গঙ্গার মা, কাল একটু তাড়াতাড়ি আসবে তো, কত করে বলে দিলাম দাদাবাবুর আজ অফিসের মিটিং আছে, সন্তুর ইন্টারভিউ, মিন্টুর স্কুলে টেস্ট শুরু হবে।কথাটা বলছিলেন দে বাড়ির কত্রী মনিকা দেবি।তোমাকে এতো করে বললাম তুমি শুনলেনা।অথচ কোনো কিছুর তো বাদ নেই, বৌদি কাল আসবো না আমার ননদ আসবে, পরশু আমার পেট ব্যাথা করছিলো হাসপাতালে গিয়েছিলাম, তরশু গঙ্গার স্কুল থেকে ডেকে ছিলো, এবার কামাই করলেই মাইনে থেকে কেটে নেবো।
গঙ্গার মা চুপ করে কাজে লেগে গেলো। মধ্যিখানে বাড়ির কর্তা রাজীব বাবু বলে উঠলেন ওর কথাটাও তো একটু শোনো,কি জন্য দেরি হলো—-কথা টা শেষ হতে না দিয়ে মনিকা চেঁচিয়ে উঠলো, তুমি একদম চুপ করে থাকবে। তোমার প্রশয়ে আজ ওর এই অবস্থা। অর্ধেক বাসন তো আমার মাজা হয়ে গেছে। নাও চা টা খেয়ে আমাকে উদ্ধার কোরো ঘর গুলো ঝাঁট দিয়ে মুছে ফেল, দাদাবাবু পূজায় বসবে।
মনিকা কে একটু নরম দেখে গঙ্গার মা বললো— বৌদি একটা কথা বলবো? মনিকা বললো বলো। আচ্ছা সন্তু কে চাকরি করতে কি বাইরে যেতে হবে? এতো পড়াশোনা করে বাড়িতে থাকতে পারবে না? মনিকা বললো দেখছো তো চাকরির যা বাজার! গঙ্গার মা বললো তুমি রাগ করবে না তো?মনিকা ধমকে উঠলো আবার বক বক শুরু করলে তো? তাড়াতাড়ি হাত চালাও।গঙ্গার
মা বললো তুমি বললে না কেন দেরি করলাম! সকাল বেলায় চান করে মন্দিরে গিয়েছিলাম। আজ গঙ্গার সিক্সের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। সন্তুর ইন্টার ভিউ আছে আর মিন্টুর যাতে ভালো পরীক্ষা হয় এক সাথে সবার জন্য পুজো দিলাম।মনিকা দেবি বললেন সেটা আগে বললেই হতো।শুধু শুধু বকুনি খেলে তো। গঙ্গার মা বলল বৌদি এই নাও ফুল টা ওদের মাথায় ঠেকিয়ে দিও।
দিন চলে যায় নিজের ছন্দে। সন্তু এখন উইপ্রো কোম্পানিতে টেম্পোরারি চাকরি করছে। কিছুদিন পরে পারমানেন্ট হয়ে যাবে।মিন্টু ম্যাথে অর্নাস নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে।
সকাল বেলায় চায়ের আসরে হঠাৎ মিন্টু বলে উঠলো বাড়িতে যারা কাজ করে তারা অনেকটা কাকের মতো না? এক বাড়ির খবর অন্য বাড়িতে পৌঁছে দেয়, বেশ মজার না! কাল রবীন্দ্র ভবনে মনোজ মিত্রের কাক চরিত্র বলে একটা নাটক দেখলাম। আমার তো গঙ্গার মা পিসির কথা মনে পরে গেলো, মা তুমি ঘরে বসে সব খবর পেয়ে যাও।
ছোটো বেলা থেকে মনিকা দেবি এভাবে ওদের ডাকতে শিখিয়েছে বা ওরাও এভাবে নিজেরাই সম্বোধন করতে শিখেছে যে খবরের কাগজ দেয় তাকে পেপার কাকু ইত্যাদি।
মনিকা দেবি একটু ধমক দিয়ে বললেন ও শুনলে কি ভাববে বলতো? তোদের কত ছোটো থেকে দেখছে।
কলতলায় বাসন মাজতে মাজতে গঙ্গার মা কত খবর যে দিতে থাকে! সেদিন রবিবার ছিলো, সেদিন ও তার ব্যাতিক্রম ছিলোনা। জানো বৌদি —ঐ বেনে বাড়ির মেয়েটা কি বজ্জাত?দেখতে শুনতে সুন্দরী কিন্তু তোর পেটে পেটে এতো!মনিকা বললো কি হয়েছে বলবে তো? আমাদের সন্তুর মতো একটা ছেলের সাথে তার ভালোবাসা আছে গো! ছেলে টা কত করে বলছে একটা চাকরি পাই তারপরে তোমাকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসবো। সে মাগীর তর সয়না ।মনিকা ধমকে উঠলো আ কি হচ্ছে কি? সবাই বাড়িতে আছে গঙ্গার মা গলা টা নামিয়ে বললো ছেলেটা যখন তোকে ভালোবাসে তোর অসুবিধার কি আছে তার মানে তুই ওকে বিশ্বাস করিস না! ইতিমধ্যে মিন্টু কখন এসে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিলো কেউ খেয়াল করিনি। মিন্টু বলে উঠলো ঐ ছেলেটা আর মেয়েটা যখন কথা বলছিলো তুমি ওখানে উপস্থিত ছিলে?গঙ্গার মা বলে উঠলো সব কথা শুনতে হয়না বুঝে নিতে হয়! বলেই মিন্টু কে ধমকে উঠলো দ্যাখো বৌদি তোমার ছেলে আমাদের বড়দের কথা শুনছে। আমার মেয়ে ছোটো হতে পারে আমি কিন্তু তোর মায়ের বয়েসি, পাছে ছেলের সামনে বেঁফাস কিছু বলে ফেলে মনিকা একটু ধমক দিয়ে গঙ্গার মাকে বলল আবার ওর সাথে এসব কথা কেন বলছো?
বিকেল বেলায় গঙ্গার মা শুধু দুপুরের বাসন গুলো মেজে দিয়ে চলে যায়, দুপুরে মনিকা দেবি একটু বিশ্রাম নেয় ছেলেরা বাড়িতে থাকলে ওঁরাও একটু শুয়ে নেয় মনিকা পেছনের দরজাটা ভেজিয়ে রাখে গঙ্গার মা কাউকে বিরক্ত করেনা চুপ চাপ কাজ করে চলে যায়।
সন্ধ্যা বেলায় মনিকা লক্ষ্য করলো আজ বাসন তেমনই পড়ে আছে গঙ্গার মা কেন জানিনা আসেনি! পরের দিন সকালে এসেই গঙ্গার মা বলে উঠলো বৌদি কাল আসতে পারেনি ওদের জন্য একটু পিঠে করলাম তুমি তো এবার কিছু করলেনা মিন্টু তো খুব ভালোবাসে দেখেছি! মনিকা বললো আমাদের চাল গুড়োটা কিনে আনা হয়নি। তাছাড়া আমার শরীর টাও ভালো নেই।
বাসন মাজতে মাজতে গঙ্গার মা রোজ অন্য বাড়ির কাহিনী বলে আজ নিজের মেয়েকে নিয়ে বলতে শুরু করলো, বৌদি জানো গঙ্গাটা কখন যে বড় হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি, ওর বাবা এতো কষ্ট করে রিকশা চালিয়ে জনমজুর খাটে। তোর ভালো থাকার জন্যই তো তুই যদি পড়াশোনা না করে ছেলে দের সাথে হাসি মসকারা করিস তোর বাবার আর খাটতে ইচ্ছে করবে?ও একটু ও বুঝছেনা গো আমাদের কলোনিটা ভালো নয় গো। সারা দিন আমরা বাইরে থাকি ও ইস্কুলে যায় কি করে? মা বলেই হয়তো এতো চিন্তা হয় খারাপটাই মনে আসে বেশি ।
মনিকা সান্তনার স্বরে বললো তুমি এতো দুশ্চিন্তা করোনা ও এখন ছোটো তো আর একটু বড়ো হলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
এরপর আরো অনেক গুলো দিন কেটে গেছে সন্তু ঐ কোম্পানিতে পার্মানেন্ট হয়ে গেছে। মিন্টু মাস্টার ডিগ্রী করবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে। গঙ্গা ক্লাস টেনে পড়ছে সামনে টেস্টপরীক্ষা। একদিন ভোর বেলায় গঙ্গার মা এসে হাজির কাঁদতে কাঁদতে বললো বৌদি আমার সব শেষ, আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম। গঙ্গা কারোর সাথে চলে গেছে! ওর বাবাকে আর বাঁচাতে পারবোনা অনেক কষ্টে মদ টা ছাড়িয়ে ছিলাম আমি এখন কি করবো বুঝতে পারছিনা। মনিকা বললো বসো চা খাও ভগবানের উপর ভরসা রাখো হতেও পারে ছেলেটা ভালো ।
গঙ্গার মা এখন কেমন যেন চুপকরে থাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করলে তার জবাব অনেক পরে দেয়, মুখ বুঁজে কাজ করে চলে যায়।কথায় আছে দিন কারোর সমান যায়না। একদিন হঠাৎ করে সন্তুর অফিসে ফোন এলো! রাজীব বাবু অফিসে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছেন। অফিসের কলিগ রাই দেরি না করে সংগে সংগে নার্সিং হোমে ভর্তি করে। মাথায় অপারেশনের করতে হতে পারে।অনেক টাকার দরকার সন্তু ছোটো ভাই মিন্টু কে ফোন করে সব জানালো।
সেই দিনই মাকে সঙ্গে নিয়ে বাবাকে দেখতে গেলো মিন্টু ।তার আগে কোলকাতার আত্মীয় স্বজনরা ও এসে গিয়েছিলো। ওরা কোলকাতায় থেকেই বাবার ট্রিটমেন্ট করাবে সিদ্ধান্ত নিলো।এদিকে পাড়ার লোকেরাও শুনে ছিলো অপারেশনের কথাটা অনেক টাকার প্রয়োজন।
জমে মানুষে টানাটানির পর দু হপ্তা বাদ বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। অপারেশন করার আর দরকার পড়েনি কারন মাথায় যে অংশে রক্ত জমে গিয়েছিলো সেটা ওষুধেই ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাচ্ছে ডাক্তার বলেছে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু ওষুধ গুলো নিয়মিত খেতে হবে।
সেই দিন সন্ধ্যায় গঙ্গার মা এসে হাজির বললো বৌদি দাদা কেমন আছে গো?
মনিকা বললো হ্যাঁ আগের থেকে অনেক ভালো, বসো চা খাবে?গঙ্গার মা বললো নাগো একটা দরকারে এসেছিলাম বকবে নাতো? মনিকা বললো না না তুমি বলো। গঙ্গার মা একটা ছোটো প্যাকেট দিয়ে বললো এই গুলো তুমি রাখো, মনিকা বললো কি এ গুলো? আমার কানের গলার, হাতের —-সব মিলিয়ে অল্প কিছু টাকা হবে, তোমার এখন অনেক টাকার দরকার দাদাকে সুস্থ করে তুলতে হবে তো? মনিকা বললো এবার তোমাকে আমি ——-??বলে গঙ্গার মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, তোমার দাদা বাবু খুব ভালো আছে অপারেশন করতে হবেনা কিছু দিনের
মধ্যেই সেরে উঠবে, তুমি এগুলো তোমার
মেয়ের জন্য — এবার গঙ্গার মা কথাটা শেষ হতে না দিয়েই বললো বৌদি
একটা ভালো খবর আছে, জানো গঙ্গা জামাই কে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে ।
আমি জানতাম না গো ও তোমাদের মতো ভালো ঘরের ছেলে। সন্তুর মতো অফিসে কাজ করে, তবে একটাই শর্ত আমাকে আর লোকের বাড়িতে কাজ করতে দেবে না বলেছে, তবে তোমাদের বাড়িতে আসবো কিন্তু?
না বলতে পারবেনা বলে দিচ্ছি।মনিকা ভেজা চোখে এতো মনো কষ্টের মধ্যেও
একটু হাঁসলো। সে হাঁসি শুধু বাড়িতে
বাসন মাজা কাজের লোক বলে নয়
একজন সত্যি কারের খাঁটি মানুষের সরলতায়, বিশ্বাসের,ভরসায়।