জল সংরক্ষণ নিয়ে কিছু কথা

‘’সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং শস্যশ্যামলাং মাতরম্৷৷’’ কবির মতো আমরা সবাই এই ধরাভূমিকে চিরসবুজ, সুফলা, কলরবে মুখরিত দেখতে চাই। কিন্তু তার যৌবনতাকে বজায় রাখার সুগঠিত প্রচেষ্টা করি না।

ভগবানের অপরূপ উপহার ‘জল’। জলই জীবন। জল ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ কোনভাবেই সম্ভবপর নয়। পৃথিবীর আদিম প্রাণ জলেই সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর সব জীব জলের উপর নির্ভরশীল।

এ পৃথিবীতে তিনভাগ জল, একভাগ স্থল। পাঁচ, পাঁচটি মহাসাগর, বেশ কয়েকটি সাগর-উপসাগর, অগণিত নদ-নদী, খাল-বিলের বিপুল জলরাশিভান্ডার থাকা সত্বেও, উন্নত-উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কৃষিকাজ ও পানীয়-জলের সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, ধীরে-ধীরে তা ক্রমশ ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। আফ্রিকা, এশিয়ার মতো লাতিন আমেরিকার দেশগুলিও এর কবলে পড়ে এখন হাঁসফাঁস করছে। অনুন্নত দেশগুলিতে জলের হাহাকার লক্ষ্য করবার মতো।

আমাদের দেশ ভারতবর্ষও এর ব্যাতিক্রম নয়। রাজস্থানের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি দিল্লী, মুম্বাই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালুরুর মতো হাইটেক সিটিগুলিতে বিগত কয়েক বছর ধরে তীব্র জলকষ্ট দেখা দিচ্ছে। কোন কোন জায়গার মানুষরা নোংরা, দূষিত জল পর্যন্ত খেতে বাধ্য হচ্ছেন। বিভিন্ন জায়গায় মানুষকে পানীয় জল আনার জন্য ১০-১৫ কিমি পথ হেঁটে বা সাইকেলে করে, যাতায়াত করতে হচ্ছে। তার ফলে, যেমন বিভিন্ন জলবাহিত রোগ দেখা দিচ্ছে, তেমন মানুষের শ্রম ও সময় দুটোই নষ্ট হচ্ছে। অনেক সময় জলবাহিত রোগে, শত শত মানুষ মারাও যাচ্ছেন। আমাদের প্রাণের শহর কোলকাতাতেও জলের আকাল ধীরে ধীরে প্রকটমান।

ভূ-গর্ভস্থ জল সঞ্চয়ন, একটি খুব ধীরগতির সময়সাপেক্ষ প্রাকৃতিক ঘটনা। যা আদিমকাল থেকে পৃথিবীতে ঘটে আসছে। বৃষ্টির জল প্রাথমিকভাবে সাগর, নদী-নালা, পুকুর, খাল-বিলে জমা হয়। তারপর তা কঠিন শিলাস্তরের সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে খুব ধীরে ধীরে ভূ-গর্ভের অনেক গভীরে সঞ্চিত হয়। এই কাজে বনভূমিও একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে।

বর্তমান আধুনিক সমাজে বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য যথেচ্ছভাবে ডিপ-টিউবওয়েলয়ের সাহায্যে ভূ-গর্ভ থেকে দ্রুত হারে পানীয় জল নিষ্কাশন করা হচ্ছে। নির্বিচারে অরণ্যবিনাশের ফলে হচ্ছে, তাঝাড়াও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ফলে ভূ-গর্ভে জল-সৃঞ্চনের ভারসাম্য ব্যহত হচ্ছে।

পৃথিবীর মোট জলরাশির ৯৭% লবনাক্ত, ব্যবহারের অযোগ্য জল। বাকী ৩% এর ২.৯% আন্টার্কটিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে হিমায়িত। বাকীটার কিছুটা অংশ পর্বতে, নদী-নালায় সঞ্চিত। এটা থেকে পরিষ্কার যে, আমরা সারা পৃথিবীর মানুষজন খুব অল্পপরিমান জলই ব্যবহারের কাজে লাগাতে পারি।

জল অপচয় রোধে ও সংরক্ষণে এখনই যথেষ্ট সুদৃঢ় পদক্ষেপ না নিলে আমরা একটা বিশাল বড় বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছি । তার ফল কিন্তু ভবিষ্যত প্রজন্মকে ভুগতে হবে। এটা ঘটলে, তারা কিন্তু আমাদের কোনোদিনও ক্ষমা করবে না। তাই যতটা সম্ভব জল অপচয় বন্ধ করতে হবে, ঘর-গৃহস্থালীর কাজ থেকে শুরু করে, কল-কারখানা, চাষবাসের কাজ, সবেতেই বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে জল ব্যবহার করতে হবে।

সমুদ্রের লোনাজলকে ব্যবহারযোগ্য করে তোলার সুলভ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আবিষ্কার এখনো পর্যন্ত সম্ভবপর হয়নি। যেটুকু হয়েছে, তা যথেষ্ট শক্তি আর ব্যয়সাপেক্ষ।

জল সংরক্ষণে এখনও আমাদের সবচেয়ে বড়ো ভরসা, ‘বৃষ্টির জল’। তাই গ্রামাঞ্চলে যথেষ্ট পরিমান পুকুর, খাল-বিল, জলাশয় খনন ও সেগুলির রক্ষনাবেক্ষণ করতে হবে। শহরাঞ্চলের বাড়ীর ছাদগুলিকে, এই কাজে লাগাতে হবে। ঘরের ছাদে জলের ট্যাঙ্ক বসিয়ে বৃষ্টির জলকে ধরে রাখতে হবে। প্রচুর পরিমানে গাছপালাও লাগাতে হবে। নতুন নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি করতে হবে। এখন তো সরকারও এই কাজে যথেষ্ট উৎসাহ ও সহায়তা প্রদান করছে।

২২মার্চ, বিশ্ব জল সংরক্ষণ দিবস। আমি মনেকরি, ওই একদিন জল সংরক্ষণ না করে, আসুন সবাই মিলে, বছরের ৩৬৫দিনই একটু একটু করে অনেকটা পরিমান জল সংরক্ষণ করি।

ভবিষ্যতে জল, পেট্রোলের মতো একটি মহার্ঘ বস্তুতে পরিণত হলে, তখন কিন্তু উন্নতদেশগুলির বলির পাঁঠা হতে হবে, আমাদের মতো উন্নয়নশীল, অনুন্নত দেশগুলোর মানুষজনকে। ঠান্ডা-যুদ্ধের বলি হব আমাদের মতো সাধারণরাই।

তাই আসুন, সবাই একসুরে বলি,

.      ”জল ধরো, জল ভরো।

.       জলের সহজ প্রাপ্তি, টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি৷

.       করি জল সংরক্ষণ, সুখী হোক আমাদের সবার জীবন।”