খেলা

বৃষ্টিটা নেমেছিল গতকাল সন্ধের পরপরই। প্রত্যয় সাইকেল নিয়ে সবে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। গন্তব্য গৌতম স্যারের কোচিং ক্লাস। ঢাউস পিঠব্যাগে আছে বইখাতা।

গৌতম খাস্তগির শহরের নামকরা শিক্ষক। সায়েন্সের ছাত্র মাত্রেই কেমিস্ট্রির মিস্ট্রি সলভ করতে ছুটে যায় তাঁর কাছে। প্রত্যয়দের ব্যাচে আছে বিভিন্ন স্কুলের দশজন ছেলেমেয়ে। ক্লাস ইলেভেনের গন্ডি পেরিয়ে সক্কলে পৌঁছে গিয়েছে টুয়েলভে। আর তিন মাস পরেই হায়ার সেকেন্ডারির টেস্ট। তাই পড়াশুনা এখন চলছে তুফান মেলের গতিতে।

ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় করে প্রত্যয় ঢুকল স্যারের বাড়ির গেট খুলে। দোতলায় উঠে প্রথম যে ঘরটা সেখানেই পড়ান স্যার। সদর দরজা খোলাই ছিল। প্রত্যয় সাইকেল লক করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল ওপরে। এখনও কেউ আসেনি। স্যারও বসেননি নিজের জায়গায়। প্রত্যয় ব্যাগ রেখে দাঁড়াল জানালার পাশে। বৃষ্টির জোর বেড়েছে অনেকটাই। আজ আর কেউ আসবে কিনা সন্দেহ! অবশ্য আর কারও আসার তেমন দরকার নেই, শুধু উদিতা এলেই খুশি হবে সে। নিজের শার্টের পকেটে একবার আলতো করে হাত ছোঁয়াল প্রত্যয়। একটা সন্তুষ্টির হাসি হেসে ঘুরে তাকাল দরজার দিকে।  সিঁড়িতে শোনা যাচ্ছে পায়ের শব্দ। তার হৃদপিণ্ডটা যে এতো জোরে লাফাতে পারে সে আন্দাজ একটুও ছিল না প্রত্যয়ের।

ঘরের ভেতর জ্ব্লতে থাকা ধবধবে সিএফএলের আলোকে ম্লান করে ঢুকে পড়ল গাঢ় লাল রঙের ফ্রক পরা উদিতা। উদিতা যে আসছে সেটা আগেই টের পেয়েছিল প্রত্যয়। অমন দুদ্দার করে সিঁড়ি ভাঙতে একমাত্র উদিতাই পারে। ঘরে ঢুকেই ব্যাগটা দুম করে নামিয়ে রাখল টেবিলে। তারপর এদিক ওদিক দেখে হতাশভাবে বলল,

-যাহ্‌ শাল্লা কেউই তো আসেনি! আমিই খামোখা বৃষ্টি মাথায় করে ছুটে এলাম?

-কেন? আমি তো আছি।

হাসি মুখে উদিতার প্রশ্নের উত্তর দিল প্রত্যয়। মুখটা খানিক বিকৃত করে উদিতা বলল,

-হ্যাঁ, তা আছিস।

প্রত্যয়ের মনের ভেতর তখন এক্সেল সাইজের লাড্ডু ফুটছে একটার পর একটা। হাঁ করে তাকিয়ে আছে উদিতার দিকে। ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে উদিতা তার মুখ, ঘাড় থেকে মুছে নিচ্ছে বৃষ্টির জল। প্রত্যয়কে চেয়ে থাকতে দেখে বলল,

-ওরম ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে কী দেখছিস বে?

-কোথায়? কিছু না তো।

-তোর এই বোকা বোকা ভাব চক্কর দেখলে না আমার হেব্বি রাগ হয়, জানিস? ব্যাটা পুরুষ মানুষ হয়ে জন্মেছিস, কোথায় বুক ফুলিয়ে বলবি, হ্যাঁ রে উদিতা তোকেই দেখছি। এই ঘরে তুই আর আমি ছাড়া তৃতীয় কেউ তো নেই, স্বাভাবিকভাবে আমাকেই দেখবি। আর কাকে?

প্রত্যয়ের ফর্সা গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে। গুটিগুটি পায়ে উদিতার সামনে এসে পকেট থেকে একটা চকোলেট আর কার্ড বের করে এগিয়ে দিল তার দিকে। বলল,

-হ্যাপি বার্থ ডে ইন অ্যাডভানস, উদিতা।

উদিতা চন্দ, এলাকার নামজাদা ব্যবসায়ী রঘুবীর চন্দের একমাত্র মেয়ে। ভদ্রলোক ইদানীং নাম লিখিয়েছেন রাজনীতিতেও। শোনা যায় রঘুবীরের বাবা ফটিকলাল একসময় মাথায় ঝুরি নিয়ে ফল ফেরি করে বেড়াতো। বহু কষ্ট করে একখানা দোকান বানায় স্টেশনের পাশে। সেই থেকে শুরু হয় তার সুখের দিন। একটু একটু করে বেড়ে ওঠে ব্যবসা। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন তারা দু’দুটো আড়তের মালিক। এছাড়াও আছে গোটা চারেক ট্রাক এবং তিনখানা বাস। শহরের বাইরে গড়ে ওঠা মস্ত কোল্ড স্টোরেজটার মালিকানাও নাকি রঘুবীরের দখলে। উদিতা রঘুবীরের একমাত্র মেয়ে। কথাবার্তা, চালচলনে একেবারে বাপ কা বেটি!

প্রত্যয়ের বাবা প্রবুদ্ধ দাস আবার শান্তি প্রিয় নিরীহ স্কুলমাস্টার।  রঘুবীর আর প্রবুদ্ধ বাল্যবন্ধু।  পড়াশোনাতে গো হারা হারালেও কোনদিন খেলার মাঠে প্রবুদ্ধ পরাস্ত করতে পারেনি রঘুবীরকে।  এখনো দুই বন্ধুর হৃদ্যতা অটুট।  আজও সুযোগ পেলেই দু’জনে বসে পড়ে স্মৃতি রোমন্থনে।  কাজ কারবার নিয়ে প্রবুদ্ধর সঙ্গে প্রায়ই শলাপরামর্শ করে রঘুবীর।  কিন্তু তার পলিটিক্সে যোগদানটা মোটেই সহজভাবে নিতে পারছে না প্রবুদ্ধ।  কেবলই মনে হচ্ছে বিরাট ভুল করছে রঘুবীর।  যদিও রঘুবীর তাকে বুঝিয়েছে আজকাল পার্টিপলিটিক্সের ব্যাকআপ না থাকলে নিরুপদ্রবে ব্যবসা করা যায় না।  তবুও খচখচানিটা রয়েই যাচ্ছে প্রবুদ্ধর মনে।

উদিতার আঠারো বছরের জন্মদিন পালিত হচ্ছে বেশ ধুমধাম করেই। আত্মীয়স্বজন,  বন্ধুবান্ধব নিয়ে চলছে হৈচৈ।  বড়সড় একখানা চকোলেট কেক এনেছেন উদিতার মামা। খাওয়াদাওয়ার এলাহি আয়োজন।  চন্দননগর থেকে এসেছে রান্নার ঠাকুর।  কোলাঘাট থেকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে আনানো হয়েছে ইলিশ। শক্তিগড়ের ল্যাংচা, কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া। সঙ্গে আছে রেয়াজি খাঁসির মাংস।  দামী বিলিতি মদের পাশে প্লেটে সাজানো আছে মুরগির লেগ পিস ফ্রাই। শহরের নামী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে রুলিং পার্টির ছোট,  বড়,  মেজো নেতা সক্কলে পাত পেড়ে খেয়ে তুলেছেন তৃপ্তির ঢেঁকুর।  দোতলার কোণের ঘরে বসেছে ছেলেমেয়েদের আড্ডা। ডিজে বাজিয়ে চলছে হুল্লোড়।

আজ উদিতার জন্মদিনের পার্টিতে যাবার একটুও ইচ্ছে ছিলনা প্রত্যয়ের। অহেতুক হট্টগোল তার নাপসন্দ। কিন্তু রঘুবীরকাকা আর ফাল্গুনীকাকিমা বারবার করে বেলেছেন, তাই যেতে হচ্ছে। কতকটা সেই কারণেই যাচ্ছে প্রবুদ্ধও। বাল্যবন্ধুর মতিগতি আজকাল ভাল ঠেকছে না তারও। অর্থই অনর্থের মূল একথা শুনে আসছে আজন্ম। দু’হাতে অর্থ উপার্জন করছে রঘুবীর।  খরচও করে চলেছে দরাজ হস্তে।  লোকজনের চোখ টাটাচ্ছে তার প্রতিপত্তির বহর দেখে।  বাবা মায়ের সঙ্গে উদিতাদের বাড়িতে গিয়েছিল প্রত্যয়। তাদের দেখেই এগিয়ে এল ফাল্গুনী।

-আসুন আসুন প্রবুদ্ধদা। আসুন মাধবীদি। আরে প্রত্যয় তুমি এতো দেরিতে!  বন্ধুরা সব কখন থেকে আনন্দ করছে!

-না কাকিমা আসলে টেস্ট পরীক্ষা তো চলেই এল। তাই…..

কথাটা শেষ করার আগেই প্রত্যয়ের নজর গেল উদিতার দিকে। বেবি পিঙ্ক রঙের একটা পার্টি গাউন পরেছে উদিতা। হাতে-কানে-গলায় হালকা মুক্তোর গয়না। একদম পরীর মতো দেখাচ্ছে তাকে। মুগ্ধ হয়ে কয়েক পলক চেয়ে থাকল প্রত্যয়। ঢিপ করে একটা প্রণাম করে মাধবীর হাত থেকে উপহারটা নিল উদিতা। তারপর প্রত্যয়কে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল ওপরে। সারা ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরা। কান ফাটানো ডিজের শব্দ,  একঝাঁক পরিচিত-অপরিচিত ছেলেমেয়েদের বিকৃত রুচির নাচ, হুল্লোড় দেখে কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছিল প্রত্যয়ের। কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে থেকে শেষমেশ নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল দরজা ঠেলে।

বাড়ি ফিরে অনেকক্ষণ ছাদের ওপর দাঁড়িয়েছিল প্রত্যয়। একটা কষ্ট আচ্ছন্ন করে রেখেছে তাকে। উদিতা তার সেই ছোট্টবেলার সাথী। একসঙ্গে খেলা,  স্কুলে যাওয়া,  টিফিন খাওয়া এমন কী ছুটির দিনগুলোতেও তারা একে অপরকে না দেখে থাকতে পারত না কিছুতেই। কিন্তু আজকাল সেই উদিতাই কত্ত বদলে যাচ্ছে!  তার হাবভাব,  পোশাকআশাক,  কথাবলার ধরনধারণ সবই কেমন নতুন ঠেকছে প্রত্যয়ের। আর আজ পার্টিতে ধৃতিমানের গলা জড়িয়ে ধরে নাচ?  উফ্‌ জাস্ট ইম্পসিবল! উদিতা কি জানেনা ধৃতিমান ছেলেটা মোটেই সুবিধের নয়? একবছর আগে সরস্বতীপুজোর রাতে স্কুলের মাঠে নেশা করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল।  স্কুল থেকে প্রায় টিসি দিয়ে দেওয়ার উপক্রম হয়েছিল সেবার। নেহাৎ বাবা পয়সাওয়ালা, তার ওপর এম পি সাহেবের কাছের লোক তাই বেঁচে গেল।  কিন্তু ওর সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠতা কবে হল উদিতার? আর রঘুবীরকাকা?  সেই বা কেন উদিতাকে মেলামেশা করতে দিচ্ছে ধৃতিমানের সঙ্গে?

মনের ভেতর খচখচানিটা নিয়ে শুয়ে থাকল প্রত্যয়। অনেক চেষ্টা করেও দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে রাতে।

-প্রত্যয়, একটু দাঁড়াবি?

পেছন থেকে আহেলির গলা শুনে সাইকেলের ব্রেক চাপল প্রত্যয়। গৌতমস্যারের কোচিংয়ে আজ অ্যাবসেন্ট ছিল উদিতা। বারবার প্রত্যয়ের চোখ চলে যাচ্ছিল উদিতার বসার জায়গার দিকে। একটা অস্বস্তি চাগাড় দিয়ে উঠছিল মনের ভেতরে। পরীক্ষার আগে এভাবে পড়াশোনায় অবহেলা করা একেবারে উচিত নয়। পড়া শেষ হতেই সাইকেলটা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল প্রত্যয়। ভেবেছিল একবার ঢুঁ মেরে যাবে উদিতাদের বাড়িতে। কে জানে আবার শরীর টরীর খারাপ হল কিনা?

প্রত্যয়কে দাঁড়াতে দেখেই এগিয়ে এল আহেলি। কানের কাছে মুখটা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-বল তো আজ উদিতা আসেনি কেন?

হতবম্ভের মতো তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়ল প্রত্যয়। চোখ দুটো চকচক করছে আহেলির, ঠোঁটে লেগে আছে দুষ্টুমির হাসি।

-এ বাবা! তোকে বলেনি? আজ তো ওর ডেটিং ধৃতির সঙ্গে। একটা গোটা দিন একসঙ্গে কাটাবে ওরা। সকালে বাইক নিয়ে বেরিয়েছে দু’জন। ভাল রেস্তরাঁতে লাঞ্চ করে, ইভিনিং শো তে সিনেমা দেখে তারপর ফিরবে। কী মজা ভাব? ইস্‌ আমারও যদি ধৃতির মতো একটা বয়ফ্রেন্ড থাকত…

আহেলিকে থামিয়ে দিয়ে প্রত্যয় জিজ্ঞেস করল,

-ওর বাড়ির লোকেরা জানে এসব?

-খেপেছিস! এসব আবার কেউ বাড়িতে বলে কয়ে করে নাকি? এভাবে চুপি চুপি দেখা হওয়া, বেড়ানো এগুলোই তো প্রেমের মজা রে বোকা! তুই না একেবারে বেরসিক!

আহেলির কথাগুলো শুনে মুখের আলো নিভে গিয়েছিল প্রত্যয়ের। চারপাশের শব্দ-গন্ধ-রঙ সব ভ্যানিশ হয়ে গেল কী এক মন্ত্র বলে! মনে হচ্ছিল একটা উজার হয়ে যাওয়া শহরে একাকী পড়ে আছে সে। মাথার ওপর শুধু ভেসে আছে ধূসর রঙের একফালি মেঘ। আজ বড্ড দরকার একপশলা বৃষ্টির। প্রত্যয়ের দু’চোখ বেয়ে নেমে আসা জলের ধারার একটা ছদ্মবেশ চাই। স্বাদহীন বৃষ্টি ফোঁটার আড়ালে মুখ লুকোবে ঈষৎ নোনতা অশ্রুধারা।

সেদিনের পর আর উদিতার সঙ্গে দেখা হয়নি প্রত্যয়ের। ইচ্ছে করেই উদিতাকে এড়িয়ে চলছে সে। বৃষ্টিতে ভিজে ক’দিন সর্দি জ্বরে ভুগতে হল, তাই শরীরটাও দুর্বল হয়ে গিয়েছে খানিকটা। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে সবে পুরনো একটা টেস্ট পেপার খুলে বসেছে প্রত্যয়। এমন সময় শব্দ হল ডোর বেলের। ঠাকুমা বৈঠকখানায় বসে টিভি দেখেন এই সময়। তিনিই গিয়ে খুললেন দরজাটা। কানে এল চেনা কণ্ঠস্বর।

-ঠাকুমা, প্রবুদ্ধকাকা কোথায় গো?

-প্রবুদ্ধরা তো এখানে নেই। গতকালই গেল বহরমপুর। বউমার ভাইপোর ছেলের অন্নপ্রাশন। তা তুই হঠাৎ এ্যাদ্দিন বাদে!

-উফ্‌ কী মুশকিলে পড়লাম আমি! প্রবুদ্ধকাকা, কাকিমা, প্রত্যয় এদের ভীষণ দরকার আমার। আর এখনই ওদের যেতে হল অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন খেতে! কী যে করি?

-কেন রে? এ বাড়িতে তো আজকাল আর তোর পা পড়েনা। আজ হঠাৎ কী এমন হল? নেমন্তন্ন খেতে শুধু প্রবুদ্ধ আর মাধবীই গিয়েছে, দাদুভাই যায়নি। ওর শরীর ভাল নেই।

উদিতার মুখে দেখা গেল খুশির ঝিলিক। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,

-প্রত্যয় আছে এখানে? কোথায় ও? প্লিজ তাড়াতাড়ি বলো না ঠাকুমা।

-ওই তো নিজের ঘরে বসে লেখাপড়া করছে। যা গিয়ে দেখ।

-ইউ আর সো সুইট ঠাকুমা।

ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে গালে একখানা চুমু খেলো উদিতা। তারপর ছুটল প্রত্যয়ের ঘরের দিকে। খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে জিওমেট্রির প্রবলেম সল্‌ভ করছিল প্রত্যয়। উদিতার গলা পেয়ে কান খাড়া করে শুনছিল ঠাকুমার সঙ্গে ওর কথাবার্তা। কিছু একটা সমস্যা যে হয়েছে সেটা আঁচ করছিল মনে মনে। উদিতা ঘরে ঢুকেই ধপ্‌ করে বসে পড়ল খাটের ওপর। মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল,

-খুব প্রবলেমে পড়েছি রে প্রত্যয়। তোর হেল্প চাই।

বিছানায় উঠে বসে কিছুক্ষণ উদিতাকে মাপল প্রত্যয়। তারপর বিদ্রূপের স্বরে বলল,

-কেন? কী হল আবার? ধৃতি ল্যাং মেরেছে? নাকি হিন্দি সিনেমার স্টাইলে তোকে প্রেগন্যা…

-এক ঝাপর মারব শালা! আমি মরছি নিজের জ্বালায়, আর উনি হিন্দি সিনেমা মারাচ্ছেন!

উদিতার মেজাজ দেখে বোমকে গেল প্রত্যয়। নিশ্চয়ই সিরিয়াস কিছু হয়েছে। গলাটা গম্ভীর করে বলল,

-আরে আমি তো মজা করছিলাম, বল কী প্রবলেম তোর?

-প্রবলেমটা আমার নয়, বাবার। পার্টির ওপর তলা থেকে বাবার নাম রেকমেন্ড করা হয়েছে জেলার কোর কমিটির সদস্য পদের জন্যে। কিন্তু কমিটির সেক্রেটরি ভবানী ভট্‌চাজ কিছুতেই এটা মানতে পারছে না। সে বাবাকে শত্রু মনে করে আগাগোড়া। বাবা কমিটিতে এলে তার সমস্যা বাড়বে। তাই মরিয়া হয়ে গিয়েছে বাবাকে আটকানোর জন্যে। গোপনে ষড়যন্ত্র করে উস্কানি দিয়েছে লেবার ইউনিয়নের সেক্রেটরি অমিত ঘোষালকে। গত দু’দিন থেকে আড়ত, কলস্টোরেজে চলছে হরতাল। বাস-ট্রাকের ড্রাইভার, খালাসীরাও যোগ দিয়েছে তাদের সঙ্গে। বাবার কোনও কথাই শুনছে না। পার্টির অন্য নেতারাও এড়িয়ে চলছে বাবাকে। ভবানী ভট্‌চাযকে কেউই চটাতে চায় না। নিরুপায় হয়ে বাবা ফোন করেছিল প্রবুদ্ধকাকাকে। অমিতদা প্রবুদ্ধকাকার ছাত্র। যদি তার কথায় আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হয়, এই ভেবে। কিন্তু প্রবুদ্ধকাকার ফোন কিছুতেই লাগছে না। তাই আমি ছুটে এলাম এখানে। জানিসই তো বাবার হাই প্রেশার, তার ওপর এই টেনশন! বড্ড চিন্তা হচ্ছে রে বাবার জন্যে।

-আসলে আমার মামাবড়ি তো গ্রামে। ওখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক প্রায়ই থাকে না। তাই লাইন পায়নি বোধ হয়। ঠিক আছে আমি মা অথবা বড়মামার নম্বরে ফোন করে জানিয়ে দেব ঘটনাটা।

উদিতার ম্লান মুখ দেখে কষ্ট হল প্রত্যয়ের। উদিতা তাকে যতই হ্যাটা করুক না কেন, প্রত্যয়ের মনের সবটুকু জুড়ে থাকে উদিতাই। সমস্যাটা মোটেও হ্যালাফেলা করার নয়। শ্রমিক নেতা অমিত ঘোষাল মানুষটা ভীষণ রগচটা আর ভবানী ভট্‌চায গভীর জলের মাছ। রঘুবীরকাকা ভাল করেই চেনে এদের। চিন্তা হওয়াটা স্বাভাবিক। সন্ধে নাগাদ ফোন এল উদিতার। যেটা ভয় ছিল সেটাই হয়েছে। বুকে প্রবল ব্যাথা হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে রঘুবীরকে। খবরটা পেয়েই সাইকেল নিয়ে ছুটল প্রত্যয়। কথা বলল ডাক্তারের সঙ্গে। একটা ব্লকেজ ধরা পড়েছে হার্টে।

বড্ড ভেঙে পড়েছে ফাল্গুনী, উদিতাও হতবাক। একসঙ্গে হুট করে এতগুলো বিপদ এসে পড়ায় দিশেহারা সকলে। প্রত্যয় এসে সামলে নিল খানিকটা। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করা, প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে ওষুধ আনা, রাত জাগা সব করল নিয়ম করে। অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন কাটছাঁট করে ফিরে এল প্রবুদ্ধ আর মাধবীও। অমিত ঘোষালকে নিয়ে বসল আলোচনায়। প্রবুদ্ধর আশ্বাস পেয়ে স্ট্রাইক থেকে বিরত হল শ্রমিকরা। রঘুবীরও সুস্থ হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ঘরে ফিরল রঘুবীর। বাড়ির প্রত্যেকটা লোক কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ল প্রবুদ্ধ আর প্রত্যয়ের সামনে।

শরৎ বিদায় নিয়েছে বেশ কিছুদিন হল। সন্ধের পর থেকেই আচ্ছন্ন করে রাখে হালকা ঠাণ্ডার অনুভূতি। আর তিন দিন পরেই শুরু হচ্ছে উচ্চমাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা। আজ গৌতম স্যার বিকেলে একবার ডেকেছিলেন প্রত্যয়দের, লাস্ট মিনিট সাজেশনের জন্যে। সন্ধের মুখে স্যারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রত্যয় আর উদিতা সাইকেল নিয়ে হাঁটছিল পাশাপাশি। উদিতা এখন অনেক শান্ত। পরিবারের ওপর আচমকা নেমে আসা বিপদ অনেকটা পরিণত করেছে তাকে। অকারণ হৈ চৈ, হুল্লোড়ে মেতে থাকে না আর আজকাল। প্রত্যয়কেও আর অবজ্ঞা করেনা আগের মতো। নিরিবিলি পথ ধরে হাঁটছিল তারা। স্তব্ধতা ভেঙে উদিতাই কথা বলল প্রথমে,

-একবার ঝিলের ধারে যাবি প্রত্যয়? অনেকদিন যাইনা ওদিকটায়। অবশ্য যদি তোর হাতে সময় থাকে তবেই।

প্রত্যয় একপলক দেখল উদিতাকে। বলল,

-চল, ঘুরে আসি। এমন কিছু দেরী হয়নি এখনও।

দু’জনে সাইকেল নিয়ে চলে এল ঝিলের পাশে। স্থানীয় লোকেরা একে বলে দুধ সায়র। কেন এর নাম দুধ সায়র সেটা অবশ্য সঠিক জানেনা কেউই। শহরের বাইরে বিরাট এলাকা জুড়ে রয়েছে এই ঝিল। চারপাশে সবুজ ঘাসের মাঠ আর গাছপালা। আগে জায়গাটায় সমাজ বিরোধীদের আড্ডা বসতো। কিন্তু সম্প্রতি প্রশাসন থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেছে চারদিক। নিরাপত্তারক্ষী, আলোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বিকেল হলেই অনেক মানুষ ভিড় জমায় এখানে।

একটা ফাঁকা জায়গা দেখে সাইকেল স্ট্যান্ড করে বসল প্রত্যয় আর উদিতা। কিছুক্ষণ চুপ করে দু’জনেই চেয়ে রইল ঝিলের স্বচ্ছ জলের দিকে। আচমকা উদিতা বলে উঠল,

-আমি যে কী পরীক্ষা দেব কিছুই বুঝতে পারছিনা। সারা বছরটা দেদার ফাঁকি দিয়েছি। ভেবেছিলাম পরীক্ষার আগে মেকআপ দেব। কিন্তু বাবার অসুস্থতা, হঠাৎ করে চলে আসা এই বিপদ আমাকে অনেকটা পিছিয়ে দিল। পড়াশুনাতে কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিনা রে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রত্যয় বলল,

-অতো চিন্তা করিস না, এটা তো টেস্ট। ফাইনালের আগে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখনও প্রিপারেশনের অনেকটা সময় আছে।

-কিন্তু এই অল্প সময়ে এতো বড় সিলেবাস, প্রজেক্ট ওয়ার্ক, প্র্যাক্টিকাল সব শেষ করতে পারব আমি?

-ঠিক পারবি। তুই টেনশন করিস না। আমি তো আছি। তোর যা হেল্প লাগবে বলবি, আমি সাধ্য মতো চেষ্টা করব তোকে সাহায্য করার।

প্রত্যয় আশ্বস্ত করল উদিতাকে। প্রত্যয়কে অবাক করে তার গা ঘেঁষে বসল উদিতা। ধরা গলায় বলল,

-তোকে যে কী বলে থ্যাংকস জানাব আমি জানি না রে। যেভাবে তুই বিপদের দিনে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিস, সেভাবে আর কেউ আসেনি। এমনকি ধৃতিও না। অথচ তোকে কত হ্যাটা করেছি আমি, বল? তোর ঋণ শোধ করতে পারব না কোনোদিনও।

-ধুর পাগলি! ঋণ আবার কী? বিপদের সময় বন্ধুরাই তো বন্ধুদের পাশে থাকে। তোর যেকোনো প্রয়োজনে আমি সবসময় তোর পাশে থাকব, প্রমিস।

হাসি মুখে কথাগুলো বলল প্রত্যয়। কিন্তু উদিতার মুখে হাসি নেই। একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা ঘিরে আছে তাকে। দু’চোখ ভরে আছে জলে। প্রত্যয়ের বাঁহাতটা নিজের মুঠিতে শক্ত করে ধরল সে। তারপর প্রত্যয়ের কাঁধে মাথা রেখে বলল,

-এভাবেই সবসময় আমার সঙ্গে থাকিস প্রত্যয়। বড্ড ভরসা করি রে তোকে।        

উদিতার নরম শরীরের স্পর্শে তিরতির করে কাঁপছে প্রত্যয়। একটা অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি পাক খাচ্ছে তার পেটের ভেতরে। সেই ছোটবেলা থেকে যে উদিতাকে সে মনে মনে ভালবেসে এসেছে, সেই উদিতা আজ নাচাইতেই এভাবে ধরা দেবে তার কাছে, এতটা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেনি।

বাবার অসুস্থতার কারণে টেস্ট পরীক্ষা নমোনমো করে দিয়েছিল উদিতা। কিন্তু প্রত্যয়ের কাঁধে ভর দিয়ে ফাইনাল পরীক্ষার বৈতরণী সে পার করল ভালভাবেই। সাজেশন মিলিয়ে প্রশ্নের উত্তর লিখে দেওয়া, যত্ন করে প্র্যাকটিক্যাল খাতা তৈরি, নিজের পড়ার সময় কমিয়ে উদিতাকে সবটাই প্রত্যয় করে দিয়েছিল ভালবেসে। গতকাল শেষ হয়েছে পরীক্ষা। ড্রয়িং রুমের সোফায় একবাটি পপকর্ন হাতে নিয়ে বসেছে উদিতা। দু’চোখ স্থির টেলিভিশনের পর্দায়। হঠাৎই পিং শব্দ করে মেসেজ ঢুকল পাশে রাখা মোবাইল ফোনে। আড় চোখে দেখল উদিতা। ধৃতির মেসেজ। ফোনটা অন করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল,

-এগজ্যাম ওভার। ইটস্‌ টাইম ফর সাম রিফ্রেশমেন্ট বেবি! কাল একটা ডিনার ডেট প্ল্যান করেছি। ড্রিম হাউস রেস্তোরাঁতে বুক করে ফেলেছি টেবিলও।

-ওয়াও! দারুণ আইডিয়া।

ধৃতির মেসেজের উত্তরে লিখে ফেলল উদিতা। ওপাশ থেকে আবার মেসেজ এল,

-অনেক হল প্রেম প্রেম খেলা। নাউ সে গুড বাই টু দ্য ফুলিশ বয়।

-সে আর বলতে? আসলে প্রত্যয় আমার ছোটবেলার বন্ধু। কানামাছি, লুকোচুরি, রুমালচোর, মিছিমিছি বর-বউ সেজে রান্নাবাটি, এসব অনেক খেলেছি ওর সঙ্গে। তাই ভাবলাম এই খেলাটাই বা বাদ যায় কেন?

কি প্যাডে আঙ্গুল চালিয়ে দ্রুত শব্দগুলো টাইপ করল উদিতা। সঙ্গে জুড়ে দিল কয়েকটা স্মাইলি। ফোনের পর্দায় ভেসে উঠল তিন চারটে হলুদ রঙের মুখ। রঘুবীর যেমন বারবার প্রবুদ্ধকে হারিয়ে দিত খেলায়, আজ তেমনই উদিতার কাছে প্রেমের খেলায় হেরে গিয়েছে প্রত্যয়। আর উদিতার এই জয় উদযাপন করছে বিকৃত চেহারার ওই মুখগুলো। এরাই আজকের বিজয়োৎসবের চিয়ার লিডার। কারও বেরিয়ে আছে জিভ, তো কারও দাঁত। কেউ কেউ আবার ফেটে পড়ছে অট্টহাসিতে।

…………………. দেবপ্রিয়া সরকার