ভেষজ উদ্ভিদ হিমালয় পর্বত শ্রেণি এবং সংলগ্ন অঞ্চলগুলিতে স্বাভাবিক উদ্ভিদ হিসেবে জন্মায়। এ অঞ্চলে অনেক প্রজাতির ভেষজ জন্মায়। ভেষজ সম্বন্ধে একটি কথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে— চিনলে জড়ি, না চিনলে খড়ি। অর্থাৎ চিনলে ভেষজ হিসেবে সব উদ্ভিদই জড়ির মত মূল্যবান। কিন্তু না চিনলে তা নিছক খড়ি বা জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কোচবিহারের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। কোচবিহার জেলায় ভেষজ উদ্ভিদ বাড়ির আশপাশে,জঙ্গলে এমনিতেই পাওয়া যায়। ঐগুলির বাণিজ্যিক চাষ কোনও কালেই হয় নি। রাজ আমলে কোচবিহার শহরে কবিরাজী বাগান গড়ে তোলা হয়েছিল। দুঃখের বিষয় মূল্যবান ভেষজ সমৃদ্ধ বাগানটি এখন বাদুড় বাগান নামে পরিচিত। আশেপাশের মানুষরা এখানে বর্জ্য ফেলে। বাগানটির অনেক অংশ জবরদখল হয়ে গেছে। মূলত দাতব্য কবিরাজখানার ভেষজ যোগাতে এই বাগানের সৃষ্টি। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় এখানে ১৭টি প্রজাতির বৃক্ষ সহ ৪০ প্রজাতির ভেষজ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়া জেলার দু একজন কবিরাজ বিচ্ছিন্নভাবে নিজেদের প্রয়োজনমত ভেষজ রোপন করেছে। দিনহাটায় এরকম এক বাগান ছিল। হলদিবাড়িতে ডাক্তার অরুণ নিয়োগীর বাড়িতে ভেষজ বাগান আছে। অনেক বাড়িতে ‘চাঁদো ভাদো ঈশর মূল’ পাওয়ার জন্য এক দুটি গাছ লাগানো হয়। কিন্তু বাণিজ্যিক চাষ কেউ করে নি। কবিরাজরা জঙ্গল থেকে প্রয়োজনমত ভেষজ সংগ্রহ করেন তা যাতে অন্য কেউ জানতে না পারে সেই চেষ্টা করেন। পাছে তাদের ওষুধের ফর্মূলা অন্যে জেনে যায়— এটাই আশঙ্কা।
ভারতে আবহমানকাল থেকে নিম,তুলসী,চন্দন,বাসক,সর্পগন্ধা,ঘৃতকুমারী,পিপুল,বচ,হরিতকি,বহেড়া,আমলকি,নিশিন্দা,হলুদ সহ প্রচুর প্রজাতির উদ্ভিদ ভেষজ হিসেবে ব্যবহূত হয়। আয়ুর্বেদের উৎসভূমি ভারত পুরোপুরি প্রাকৃতিক উৎসকে ওষুধ হিসেবে কাজে লাগায়। কোচবিহারে আয়ুর্বেদ চর্চার সেই ঐতিহ্য আছে। রাজ কবিরাজ বিরজাকান্ত গুপ্ত এখানে ‘বনৌষধি দর্পন’ রচনা করেছিলেন। জেলার গ্রামগুলিতে গাছগাছড়ার গুণাগুণ জামা মানুষের অভাব নেই। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে ভেষজের চাষ ও ভেষজ সম্বন্ধে জনসাধারণের মধ্যে সেরকম সচেতনতা আজও গড়ে ওঠে নি। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা এর বিপণন। আবাদ করার পর কোথায়,কীভাবে বিক্রি করা যাবে,দাম কীরকম পাওয়া যাবে এ সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের কোনও ধারনা নেই। বিপণনের সেরকম কোনও প্রতিষ্ঠানও নেই। রাজ্যের বর্তমান মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ভেষজ বিপণনের সাথে যুক্ত। তবে মন্ত্রীত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর এদিকে অনেকটা ভাটা পড়েছে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে যারা ভেষজ সংগ্রহ করে তাদেরও এর চাষ সম্বন্ধে সচেতনতা নেই। এমনকি তারা ভেষজের প্রয়োজনীয় অংশ ছাড়াও অপ্রয়োজনীয় অংশ,পারলে সমূলে ভেষজ তুলে নিয়ে যায়। এভাবে কত ভেষজ হারিয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই বন-জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপণ,চাষের জমি বাড়ানোর ফলে আগাছা হিসেবে চিহ্নিত বীরুৎ ও গুল্ম জাতীয় ভেষজগুলি জন্মানোর জায়গা নেই। অথচ এই আগাছাই কত রোগের উপশম করতে পারে। এ অঞ্চল থেকে অনেক ভেষজ নিয়ে গিয়ে বিদেশের ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করে অনেক ওষুধ প্রস্তুত হচ্ছে। তার পেটেন্ট নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আমরা অনেক পরে জানতে পারছি। নিম আর হলুদের পেটেন্ট নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য ভেষজের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে কে জানে? বন দপ্তর সক্রিয় হলে মাঝে মাঝে এরকম বস্তা ভর্তি ভেষজের অবৈধ পাচার ধরা পড়ে এবং সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই।
বামফ্রন্ট আমলে শীতলকুচি ব্লকের ছোট শালবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতে কান্তেশ্বর রাজার গড়ের পাশে বিশাল ভেস্টেড জমিতে ৫ কোটি ৬০ লক্ষ টাকার ভেষজ উদ্যান তৈরি,ভেষজ নির্যাস নিষ্কাশন ও বাজারজাত করার প্রকল্প প্রস্তাব রূপে বিধায়কের মাধ্যমে রাজ্য সরকারের কাছে যায়। সেখান থেকে প্রস্তাবটি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠানো হয়। রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনায় ৮০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে জেলা পরিষদে পাঠানো হয়। তার আগেই ঐ স্থানে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের মাধ্যমে মিঠা তুলসী,অশ্বগন্ধা,শতমূল ইত্যাদি ভেষজ রোপন করা হয়। ফলাফল সন্তোষজনকই ছিল। এর মধ্যেই রাজ্যে ক্ষমতা বদল হয়। নতুন সরকারের আমলে ৮০ লক্ষ টাকার মধ্যে ৪০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে প্রায় ৪০ বিঘা জমির চারপাশে প্রাচীর দেওয়া হয়। সাথে সাথে ঐ স্থানে কয়েকটি নার্সারি স্থাপণ করা হয়। কাজ আর এগোয় নি।
ঐ ব্লকের গোঁসাইরহাটে পুরুষোত্তম ফার্মার্স প্রোডিউসার অর্গানাইজেশনের ৫/৬ জন বাড়ির আশেপাশে,অন্যান্য ফসলের ক্ষেতের পাশে ছোট ছোট জমিতে তুলসী,মিঠা তুলসী, থানকুনি ইত্যাদির চাষ শুরু করে। সাথে লেবু ও হলুদ মিশিয়ে তারা ইতিমধ্যে এক ধরণের চা প্রস্তুত করে বাজারজাত করেছে। এতে করোনার আবহে ভালই সাড়া পাওয়া গেছে। তারা মেথি চা,অশ্বগন্ধা চাও প্রস্তুত করে বাজারজাত করেছে। এ কাজে তাদের সাথে সহযোগিতা করছেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী গৌতম কুমার সাহা।
২০১৬ সালে রামকৃষ্ণ মিশনের সহযোগিতায় বঙ্গীয় আয়ুর্বেদীয় মহাসংঘ দিনহাটায় ভেষজের উপর একদিনের কর্মশালার আয়োজন করেছিল। সেখানে মিশনের পক্ষ থেকে আয়াপান চাষে উৎসাহ দেওয়া হয়। তারাই উৎপন্ন আয়াপান কিনে নেবেন বলে জানান। কিন্তু এখানে আয়াপান চাষে উৎসাহ দেখা যায় নি।
উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি সরকারি প্রকল্পে বিভিন্ন ক্লাবের মাধ্যমে ভেষজ চাষ শুরু করে। কিন্তু তা কতখানি সফল হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
তুফানগঞ্জের নাটাবাড়ি বি পি এইচ সি-এর সিনিয়র আয়ুর্বেদিক মেডিকেল অফিসার ডা বাসব কান্তি দিন্দা তুফানগঞ্জ-১ ব্লকের শিক্ষক,শিক্ষাকর্মী,স্বাস্থ্যকর্মীদের সহযোগিতায় ‘তুলসী সুরক্ষা’ ও‘ভেষজ সুরক্ষা’ নামে সচেতনতা,ভেষজ রক্ষা, জৈব বৈচিত্র্য রক্ষা ও ভেষজ চাষকে আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। ইতিমধ্যে ১০০০টি ছোট ছোট ভেষজ বাগান তৈরি করা সম্ভব হয়েছে বলে
তিনি দাবি করেছেন। মূলত বাড়ি বা বিদ্যালয়ের ফাঁকা জায়গায় এইসব বাগান গড়ে উঠেছে। পরে সরকারিভাবে তার এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।এবার ঐ ব্লকে ৮১টি বিদ্যালয়,৪টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ১টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে আড়াই কাটা করে জমিতে ভেষজ বাগান তৈরি হচ্ছে।তুফানগঞ্জের এই ব্লকে ভেষজ চাষের এই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হচ্ছে।
বঙ্গীয় আয়ুর্বেদীয় মহাসংঘ ৫০ জন চিকিৎসক-উৎপাদকের তালিকা সহ ভেষজ চাষ প্রকল্পের পরিকল্পনা তৈরি করে এক বছর আগে উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেয়। তাদের পরিকল্পনা ছিল ঐসব উৎপাদকরা যে ভেষজ চাষ করবে তার বিপণন যদি নাও হয় অন্তত নিজেরা সারা বছর ধরে সেসব চিকিৎসার কাজে লাগাতে পারবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখনও তারা আশাব্যঞ্জক কোনও সাড়া পায় নি।
কেন্দ্রীয় সরকার আয়ুশ মন্ত্রণালয় গঠণ করেছে। ন্যাশনাল মেডিসিনাল প্ল্যান্টস বোর্ড ও পশ্চিমবঙ্গ স্টেট মেডিসিনাল প্ল্যান্টস বোর্ড আছে। পার্শ্ববর্তী আলিপুরদুয়ার জেলার তপসিখাতায় আয়ুশ হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। এখন ভেষজের চাহিদা সারা পৃথিবীতেই বাড়ছে।
স্টেট মেডিসিনাল প্ল্যান্টস বোর্ডে জেলার তিনটি ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা নথিভূক্ত আছে। এগুলি হল— ১) বংশী আয়ুর্বেদ রিসার্চ অ্যান্ড কোং, কালীঘাট রোড,কোচবিহার। ২) সোলেস হারবাল প্রোডাক্ট প্রা লি ,চকচকা শিল্পকেন্দ্র। ৩) মুশুরু বৈদ্য আয়ুর্বেদিক মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রিজ,নলঙ্গিবাড়ি,নিশিগঞ্জ। প্রথমটি মলম তৈরি করে। দ্বিতীয়টি ওষুধ তৈরি করে। তৃতীয়টি হাড়ভাঙ্গার চিকিৎসা করে। ভেষজ চাষ তারা করে না।
ঐ বোর্ডে নথিভূক্ত ভেষজ সংগ্রাহক দক্ষিণ মরাডাঙ্গার রতন সরকার,ভেষজ চাষি ভেলাকোপার রবিউল হক ও নৃপেন বর্মন এবং তুফান চামটার সুভাষ চন্দ্র বোস। কিন্তু তাদের নথিভূক্ত ফোন নম্বরে ফোন করলে হয় দেখা যায় ঐ নামের কাউকে তারা চেনে না অথবা ঐ নম্বরের অস্তিত্বই নেই। তাদের আদৌই কোনও চাষ আছে কিনা তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ আছে।
এই অর্থিক সম্ভাবনাময় উদ্ভিদ চাষে যে সচেতনতার কাজ বেসরকারী উদ্যোগে শুরু হয়েছে তা জেলা আয়ুশ দপ্তর সক্রিয়ভাবে গ্রহণ ও বিপণনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা করতে পারলে একদিন ভেষজ চাষে জেলায় সোনালি দিন আসবে। তবে এর জন্য আন্তরিক প্রয়াস প্রয়োজন।
……………….. অভিজিৎ দাশ