বিরক্তি উগড়ে দিয়ে টিভির ভ্রষ্টাচার-পাঁচালী বন্ধ করে দেয় অচিন্ত্য। মুহূর্তে দশ বছরের পুরনো পোর্টেবল টিভিটার মুখ ঢেকে যায় অন্ধকারে। কালো টিভি স্ক্রিনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে থাকতে অচিন্ত্যর যেন ঘোর লাগে। মনে হয় ঐ নিকষ অন্ধকার যেন টিভির পর্দায় নয় সমস্ত পারিপার্শ্বিক জুড়ে নেমে এসেছে। পুরো সমাজটাই যেন পচে যাওয়া সিস্টেম,ঘূণে খেয়ে ফেলা মূল্যবোধ, আদর্শ, নীতিহীন রাজনীতির চরম পরাকাষ্ঠা সমেত টাইটানিক জাহাজের মত অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে কোথাও যেন একবিন্দু আশার আলো নেই। সেই গানের লাইনটা হঠাৎ মনে পড়ে যায় অচিন্ত্যর ” নাই, নাই এ আঁধার থেকে ফেরার পথ নাই…”।
সত্যিই কী সব আলো মুছে গেছে! আলোয় ফেরার কোনও পথই কী নেই? তা কী করে হয়! আফসার’দা যে বলতেন,” সব পথ বন্ধ হলেও একটি পথ অন্তত খোলা থাকবেই। সেই পথ খুঁজে নিতে হবে… ” । কোথায় সেই পথ আফসার দা? আমি যে কোনও পথই খুঁজে পাচ্ছি না। নাকি আমি দিশা হারিয়েছি। অন্ধকারে অন্ধ নিশাচরের মতো দিকভ্রান্ত হয়ে পথ খুঁজছি। যে পথের স্বপ্ন তোমরা দেখিয়েছিলে সেই পথটাই তো শুধু চেনা ছিল আমাদের। অথচ সে পথের দিশাও একদিন আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমরাও পারিনি।
কেউ আমাদের বিশ্বাস করেনি সেদিন। অনেকেই ভুল ভেবেছিল আমাদের। আতংকিত হয়েছিল। তার অবশ্য কারণও ছিল যথেষ্ট। অথচ সেসব হতে পারে ভেবে তো আমরা ঝাঁপিয়ে পড়িনি রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে। চেয়েছিলাম স্বচ্ছ, বৈষম্যহীন, সুস্থ সমাজ। ফিরে আসার পর মানুষ করুণার চোখে দেখত আমাদের। অথচ আমাদের স্বপ্ন সাকার হলে হয়ত এই অন্ধকার দেখতে হত না আজ। গোপন আস্তানা থেকে পালানোর পথে পুলিশের বুলেটবিদ্ধ হওয়ার আগে তুমি বলে গেছিলে ,” আমি ফিরতে পারব কিনা জানিনা, তোদের হাতে ব্যাটনটা দিয়ে গেলাম। মনে রাখিস, যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম তাতে কোনও ভুল ছিল না …”। আমরা পারিনি তবে ব্যাটনটা হারায়নি। প্রতীক্ষায় আছি, কবে একজন সত্যিকার মুক্তিকামী বজ্রকঠিন মানুষ জন্ম নেবে এ মাটিতে। যাঁর হাতে তোমার স্বপ্নের ব্যাটন তুলে দেব।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অচিন্ত্যর হাসি পায়। বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। কবে চুল্লির আগুন টেনে নেবে তার ঠিক নেই এখনও স্বপ্ন জিইয়ে রাখা। হাঃ । এই আমূল পরিবর্তিত সমাজে সেই স্বপ্নের দিন ফেরা বোধহয় দূর অস্ত।
ঠক-ঠক-ঠক। দরজায় শব্দ হতেই বিরক্ত হয় অচিন্ত্য। এত রাতে কে? টোটো ভাড়া নিতে মাঝে সাঝে লোক আসে বটে। চোখের সমস্যার জন্য রাতে টোটো বের করতে চায় না অচিন্ত্য । তবু কারো অসুখবিসুখ করলে গাড়ি বের করতেই হয়। শহর ছাড়িয়ে এই তেমুল্লুক থেকে রাতবিরেতে কে আর রোগী নিয়ে যাবে এক অচিন্ত্য ছাড়া। অগত্যা যেতেই হয়।
দরজা খুলতেই দুজন ছেলেকে চোখে পড়ে অচিন্ত্যর। পাড়ার ক্লাবের সদস্য।
-” কী ব্যাপার?” অচিন্ত্য জিজ্ঞেস করে।
-” পরশু স্বাধীনতা দিবস জেঠু। স্বাধীনতার ৭৫ তম অমৃত মহোৎসব । এবারে ক্লাবের পতাকা উত্তোলনটা আপনি করবেন। তাই বলতে এলাম…”।
অমৃত!! কোথায় অমৃত!! আর কীসেরই বা এত মহোৎসব ! যে দেশে এখনও মানুষ… নাঃ কথাগুলো মুখে এসেও আটকে যায় অচিন্ত্যর। যা বলবার সেদিনই বলবে। অমৃত মহোৎসবের দিন ভেতরের যাবতীয় বিষ একেবারে উগড়ে দেবে। যা হয় হোক।
অচিন্ত্য শুধু জিজ্ঞেস করে,” মাইকের ব্যবস্থা থাকবে তো তোমাদের? অনেকদূর পর্যন্ত চোঙাওয়ালা মাইক ….অনেক, অনেক মানুষ যাতে শুনতে পায় কান খুলে …”
ছেলেগুলো একটু যেন অবাক হয়ে চেয়ে থাকে অচিন্ত্যর শক্ত হয়ে ওঠা চোখমুখের দিকে।