে যাচ্ছিলেন মহাপাত্র। তার আগেই তড়িঘড়ি জিজ্ঞেস
করে ফেলে সুশোভন।
‘আমাকে কি তবে থানায় যেতে হবে স্যার?
‘না-আ। ঠিক আছে ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনার কাছে। এই ধানো-খানো…
ফোনের মধ্যেই তারস্বরে চেঁচাতে থাকেন বড়বাবু মহাপাত্র। ‘তুম চলা যাও। পটাবাবু
কো হাম বোল দিয়া। রুপিয়া মিল যায়েগা
ফোনটা কেটে যেতেই মনে মনে চিড়বিড়িয়ে ওঠে সুশোভন। ‘মিল যায়েগা’ বলে দিয়েই তো দারোগাবাবু খালাস। এখন হ্যাপা সামলাও। ধানো ব্যাটা তো এসেই ধনী দিয়ে পড়বে। এ মাসের গ্র্যাচুইটির ইনস্টলমেন্ট পেমেন্টও শেষ। সেফে টাকাও নেই। তাছাড়া ধানোর থানায় যাওয়ার খবর শুনলে বড়সাহেব যে কী মূর্তি ধারণ করবেন কে
জানে। আর তুই ব্যাটা ধ্যানো… বিপদে আপদে যতবার এসেছিস পকেট থেকে দিয়েছি। দিয়েছি তোকে ভালোবাসি বলে। সিধেসাধা ভালো মানুষ তুই। সেই ছোটবেলা থেকে তোকে দেখতাম অফিস বারান্দায় টুল পেতে বসে থাকতিস। সাহেববাবুদের ফাইফরমা খাটডিস। ধানো চাপরাশিকে সবাই সহজ সরল ভালোমানুষ বলেই জানে। আর তু কিনা এইরকম একটা কাজ করে বসলি। মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে নীলপাহাড়ি বড়বাবু সুশোভন সাঁতরা ওরফে পটা… শ্রমিকরা যাকে পোটাবাবু বলে ডাকে।
নীলপাহাড়ির ডাক্তার ভয় ধরিয়েছিল। কামাহাটা ব্লক হাসপাতালের সরকারি ‘ডাগদার সাহেবের কথায় ভয়টা জংলি শুয়োরের মতো তেড়ে আসতে থাকে। পেটের যন্ত্রণাট ‘জানলেওয়া’ আর অপারেশন না করলে যে মৃত্যু অবধারিত সেটা শুধু বলা নয় ডাক্তার যেন ধানোর চেতনায় সিরিঞ্জ দিয়ে ইনজেক্ট করে দিয়েছিল। তারপর থেকেই শুম মেরে যায় ধানো। মাথার ভিতর চিন্তাভাবনাগুলো জট পাকাতে থাকে। একটা শব্দ মস্তিষ্কের দেয়ালে বেয়াড়া ভোমরার মতো গোঁ গোঁ করে গোত্তা খেতে থাকে। টাকা টাকা-টাকা’ । টাকার ভীষণ দরকার এই মুহুর্তে। দড়ি বাঁধা হাফপ্যান্টটার কোমরে গোঁজ পাঁচটা কুড়ি টাকার নোট। আপাতত এটাই সম্বল। হাসপাতালে আসার সময় অনেক অনুনয় বিনয় করে লখিয়ার কাছ থেকে জুটেছে। ব্যাংকের পাশবইটাও ওর হেপাজতে যদিও ওতে কিছুই নেই । কবে পি. এফ-র টাকা ঢুকবে সেই আশায় ওটা কাছে রেখেছে। মনে মন হাসে ধানো। যে রোগ ধরেছে, শ্বাস বন্ধ হলে ওই টাকাও আর ভোগে লাগবে না ওই মেয়েছেলেটার । নমিনি যার নামে সেই ভাইপো রঘুটাও তিনহাত মাটির নীচে শুয়ে আছে চিরঘুমে। টাকা পেতে কালঘাম ছুটবে ওই চুড়েল আউরতের।
ধানোর ‘বদলি-গুনতি’ মানে পরিবর্তে চাকরিটা পেয়েছিল রঘু। ও চোখ বুজতেই সেটা পেল লখিয়া। ওর বউ। শুধু ‘গুনতি’ই না, ধানোর গ্র্যাচুইটির টাকায় লোহার খাট, আলমারি, চারটা প্লাস্টিক চেয়ার, টিনের বাক্স, হাঁড়ি কড়াই, চারটে মুরগি, দু’টো ছাগল সব বাগিয়ে নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে বাঁজা মেয়েমানুষটা। ধানোর ঠাঁই হয়েছে ভাঙা বেড়ায় ঘেরা মাটির বারান্দার এক কোণে। বাঁশের মাচায় কম্বল পেতে ধানো শোয়। দু’ বেলা দু’টো ভাত ফুটিয়ে নেয় মাচার পাশে মাটির উনুনে। বর্ষার রাতে ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বিদ্যুতের ঝলকানি ঢুকে শাসিয়ে যায়। গুঁড়ি গুঁড়ি ফিচেল বৃষ্টির ছাঁট এসে কাঁথা ভেজায়। শীতের কুয়াশা ফাঁকফোকর গলে চোরের মতো ভেসে এসে শরীর জড়ায়। ছেঁড়া কাঁথায় মাথা মুড়ি দিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকে ধানো মাচার উপর।
পড়ে থাকে আরও একটা প্রাণী। নিঃশব্দে। অত্য। ধানোর প্রিয় প্রভুতক্ত কুকুরটা। হাসপাতাল ফেরত পথে টাকার চিন্তায় ফাঁদে পড়া বুনো খরগোশের মতো ছটফট করছিল ধানোর ঘনটা। পাওনা অতগুলো টাকা দূর পাহাড়ের মতো হাতছানি দেয়। ধরা দেয় না কিছুতেই। আশঙ্কার মেঘ ছায়া ফেলে ভাঙনে ধসে পড়া খানোর তালতোবড়ানো সালে। সাদা তীক্ষ্ণ শরবনের মতো খোঁচা খোঁচা দাড়ির জঙ্গলে। কপালের তাঁজে।
গুটকা কিনবে বলে ড্রাইভার অ্যাম্বুলেন্সটা দাঁড় করিয়েছিল থানার উল্টোদিকের পান দোকানটায়। ছুটি হয়ে যাওয়া আরও দু’চারজন রোগীর সঙ্গে বসেছিল বানো পিছনের সিটে। জানলা দিয়ে শূন্যদৃষ্টি মেলে চেয়েছিল বাইরে। ঠিক তখনই মস্তিষ্কের ভিতর বেয়াড়া তোমরাটা মরিয়া হয়ে ওঠে। নেমে পড়ে ধানো। লাঠি ঠুকে ঠুকে রাস্তা পেরিয়ে সটান ঢুকে পড়ে থানার ভিতর।
থানা থেকে বেরিয়ে আতদন্তরে পড়ে যায় ধানো। বাইরে দামগাছের ছায়ায় বসে যখন ভেবে যাচ্ছিল কীভাবে বাড়ি পৌঁছবে ঠিক তখনই একটা মোটরবাইক এসে থামে সামনে। একটি মাঝবয়সী ছেলে এসে তার নাম জানতে চায়। তারপর হাত ধরে নিয়ে গিয়ে পাশের চায়ের দোকানে বসায়। চা-বিস্কুট খেতে খেতে ধানের সাথে পরিষ্কার সাদরীতে কথা বলে। অথচ লোকটা আদিবাসী নয়। কথায় কথায় ধানোর নাড়ি নক্ষত্র সব জানতে থাকে। মোবাইলে ছবি তোলে। তারপর বাইকে তুলে নিয়ে ছেড়ে আসে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। যেখান থেকে নীলপাহাড়ির গাড়ি ছাড়ে। লোকটা কে, কেনই বা এত করল যানো বোঝে না।
পরদিন সকালে উঠে যানো উপলদ্ধি করে, কোথাও একটা অন্যরকম সুর বেজে
চলেছে। অনেকেই জেনে গিয়েছে তার থানায় যাওয়ার খবরটা। বিকেলে অফিস চৌকিদার
এসে খবর দেয় বড়সায়ের ডেকে পাঠিয়েছেন।
একটু ভয়ে ভয়েই অফিসে গিয়েছিল খানো। ঝোঁকের বশে থানায় নালিশ জানানোটা যে ঠিক হয়নি বুঝতে পারে। লখিয়া কাজ থেকে ফিরে ধমকায় ‘কালে থানা গেলে ? সাহেব তোকে মুরুখ গরিয়াই”। সাহেব যে বকাবকি করতে পারে সেটা উপলব্ধি করতে পারছিল যানো। পাশের বাড়ির ছেলেটা স্কুল থেকে ফিরে খবরের কাগজ নিয়ে এসে মেলে ধরে, দেখ নানা, তোর ফটো ছাইপে। কাগজটা হাতে নিয়ে দেখে গানো। চায়ের দোকানে সেই লোকটা যে ছবি তুলেছিল সেই ছবি। ছেলেটা আঙুল দিয়ে দেখায়, ‘তোর বারেমে কা-কা লিইছে।’ কী লিখেছে সেটা পড়তে পারে না যানো। বড়সায়েব কিছু না বললেও বড়বাবু ধানোকে একান্তে ডেকে নিয়ে টাকাটা হাতে তুলে দিতে দিতে অনুযোগ করে– “খামোকা থানায় যাওয়ার কী দরকার ছিল। তোকে
কি আমরা টাকা দিই না যতবার পেয়েছিস তোর বহুরিয়া লুটে নিল, আর তুই কিন বললি…। আরে বিপদে পড়লে পুলিশ দাঁড়াবে, না আমরা দাঁড়ার তোর পাশে। টাকা নেয় না ধানো। সুশোভনকে রেখে দিতে বলে। ধরে নিলেই লখিয়া যে কেড়ে নেবে। বরং অপারেশনের জন্য সদর হাসপাতালে যেদিন যাবে সেদিন এে
নিয়ে যাবে বলে চলে যায়।
টাকা নিতে আর আসতে হয়নি ধানোকে। আসলে বাকি টাকাটা শেষ পর্যন্ত ও ভোগে লাগল না। মাসখানেক বাদে লখিয়াকেই ডেকে সুশোভন হাতে ধরিয়ে দে ধানোর বকেয়া সবটুকু টাকা
এরপর অনেকদিন কেটে যায় নীলপাহাড়ির জীবনের স্রোত যেমন নিস্তরঙ্গ বসে চলছিল তেমনই চলতে থাকে। শ্রমিকরা রোজ সকালে কাজে যায়। বিকেলে ঘরে ফিরে আসে। সময়ের চাকা ঘুরে দিন যায় দিন আসে। শুধু দিন বদলায় না। কেবল দু’টি ছো পরিবর্তন কারও চোখে পড়ে না।
যতদিন যায় শান্ত স্বভাবের সুশোভন সাঁতরা কেন যেন হঠাৎ করে তিরিক্ষি হয়ে উঠতে থাকে। তিতিবিরক্ত সুশোভনের সাথে ম্যানেজমেন্টের কথায় কথায় খটামটি লাগতে থাকে। কাজেকর্মে ভুল হয়। সেই সুযোগটা ম্যানেজমেন্ট নিতে ছাড়ে না, শো কাজের চিঠি ধরায়। তবু দমানো যায় না সুশোভনকে। সহকর্মীরা কানাঘুষো করে ‘চাকরিট গেল বোধহয় পটাদার।” তবে ইদানিং বাতের দিকে কার্মাহাটার দিক থেকে প্রায় দিনই একটা কালো জিপ এসে দাঁড়ায় ম্যানেজার বাংলোর পোটিকোয়। গভীর রাত অবধি গাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকে। ভেতর থেকে ভেসে আসে চাপা উল্লাস, মৃদু সঙ্গীত আর মদিরা পাত্রের টুংটাং শব্দ। তারপর গভীর রাতে গাড়িটা যখন হাড়জিরজিরে রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে ধানোর বাড়ির পাশ দিয়ে ফিরে যায়, কেন যেন ধানোর কুকুরটা ভাড়া করে গাড়িটাকে। তাড়া করে অনেক দূর ছোটে গাড়ির পিছন পিছন ফিরে এসে খানিকক্ষণ ধানোর শূন্য মাচার বিছানাটা শোঁকে। কুইকুই করে শব্দ করে। একসময় কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ে মাচার তলায়।
বাইরে কালো রাতের প্রহর গড়িয়ে চলে অবিরত। আবহমান গতিতে।