৩৭৫ বছর লেগে গেল, অষ্টম মহাদেশের সন্ধান পেতে। তবে রহস্য এখনও অনেক! জানা যাচ্ছে, ১৬৪২ সালে, অ্যাবেল তাসমান নামের এক অভিজ্ঞ ডাচ নাবিক এই লুকোনো মহাদেশের খোঁজ পান। অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী এই মানুষটি ন্যায়-বিচারের প্রতি এতটাই আস্থা রাখতেন যে একবার মদ্যপ অবস্থায় নিজের কর্মচারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ফাঁসি দেওয়ার উদ্যোগ নেন।
অ্যাবেল মনে করতেন, নিউ জিল্যান্ডের দক্ষিণ হাম্পশ্যায়ারে এক বিপুল প্রদেশ লুপ্ত আছে। দুনিয়ার এই অংশটির কথা তখনও বাইরের মানুষের কাছে অজানা। টেরা ওস্ট্রালিস নামের এই জায়গার উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন রোমের ইতিহাসে। অ্যাবেল তাসমান এই তথ্য জেনেই তাঁর দু’টি ছোট জাহাজ নিয়ে জাকার্তা থেকে যাত্রা শুরু করেন। পশ্চিম উপকূল ধরে এগিয়ে দক্ষিণ অভিমুখী হয়ে শেষে পূর্ব উপকূলে গিয়ে নিউ জিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডে নোঙর করেন। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ একেবারেই সুখপ্রদ হয়নি। সাউথ আইল্যান্ডে পৌঁছনোর পরের দিন, স্থানীয় বাসিন্দারা ছোট ছোট নৌকায় চড়ে ডাচ জাহাজ দু’টিকে ঘিরে ফেলে। তাদের দুর্বোধ্য ভাষা বুঝতে পারেনি জাহাজের লোকজন। সংঘর্ষে চার জন ইউরোপিয়ান মারা যায় এবং অনেকগুলো নৌকায় আগুন ধরে যায়। অ্যাবেলের অভিযানের এখানেই সমাপ্তি। তিনি এই স্থানকে ‘মার্ডারারস বে’ নাম দিয়েছিলেন।
এই ঘটনার বহু বছর পরে, ২০১৭ সালে একদল জিওলজিস্ট, জিল্যান্ডিয়া আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করলে, লুকনো মহাদেশের বিষয় আবার শিরোনামে উঠে আসে। কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত এনসাইক্লোপিডিয়া, ম্যাপ এবং সার্চ ইঞ্জিন একযোগে এই তথ্যের বিরোধিতা করে জানিয়েছে মহাদেশ সাতটিই। অষ্টম মহাদেশের অস্তিত্ব তারা অস্বীকার করলেও, জিওলজিস্ট টিমের অন্যতম সদস্য, অ্যান্ডি ত্যুলক বলেছেন, ‘এই আবিষ্কার প্রমাণ করে, দীর্ঘদিনের প্রয়াসে সত্য প্রকাশিত হবেই’।
তবে এ তো সবে শুরু! এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাকি— যেমন, কী ভাবে এই মহাদেশ গঠিত হল? সেখানে কারা বসবাস করত? কতদিন এই জমি জলের তলায় ছিল? ইত্যাদি। ব্রিটিশ মানচিত্র- নির্মাণকারী, জেমস কুককে, অ্যাবেলের যাত্রার প্রায় একশো বছর পরে, দক্ষিণ হ্যাম্পশায়ারে পাঠানো হয়। প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে দিয়ে বৃহস্পতির যাত্রাপথ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সূর্যের দূরত্ব পরিমাপ করা। সেই সঙ্গে একটি মুখবন্ধ খাম তাঁর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়, প্রাথমিক কাজ শেষে খোলার কথা জানিয়ে। সেই চিঠিতে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে এই হারানো মহাদেশের অনুসন্ধান করার নির্দেশ দেওয়া ছিল। জিল্যান্ডিয়ার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রথম প্রামাণ্য তথ্য দেন স্কটিশ পরিবেশবিদ স্যর জেমস হেক্টর।
১৮৯৫ সালে হেক্টর, নিউ জিল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলের দ্বীপগুলোতে সার্ভে করতে যান। গবেষণা শেষে তিনি তথ্য-প্রমাণ দিয়ে অষ্টম মহাদেশের অস্তিত্ব আছে বলে জানিয়ে দেন। এর পর আমেরিকার জিও-ফিজিসিস্ট ব্রুস লুয়েন্ড্যাক এই তথ্যকে সমর্থন করেন। প্রায় একই সময়ে, ‘ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল অফ দ্য সি’ –তে ঘোষণা করা হয়, দেশগুলো তাদের আইনি সীমারেখাকে বাড়াতে পারবে, অর্থনৈতিক অঞ্চলকে বাদ দিয়ে এবং ২০০ ন্যটিক্যাল মাইল (৩৭০ কিলোমিটার) পর্যন্ত। সুতরাং, নিউ জিল্যান্ড যদি, লুক্কায়িত মহাদেশের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে, তবে তার আয়তন প্রায় ছয় গুণ বৃদ্ধি পাবে। এই মুহূর্তে গবেষণায় জন্য দরকারি ফান্ডিং না থাকায় অভিযান বন্ধ থাকলেও স্যাটেলাইট ডেটা থেকে জানা যাচ্ছে, জিলান্ডিয়াকে খুব পরিষ্কার ভাবেই দেখা যাচ্ছে এই টেকনোলজি ব্যবহার করে।
জিলান্ডিয়া সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যগুলি হল— জিলান্ডিয়া গঠিত হয় ৫৫০ মিলিয়ন বছর আগে। দক্ষিণ হ্যাম্পশায়ারে। তবে ১০৫ মিলিয়ন বছর আগে, কোনও এক অজানা কারণে জিল্যান্ডিয়া সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জিত হয়। এই ঘটনার ফলেই পরে এখানে গ্রানাইট, লাইমস্টোন ইত্যাদি পাথরের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। প্রাপ্ত নানা জন্তু-জানোয়ারের ফসিল হয়ে যাওয়া শরীরকে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, দীর্ঘ ও বৃহৎ এক প্রকার পশুর বসবাস ছিল এখানে। তবে জিলান্ডিয়াতে ডাইনোসর থাকত কি না— তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি।
কিউয়ি পাখি এবং ওডলি পাখি যে জিলান্ডিয়াতে ছিল— তা নিশ্চিতভাবে জানা গেছে। ২০১৭-তে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সার্ভে জিলান্ডিয়াতে হয়। প্রাপ্ত নমুনা, দেহাবশেষ , গাছপালার অবস্থিতি থেকে মনে হয়েছে জলে ডুবে থাকা ভূখণ্ডকে ঘিরে দীর্ঘতর আর একটি ভূখণ্ডও সেখানে ছিল। এই দ্বিতীয় ভূখণ্ডটির বিষয়ে অনেক ব্যাপারই ধোঁয়াশায় ভরা। প্রথম অনুসন্ধানের পর ৪০০ বছর পেরিয়ে গেছে— আজও অষ্টম মহাদেশ নিয়ে অধিকাংশ তথ্যই আমাদের সামনে আসেনি।