কোভিড আবহে বিধিনিষেধের সরকারি নির্দেশিকা। নিয়মমাফিক ভাবে দিন পনেরো অন্তর সরকারী স্তরে করোনার গ্রাস থেকে সাধারণ কে বাঁচাবার বিধিব্যবস্থা। সে নির্দেশিকার সবার প্রথম পয়েন্টে গুরুত্ব দিয়ে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। যে কোনভাবে স্কুল- কলেজ-ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে করোনার প্রকোপ থেকে বাঁচাতেই হবে।
অতি উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু গত প্রায় বছর দেড়েক ধরে শিক্ষার সম্পূর্ণ পঙ্গুত্ব প্রাপ্তির বিষয়টির কি হবে? এতদিনে সম্পূর্ণ প্রমাণিত কম্পিউটার, এন্ড্রয়েড ফোনের সাহায্য নিয়ে প্রকৃত উপায়ে ক্লাস করে সঠিকভাবে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা একটা আই ওয়াশ ছাড়া আর কিছু নয়। ক্লাস চলছে। পড়ুয়া নেই। পরীক্ষার অছিলায় বই দেখে লেখা চলছে। কলেজের পড়ুয়ারা মাঠে-ঘাটে ভিড় করে বসে টুকলি করে খাতায় তুলে সে খাতা জমা দিয়ে ঝুড়ি ভরে নম্বর তুলছে। একটা বিরাট অংশের ছাত্রছাত্রীদের কাছে এন্ড্রয়েড ফোনের সাহায্য নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সোনার পাথর বাটি নাড়াচাড়া করার সামিল। আর যারা তা করতে পারছে, তাদের মধ্যেকার একটা অংশের মনের গভীরে বাসা বাঁধছে নেট ঘাঁটাঘাঁটির বিষপোকারা। গৃহের অভ্যন্তর এবং সেলফোনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে পঙ্কিল ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াচ্ছে তাদের অধিকাংশ।
কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকারি কেষ্ট বিষ্টুরা সত্যিই ভীষণ রকম নির্লিপ্ত। স্বাস্থ্যব্যবস্থা গত বছর থেকে অনেক সময় পেয়েও যেমন স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি, তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রেও সুদুরপ্রসারী ফলপ্রসূ চিন্তাভাবনার ভীষণ অভাব লক্ষ্য করা গেছে। কোভিডের প্রথম ঢেউ থেকে দ্বিতীয় ঢেউয়ের দিকে ক্রম অগ্রসরমানতার কালে হাতে কিন্তু অনেকটা সময় ছিল। ওই সময়টুকুর ভেতরে আমরা কি দেখলাম? দেশজুড়ে ধর্মীয় উন্মাদনা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছানাপোনাদের চূড়ান্ত আস্ফালন এবং ভোট নামক রাজসূয় যজ্ঞের প্রস্তুতি ও তারিয়ে তারিয়ে তার ব্যাপ্তি বাড়িয়ে চলা। এসবের মাঝে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রকৃত ভাবুকরা যে সংখ্যায় নিতান্ত নগণ্য হয়ে পড়েছেন। শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র হাতে নিয়েও তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি কোনো সদর্থক চিন্তার উৎসের সন্ধান। শিক্ষা বাদ দিয়ে অন্য সবকিছু চালাবার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে সরকারি স্তরে। শুধু শিক্ষার বেলাতেই প্রকৃত শুভচিন্তকদের সংখ্যা বাড়ন্ত হয়েছে। গ্রাম শহরের প্রচুর শিশু-কিশোর-কিশোরীদের সরকারিভাবে "যাও, তোমাদের পাঠশালা বন্ধ"- এর গল্প শুনিয়ে যখন ঘরে থাকতে বাধ্য করা হলো, ঠিক তখনই তাদের বাবা- কাকা-মামা-দাদারা (কোন কোন ক্ষেত্রে মা- পিসি- মাসিরাও) পুর্ণ্যোদ্যমে ভোটের ময়দান ভরাতে নেমেছেন। এই অগ্রজ আত্মীয়েরা কি কোন ভাবেই ঘরে থাকা স্কুল কলেজ পড়ুয়াদের কাছে করোনাকে কোলে তুলে নিয়ে যাননি? ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে পরিকল্পনামাফিক ভাবে স্কুল-কলেজ গুলি এসবের পরেও খোলার কিন্তু কোনো চেষ্টা করা হচ্ছে না। একেকটি ক্লাস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অন্তত সপ্তাহে একদিন করে খুলেও তো চেষ্টা করা যেত শিক্ষাব্যবস্থাকে অন্তত কিছুটা সচল রাখবার। চেষ্টা করা যেত সরকারিভাবে সাহায্যপ্রাপ্ত বিপুল সংখ্যক ক্লাবগুলোকে ব্যবহার করে শিক্ষাকে 'দুয়ারে' নিয়ে যাওয়ার। চেষ্টা করা যেত মাননীয় প্রধান শিক্ষক- শিক্ষিকাদের একটি ছাতার নিচে নিয়ে এসে এ ব্যাপারে মত বিনিময়ের মাধ্যমে অচলাবস্থা কাটিয়ে তোলবার। আমাদের রাজ্যে এ মুহূর্তে তো ছড়িয়ে আছেন জ্ঞানী ও গুণী শিক্ষারত্নেরা। তাঁদের উল্লেখযোগ্য মতামতে এ জগদ্দল পাথরকে টলানো যেত না - এমনটা ভাবা বোধহয় বাতুলতা। বাস্তবিক, সরকারি সদিচ্ছা অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে।
খুব স্বাভাবিক মনস্কতায় এটা সবাই স্বীকার করছেন যে, এ পড়া পড়া নয়, এ পরীক্ষা পরীক্ষা নয়, এ ফলাফল অবশ্যই সঠিক মেধাকে চিহ্নিত করতে অপারগ। এই বিপুল সংখ্যক সরকারি তকমা ওয়ালা 'শিক্ষিত' তথা ফলাফলে 'স্কলার' ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ কী? কোভিডের দোহাই দিয়ে এদের শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন, লড়াইয়ের স্পৃহা তথা 'কষ্ট করে কেষ্ট পাওয়া' র মধুর অনুভূতিকে সমূলে বিনাশ করবার অভিসন্ধির বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের প্রতিবাদী হওয়া এখনই প্রয়োজন। খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই।
..........নীলাদ্রি বিশ্বাস