সাহিত্যের আকাশে আবার ধূমকেতু

পার্থ নিয়োগী ঃ ধূমকেতু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটি শুধুমাত্র পত্রিকা নয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত বিপ্লবীরা মনে করতেন এটা তাদের বিপ্লবের পত্রিকা। ১১ আগষ্ট ১৯২২ সালে ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাপিয়ে দিয়েছিল এই পত্রিকা। অন্যায়,অবিচার,সাম্প্রদায়িকতা ,সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিল এই ধূমকেতু। আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে বটে। কিন্তু নজরুলের প্রিয় বাংলা আজ দুটি আলাদা দেশ। আকাশের ধূমকেতুর দেখা মিললেও বাংলা সাহিত্যের আকাশ থেকে একেবারে উধাও হয়ে গিয়েছিল ধূমকেতু পত্রিকা। ভাগ্যিস ধূমকেতু আর্ন্তজাতিক নজরুল একাডেমি ছিল। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আবার পথচলা শুরু করল কাজি নজরুলের এই পত্রিকা। আর এরজন্য শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন খোদ কবির নাতনি খিলখিল কাজি। তিনি তার বার্তায় লিখেছেন ‘ নজরুলের অসাম্প্রদায়িক,বৈষম্যহীন,শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন তা যেন আবারও একসঙ্গে মিলে ধূমকেতুকে নিয়ে এগিয়ে যাবার প্রত্যয়। তবে কবির নাতনি হবার পরেও তিনি শুভেচ্ছা বার্তায় সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী কথাটি উল্লেখ করেছেন। অথচ বিপ্লব করতে হলে রক্ত ঝড়লেও বিপ্লবীরা কখনই সন্ত্রাসবাদী নয়। বলা ভাল লাগামহীন সন্ত্রাস বন্ধ করতেই বিপ্লবের জন্ম হয়। এই কারনে নজরুল গান্ধীর সমালোচনা করে নেতাজি সুভাষের পথকেই সমর্থন করেছিলেন। তারপরেও কবির নাতনি হয়ে তার এই শব্দচয়ন দেখে অবাক হতে হয় বৈকি। এছাড়াও শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন বাচিক শিল্পী বিজয়লক্ষ্মী বর্মন,সংগীত শিল্পী ইন্দ্রানী সেন,কল্যান সেন বরাট,শম্পা কুন্ডুর মত বিদগ্ধ শিল্পীবৃন্দ। একাডেমির সম্পাদকের কলমে সংস্থার সম্পাদক মানস চক্রবর্তী ‘ ধূমকেতু আর্ন্তজাতিক নজরুল একাডেমি’ এর সমস্ত কর্মকান্ড এবং চিন্তাধারার কথা সুন্দর লেখনীর মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন। নজরুল মানেই বৈচিত্রতা, খোলা মনে সব কিছুকে নিজের বলে মনে করা। তাই স্বাভাবিকভাবেই নজরুল কে নিয়ে লেখা মানে কোন একটা আবদ্ধ বিষয়ে আটকে থাকা নয়। প্রথমেই তাই ‘স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্নদ্রষ্টা আজ বিশ্বশান্তির দিক নির্দেশক নজরুল’ প্রবন্ধটি খুব প্রাসঙ্গিক । বাংলায় ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতের প্রথম অনুবাদক ছিলেন নজরুল। সেই ইতিহাস উঠে এসেছে মল্লিকা গাঙ্গগুলির কলমে। নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত ও গজল নিয়ে রমলা মুখার্জির তথ্যবহুল লেখা পাঠককে সমৃদ্ধ করবে। কোচবিহারের ছেলে ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের সাথে নজরুলের অন্তরঙ্গ সর্ম্পক আমাদের অনেকেরই জানা। আব্বাসউদ্দিনের ভাওয়াইয়ার সুর আধুনিক বাংলা গানে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন নজরুল। আর আব্বাসউদ্দীন ও নজরুল কে নিয়ে কলম ধরেছেন সব্যসাচী ঘোষ। প্রবন্ধের পাশাপাশি নজরুল কে নিয়ে লেখা ১৮ টি কবিতাও আছে এই সংখ্যায়। কবিদের মধ্যে অন্যতম হলেন কবীর হুমায়ুন,সুবীর সরকার, সুদীপ্ত মাজিতাহেরা খাতুন প্রমুখ। বর্নালি মাইতি এবং মিঠু অধিকারীর ছোট গল্পদুটিও পাঠকে আনন্দ দেয়। মায়া রায়ের লেখা ‘নির্ভীক নজরুল’ ও বহ্নিশিখা ঘটকের শিশু সাহিত্যে নজরুলের ভূমিকা নিয়ে লেখা প্রবন্ধ দুটি বেশ তথ্যবহুল। নজরুলের কবিতা বিশ্লেষন করে লেখা চারটি প্রবন্ধ বইটিকে এক অন্যমাত্রায় এনে দিয়েছে। সবশেষে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনি সূত্র ধরে শ্যামল দত্তের নাট্যরুপান্তর ‘ দে গরুর গা ধুইয়ে’ তে খুব নিপুনভাবে বর্তমান সময়ে নজরুলের উপস্থিতি থাকলে যে সেটা তারকাছে কত বেদনার হোত সেটাই তুলে ধরেছেন। রশিদ খানের করা প্রচ্ছদটি চমৎকার। বই এর পেছনের পাতায় ধূমকেতুর সেই ঐতিহাসিক সংখ্যাগুলি নিয়ে কোলাজে রুপ দেওয়া সম্পাদকের গভীর চিন্তার ফসল। তবে ধূমকেতুর এই নতুনভাবে পথচলা শুরু এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকার পাশাপাশি আগামীতে নজরুলের মুক্তভাবনার আদর্শ আরও বেশী করে ছড়িয়ে দিতে পারবে এটুকু আশা নিশ্চিন্তে করা যেতেই পারে।