এই নিরালায়      

“আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে…”

অতীন্দ্রিয় এক সুখ অথবা নির্ভুল বেদনার পূর্ণ বিষভান্ড মানুষের মনের ক্ষেত্রভূমিতে জেগে ওঠে প্রতিদিনের সংসারে l মনের স্তরে স্তরে মেঘের চাদর ছিঁড়ে জ্যোৎস্না জেগে ওঠে অবলীলায় l
দুর্বল মানুষের চেতনার কানায় কানায় মস্ত বড় মহান ভুল ঠিক তখনই হয় l যেহেতু সেই অপূর্ব আলোয় মায়াবীমনে সত্যের বোধ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, ঠিক তখন সকলেই ছোটে পূর্ণ উদ্যমে সেই মায়াবী জ্যোৎস্নারাতের বনে l সে এক অলীক বন, মিথ্যের অপূর্ব রূপময় অযোগ্য এক মায়ার ছায়া ফেলে ঘিরে ধরে দুর্বল মনকে l সেই জ্যোৎস্নাবনেই লুকিয়ে থাকে মৃত্যুর ব্যথা, জীবনের অনাদর, প্রাচুর্যশূন্য আত্মার কান্না l কেবলই নির্বুদ্ধিতায় ভোগের উপচার সংগ্রহ করে চলি আমরা সাধারণ মানুষেরা,  ভাবি এই গহীন বনের মুগ্ধ আলো বুঝি জীবনের চরম সত্য l ভুল একমাত্র ধরা পড়ে কেবল কবির চোখে l
তিনি মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে পরিত্যাগ করেন সেই বাতাবরণ l সকলের চোখে যা প্রমাণিত সত্য আলো, সেই আলো কবির কাছে মিথ্যে এক রুগ্ন রুগীর আঁধারের রোগশয্যার মতো হয়ে ওঠে l তিনি তখন ভুলেও সমীরণের মাতাল রূপের কাছে ধরা দেন না আর l সকলের ছুটে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে অন্য পথ খোঁজেন মনের নিরালায়,একান্ত উন্নত সাধনায় l

‘সবাই যেখানে যাবে অনাগ্রহে অথবা সাগ্রহে ,কেন তিনি যাবেন না সেখানে ‘?
এই দুর্দান্ত প্রশ্ন কবির গভীরে জেগে উঠেছিল শিশুকাল থেকে l তাই এই গান তাঁরই গান, আমরা গেয়ে বেড়াই l
বসন্ত তো আবরণ দিয়ে ঘিরে ফেলে, সেখানে দুঃখের ওজন শূন্য, সুখেরও হদিস নেই, কেবলই অগভীর মনের উৎসবপ্লাবন l সকলেই তুমুল ভেসে যাই বহিরাগত হাসি অথবা কান্নার ঘটনায় l একমাত্র কবিই ধরে ফেললেন জ্যোৎস্নার আলো ও সমীরণের এই মাতলামি l
কবি কিন্তু নস্যাৎ করছেন না কখনও একে, অথচ মিথ্যে এই রূপের সহযোগিতা নিয়ে, নিজের পরম প্রার্থিত নিরালা আসনটিকে ধ্রুবরূপে পেতে চাইছেন আমৃত্যু l

“আমার এ ঘর বহু যতন করে ধুতে হবে মুছতে হবে …”

কবি নিজেকে অন্তরালে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রমশঃ l সুপ্ত নাছোড়বান্দা ছোট্ট এক দাবী নিজের অধিদেবতার কাছে পূর্ণ প্রণামের ভঙ্গিতে চাইছেন তিনি l পরমেশ্বরকে মনে করাতে চাইছেন নিজের সবটুকু ভালোবাসার ও সত্যের হৃদয়জ্ঞান একান্ত যে তাঁর সংগ্রহ নয়,সেই নিরহংকার রূপটিকে চাইছেন দেখাতে নিরালায় বসে l কারণ কবি জানেন, জগৎসংসারের এই জ্যোৎস্নার বনে বসন্তের হাওয়া তাঁরই সৃষ্টি l সেই আলো ও ঋতুর কর্মের ফলাফল কবি দেখছেন সহজ অবোধ মানুষের মনে l কবির একান্ত অনুনয়ে শুধু চাইছেন , নিজেকে সেই পরম শ্রেষ্ঠ উৎসের কাছে নিজের ভাবনার চিরন্তন সত্যে যেন ব্রহ্মজ্ঞানের কোমল স্পর্শ এসে পড়ে l
কবি নিজের অন্তরের ক্ষেত্রটিকে মেজে ঘষে গোছাতে চাইছেন প্রাণপণ, শুধুমাত্র অলস ও অতৃপ্তির জড়চেতনা থেকে পূর্ণ উদ্যমে জেগে ওঠার লোভে l
কী হবে কবির এই জেগে ওঠায় ?  সে তিনিই জানেন সব l
নিঃস্বার্থ দানের পূর্ণ ভান্ডার খুলেছে যে অসীম প্রকৃতি কবির ভুবনে, সেই প্রকৃতির কাছে কবি হয়তো পৌঁছতে চাইছেন এই নিরালার কেন্দ্রস্থলে l
মনুষ্যজীবনের প্রবল দুঃখের সুর যেখানে অস্থির বেজে ওঠে, রাগরাগিনীতে তাকেই বাঁধতে হয়তো চাইছেন কবি l অসামান্য অধিকারবোধ জাগিয়ে সেই আপন নিরালার কাছে কবির বীণাখানি জেগে উঠছে অমৃতের অনুভবে l সত্যের সিংহদ্বারে প্রবেশের পূর্ণ একচ্ছত্র অধিকার পেতে।
এইটুকুই হয়তো কবির প্রার্থনা এই গানে l