কেন পড়বো বর্ণপরিচয়

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত বর্ণপরিচয় বাংলা বর্ণ,অক্ষর ও বানান বিধি শিক্ষার প্রাথমিক এক পুস্তিকা l শুধু এইটুকু বললে কিন্তু বর্ণপরিচয়ের পরিচয় অসম্পূর্ণই থেকে যায় l শিশুর চরিত্র গঠনে এটি একটি অত্যাবশ্যক পাঠ l যেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে শিশু সহজ সরল সত্যের সাথে জীবন যাপনের মূল্য ও বোধকে আনন্দের সাথে হৃদয়ঙ্গম করে l তবে কি শুধুই শিশু শিখবে? শিশু তো দেখে শিখতে বেশী পছন্দ করে l তাই শিশুর বর্ণপরিচয় পাঠের সাথে সাথে অভিভাবককেও বর্ণপরিচয়ের চর্চা চালিয়ে যেতে হবে জীবনভোর l বর্ণপরিচয়ের সার্থকতা এখানেই l প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটা আদর্শকে পরম্পরায় বয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুশীলনী l একদিকে জন্মের পর শিশু যেমন মাতৃভাষা বাংলাতে বলতে থাকা তার মুখের শব্দ গুলোকে “বর্ণপরিচয়”-এ প্রথম বর্ণের আকারে চিনতে শেখে, তেমনই এই “বর্ণপরিচয়”-এর পাঠ শিশুদের মনের মধ্যে ছবির মতো ফুটিয়ে তোলে সত্য-মিথ্যে, ভালো-মন্দের একটা স্পষ্ট ধারণা l যেখান থেকে সূচনা হয় শিশু চরিত্রের গঠন ll

শিশু-শিক্ষার্থে শিশুর কি কি গুণ আহরণ করা আর কি কি বদভ্যেস পরিত্যাগ করা উচিত তা নিয়েই “বর্ণপরিচয়”-এ ছোটো ছোটো নীতি গল্পের পাঠ পড়িয়েছেন বিদ্যাসাগর মহাশয় l সেই সব পাঠে গোপাল, নবীন, গিরিশ, রাম, যাদব,মাধব, সুরেন্দ্র, রাখাল এদের গল্প বলে ভালো ছেলের সাথে খারাপ ছেলের গুনগত, চরিত্রগত, চিন্তা- চেতনাগত, স্বভাবগত ও আচরণগত পার্থ্যক্য যেমন সুস্পষ্ট করেছেন ; তেমনই খারাপ থেকে ভালো হওয়ার উত্তরণের পথও বাতলে দিয়েছেন – যেন এক আলোয় ফেরানোর  দিশারী l আবার যারা ব্যক্তিজীবনে সেই উত্তরণের পথকে গ্রহণ করতে পারে নি তাদেরও ভবিষ্যতের করুণ পরিণতি ফুটিয়ে তুলেছেন সেই সব গল্প কথায় l আজকের শিশু কালকের অভিভাবক l তাই শিশুবেলা থেকে  বর্ণপরিচয়ের শিক্ষাকে  আত্মস্থ করার পাশাপাশি অভিভাবক হয়েও সেই শিক্ষার চর্চা চালিয়ে যেতে হবে নিরন্তর l ভুবন আর তার মাসির গল্প দিয়ে বাস্তবে অভিভাবকদের চরিত্র শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে কেমন হওয়া উচিত তা শিখিয়ে গেছেন ll

“বর্ণপরিচয়” শিক্ষা দেয় মান আর হুঁশ নিয়ে বাঁচার, জীবনের আসল বোধের l যে বোধের প্রকাশে ঘটে মানুষের প্রকৃত আত্মবিকাশ l

অল্প পরিসরে বৃহৎ এই আলোচনাকে সংক্ষেপে বলতে গেলে পরিশেষে এ কথা বলতেই হবে যে বর্ণপরিচয়ের পাঠ নিজে পড়ুন, বাচ্চাদের শোনান, পড়ান, বাড়ির বড়দের সামনে পূজার মন্ত্রের মতো ঘরে নিয়মিত পাঠ করতে থাকুন যাতে রোজ রোজ তা সকলের কানে পৌঁছায় l বারবার শুনতে শুনতে যেভাবে কোনো লঘু কথাও জনপ্রিয় হয়, মুখে মুখে ঘোরে ফেরে, সেরকমই ভালো কথা গুলো বার বার কানে শুনতে শুনতে একদিন হৃদয়ে গিয়ে বাজবেই মান আর হুঁশ থাকা মানুষের l

সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ যেদিন এই “বর্ণপরিচয়” এর পাঠকে আত্মস্থ করে আবার সহজ সরল সত্য জীবনে একে অপরের হয়ে বাঁচতে শুরু করবেন সেদিন আর সংখ্যালঘু মুষ্টিমেয় কিছু খারাপ মানুষের কুকর্ম রক্তবীজের মতো সমাজের সর্বত্র মানুষের মজ্জায়- চিন্তায়- চেতনায় ছড়িয়ে পড়তে পারবে না l কি হবে? কম খাবো,কম পড়বো; কিন্তু মনের শান্তিতে আনন্দে আর নিজের প্রতি নিজের সম্মান বোধ নিয়ে তো মাথা উঁচু করে বুক চিতিয়ে বাঁচবো l এটাইতো আসলে মানুষের অন্তর প্রকৃতি, অথচ তার বিকৃতি ঘটিয়ে আজ আমরা চাইছি কৃত্রিম ভাবে যেন তেন প্রকারে ভালো থাকতে l তাইতো আমরা বেঁচেও যেন বাঁচছি না l নিয়ত ধুঁকছি – আর শুধু নিজে বা নিজেরা ভালো থাকতে চেয়ে নিরন্তর আরো খারাপ থাকছি l তাই “বর্ণপরিচয়” এর হাত ধরে শিশুর শিক্ষার আদর্শ পথ চলা শুরু হোক ll