অন্ধ ভালবাসা

কোঙ্কনগড়ের রাজা ভদ্রদেব ছিলেন সুপ্রশাসক। তার রাজ্যের প্রজারা খুব সুখে শান্তিতে বসবাস করতেন। লোকজনের মুখে রাজার বহুবিধ গুণকীর্তন চর্চিত হত। যা তৎসময়ে দেশ দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল।

অনেক সময় অত্যাচারী রাজার হাত থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে, সেই রাজার অনেক প্রজা একটু শান্তিতে বাঁচবার আশায় ভদ্রদেবের শরণাপন্ন হতেন। ভদ্রদেব কখনো কাউকে খালি হাতে রাজ-দরবার থেকে ফেরাতেন না।

ভদ্রদেবের দু’ই রানী ছিল। হৈমবতী আর রূপবতী।  রূপে গুণে তারা ছিল নিরূপমা। তবে দু’ই রাণীর মধ্যে কোনো মিল ছিল না। দু’জনে, দু’জনকে সর্বদা হিংসে করতেন।

হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, অঢেল মণি-মানিক্য, প্রচুর ধন-সম্পদ, লোক-লস্কর, সিপাহী-সান্ত্রী, সুখী প্রজা, ভদ্রদেবের সবকিছুই ছিল। তবুও তার মনে কোনো সুখ ছিল না। কারণ তিনি ছিলেন নিঃসন্তান।

একদিন রাজ-দরবারে এক অপরূপ সৌম্যকান্তি দীর্ঘদেহী সন্ন্যাসী ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে হাজির হয়ে বললেন, ”ভিক্ষাং দেহী।”

ভদ্রদেব, সন্ন্যাসীকে খুশি করতে অন্দরমহল থেকে নানাবিধ ফলমূল আনতে দাসীদের দিয়ে রানীদের দু’মহলে খবর পাঠালেন।

রাজার আদেশ শুনে দুই রানী হরেকরকম ফলমূলের সাজিয়ে থালা নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজ-দরবারে এসে উপস্থিত হলেন। সন্ন্যাসীর পায়ের সামনে থালাগুলো রেখে দু’জনে সন্ন্যাসীকে প্রণাম করলেন।

সন্ন্যাসী দুই রানীকে আশীর্বাদ করে ভদ্রদেবকে বললেন, ”জানি রাজন, তুমি সন্তানহীন। তাই তোমার মনে কোনো সুখ শান্তি নেই।”

ভদ্রদেব, সন্ন্যাসীর পা দু’টো জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন, বললেন, ‘’প্রভু, এর একটা কোনো বিহিত করুন। না হলে যে আমার বংশ নির্বংশ হবে।‘’

সন্ন্যাসী বললেন, ‘’রাজন, মা-জননীদের আগে নিজ নিজ মহলে ফিরে যেতে বলুন।‘’

রানীরা রাজ-দরবার থেকে বেরিয়ে যেতেই, সন্ন্যাসী নিজের ঝোলা থেকে দু’টো আপেল বের করে একটা ভদ্রদেবের ডানহাতে দিয়ে বললেন, ‘’রাতে এটা বড়রানীকে খেতে দিও, তাহলে ওর ছেলে হবে’’, আর একটা আপেল ভদ্রদেবের বামহাতে দিয়ে বললেন, ‘’এটা ছোটরানীকে দিও, তাহলে ওর মেয়ে হবে। অন্যথায় সব হারাবে।‘’, বলে প্রতিটি থালাগুলো থেকে কয়েকটা করে ফলমূল ঝোলাতে ভরে নিয়ে রাজ-দরবার থেকে বেরিয়ে, ‘’ভিক্ষাং দেহী’’, বলতে বলতে দূরে পথের কিনারে মিলিয়ে গেলেন।

ভদ্রদেব বড়রানী হৈমবতীর চেয়ে ছোটরানী রূপবতীকে একটু বেশীই ভালবাসতেন। তাই তিনি সন্ন্যাসীর আদেশ অমান্য করে রাতের বেলায় খাওয়ার সময় ডানহাতের আপেলটি ছোটরানীকে আর বামহাতের আপেলটি বড়রানীকে খেতে দিলেন।

সন্ন্যাসীর আশীর্বাদে কিছুদিন পর ছোটরানীর ছেলে আর বড়রানীর মেয়ে হল। সারা রাজ্যে খুশির বন্যা বয়ে গেল। ভদ্রদেব, রাজপুরোহিতের তিথি নক্ষত্রের গণনা অনুসারে রাজপুত্র ও রাজকন্যার নামকরণ করলেন  চন্দ্রদেব আর মণিমালা।

পুত্রানন্দে ভদ্রদেব, রূপবতীর কথায় উঠতে বসতে লাগলেন। রূপবতীর কথা শুনে হৈমবতীকে হেয় করতে লাগলেন।

দুই রানী মধ্যে যতই মন্দ সম্পর্ক থাকুক না কেন? দুই ভাইবোনের মধ্যে কিন্তু মিল ছিল দেখবার মত! বয়স বাড়বার সাথে সাথে সেই সখ্যতা যেন আরও গাঢ় হচ্ছিল।

রূপবতীর শত বারণ সত্ত্বেও চন্দ্রদেবের সঙ্গে মণিমালার মেলামেশা বন্ধ করা গেল না।

ভদ্রদেব মহাফাঁপরে পড়লেন। কারণ একমাত্র তিনিই জানেন, তিনি লুকিয়ে ফল অদল-বদল করেছিলেন, তাই সন্ন্যাসীর কথাগুলো সবসময় তার মনে সর্বদা খুঁত কাটে।

সখ্যতার উৎস জানতে অবশেষে মন্ত্রীদের সঙ্গে গুপ্ত পরামর্শ করে ভদ্রদেব, রাজপুত্র আর রাজকন্যার পেছনে  গুপ্তচর নিয়োগ করলেন। তারা যা খবর দিল, তা শুনে তো রাজার চক্ষু চড়ক গাছ। পূর্ণিমার গভীর রাতে যখন প্রাসাদের সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। তখন রাজবাগনে নিঃশব্দে একটা শ্বেতশুভ্র পক্ষীরাজ ঘোড়া উড়ে এসে বিচরণ করে। সেসময় রাজপুত্র আর রাজকন্যা চুপিসারে বিছানা ছেড়ে বাগানে চলে যায়। তারপর পক্ষীরাজের পিঠে চড়ে সুদূর গগনে মিলিয়ে যায়। ঠিক এক প্রহর পর ওরা আবার বাগানে ফিরে আসে। ওদের নামিয়ে দিয়ে পক্ষীরাজ অবার আকাশে উড়ে যায়।

ভদ্রদেব, রূপবতীকে পক্ষীরাজের ঘটনাটা বললেন। সব কথা শুনে, রূপবতী ওনাকে পক্ষীরাজ ঘোড়াটিকে ধরে দেওয়ার জন্য আবদার করে বসলেন।

ভদ্রদেব, রূপবতীর অনুরোধ ফেলতে পারলেন না। তিনি রূপবতীকে কথা দিয়ে ফেললেন।

অনেক ছক কষে পক্ষীরাজ ধরতে পূর্ণিমার সন্ধ্যেবেলা শক্ত লোহার শেকলের ফাঁদ পাতা হল, যাতে রাজপুত্র বা রাজকন্যা বিন্দুমাত্র যেন না টের পায়।

গভীর রাতে পক্ষীরাজ রাজবাগানে নেমে এল আর ফাঁদে আটকা পড়ল। তার পরিত্রাহি চিঃকারে গোটা রাজপ্রাসাদ থরথর কেঁপে উঠল। তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য রাজপুত্র-রাজকন্যা বাবার হাতে-পায়ে ধরে অনেক অনুনয় বিনয় করল।

কিন্তু ভদ্রদেব অনঢ়। তিনি রূপবতীকে কথা দিয়েছেন, পক্ষীরাজটি ধরে তাকে উপহার দেবেন। তাই পরদিন তিনি সকলের সামনে ঘটা করে ছোটরানীর হাতে পক্ষীরাজটিকে তুলে দিলেন।

কিছুদিন পর পক্ষীরাজের দৈব রুদ্ররোষে ভদ্রদেবের রাজ্যে দুর্দিন দেখা দিল। ঘনঘন খরা-বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরু হল। প্রজারা ধীরে ধীরে রাজ্য ছাড়তে লাগলেন। মন্ত্রীদের অনেকেই পক্ষীরাজটিকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন। কিন্তু ভদ্রদেব তখনও রূপবতীর রূপের মোহে নিগূঢ় অন্ধ হয়ে ছিলেন।

প্রজারা রাজ্য ছাড়া হওয়ায় ভদ্রদেবের রাজস্ব আদায় কমেছে। ফলে রাজজৌলুসও কমেছে। তাই একদিন রূপবতীও পুত্র চন্দ্রদেবকে রাজার কাছে রেখে বাপের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন।

রূপবতীর চলে যাওয়ার পর ভদ্রদেবের হুশ ফিরল। বিন্দুমাত্র দেরী না করে তৎক্ষণাৎ পক্ষীরাজের মুক্তির ব্যাবস্থা করলেন।

যখন রাজপুত্র আর রাজকন্যা, পক্ষীরাজটির দেহ স্পর্শ করল, ওদের হাতের স্পর্শে সঙ্গে সঙ্গে পক্ষীরাজটি সেই অপরূপ সৌমকান্তি সন্ন্যাসীতে পরিবর্তিত হয়ে ভদ্রদেবকে বললেন ‘’রাজন, তুমি আমার আদেশ অমান্য করেছ। তাই তুমি সব হারালে।‘’

তারপর সন্ন্যাসী, রাজপুত্র ও রাজকন্যাসহ অন্তর্হিত হলেন।

সন্তান শোকে ভদ্রদেব নিজের ভুল কাজের জন্য গভীর অনুশোচায় দগ্ধ হতে লাগলেন। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীকে রাজকার্যের ভার অর্পন করে বড়রানীকে নিয়ে নিবিড় অরণ্যপ্রান্তে নিড়াম্বর সন্ন্যাস জীবনযাপন করতে লাগলেন।